ঢাকা, শুক্রবার, ১৭ মাঘ ১৪৩১, ৩১ জানুয়ারি ২০২৫, ০০ শাবান ১৪৪৬

জাতীয়

কেমন আছে অনাথ হোস্টেলের সেই মেয়েরা!

জান্নাতুল ফেরদৌসী, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৩৭ ঘণ্টা, মার্চ ৯, ২০১৫
কেমন আছে অনাথ হোস্টেলের সেই মেয়েরা! ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ঢাকা: বয়স ১৮ বছর হলেই এতিমখানা ছাড়তে হয় অনাথ মেয়েদের। এদের অধিকাংশেরই হোস্টেলে থাকাকালেই শুরু হয় বিয়ের তোড়জোড়।

কাউকে চলে যেতে হয় পারিবারিক বলয়ে। খুব কম জনই বেছে নেয় নিজের পায়ে দাঁড়ানো সংগ্রামী জীবন।

এর আগে এতিমখানার মেয়েদের নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছে বাংলানিউজে। ওই প্রতিবেদনে যাদের কথা বলা হয়েছিলো তারা এখন কেমন আছে তা জানাতেই বাংলানিউজের এবারের আয়োজন।

বিলকিস
আজিমপুর মাতৃসদন ও শিশু হাসপাতালে নার্সিং পেশায় নিয়োজিত বিলকিস। এক সন্তান, স্বামী, শ্বশুর-শাশুড়িকে নিয়ে কোনোমতে দিন কাটছে তার। বিলকিসের স্বামী আগে একটি গাড়িতে কাজ করলেও বর্তমানে বেকার। তাই সাত হাজার টাকা বেতনেই অনেক টানাপড়েনে সংসার চালাতে হচ্ছে তাকে।

বাংলানিউজকে বিলকিস বলেন, কষ্টে যাদের জীবন গড়া তাদের আবার কষ্ট কিসের। ভেতরে যত কষ্টই থাকুক, সবর্দা ম‍ুখে হাসি ফুটিয়ে রাখি।  

 ‘কেমন আছেন?’ এ-প্রশ্নে নিমর্ল হাসি দিয়ে বললেন, সব মিলিয়ে ভালোই আছি। আর কষ্ট তো আমার ছোটবেলা থেকেই। যেদিন বাবা মারা গিয়েছিলেন সেদিন থেকে।

দেড় মাস বয়সে বাবা আর দেড় বছর বয়সে মা মারা গেছেন বিলকিসের। এরপর বড় বোনের সঙ্গে ঢাকায় কাজ নেন এক বাসায়। ওই বাসার মালিক দুই বোনকেই স্কুলে ভর্তি করে দেন। এরপর ওই বাসার মালিকের সহযোগিতায় স্যার সলিমুল্লাহ এতিমখানার হোস্টেলে ওঠেন বিলকিস। ১৯৯৭ সালে এসএসসি পরীক্ষায় এক বিষয়ে অকৃতকার্য হওয়ার পর অনেক চেষ্টা করেও আর পড়াশোনা চালাতে পারেননি। এটা তার সারা জীবনের আফসোস।

অনেকের কাছে সাহায্য চেয়েছেন, কিন্তু কেউ সাহায্য করেনি। তখন যদি কেউ তাকে আর একবার সুযোগ দিত তাহলে তিনি আরও ভালো কিছু হতে পারতেন বলে মনে করেন।

তিনি জানান, হোস্টেল থেকে বের করে দেওয়ার ভয়ে নিজেই নিজের বিয়ে ঠিক করেছিলেন। পাশাপাশি ডায়বেটিস সেন্টারে নার্সিংয়েরও প্রশিক্ষণ নিয়েছেন।

বেসরকারি প্রতিষ্ঠান মেডিকমে দীর্ঘ ১৩ বছর চাকরির পর গত আট মাস ধরে আজিমপুর মাতৃসদন ও শিশু হাসপাতালে নার্সিংয়ের কাজ করেছেন।

সুমী
বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী ও লেখাপড়ায়  ‍দুর্বল বলে ছাত্রী হোস্টেল থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল অনাথ মেয়ে সুমীকে। পাঁচ বোনের মধ্যে সবার ছোট সুমী। দরিদ্র পরিবারের সুমীর ঠাঁই হয়নি কোথাও। বান্ধবীর ছোট বোন হওয়ায় বিলকিস তার কাছেই রেখেছেন সুমীকে।

বিলকিস জানালেন, সে সময় আমার বাসায় এনে স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছিলাম। কিন্তু কোনোমতেই এগোয়নি পড়াশোনা। এখন বিয়ে দিতে ভালো পাত্র খোঁজা হচ্ছে সুমীর জন্য।

বীথি
চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন ছিল অনাথ বীথির। কিন্তু দারিদ্র্য আর বাস্তবতা তার স্বপ্ন পূরণ হতে দেয়নি। বতর্মানে গোপালগঞ্জ সরকারি গণসংযোগ বিভাগে গণসংযোগ কর্মী হিসেবে কাজ করছেন।

শত বাধা পেরিয়েও লেখাপড়া চালিয়ে গেছেন বীথি। চাকরি ও লেখাপড়া একসঙ্গে চালিয়ে যেতে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল বলে জানান তিনি।

বীথি বলেন, এইচএসসি পাস করার পর অন্ত:স্বত্বা অবস্থায় ঢাকায় সরকারি কলেজে ভর্তি হয়েছিলাম। এদিকে কর্মস্থল গোপালগঞ্জে। কি করব! লেখাপড়া তো আর বাদ দিতে পারি না।

ফোনালাপে বর্তমান অবস্থা জানতে চাইলে বাংলানিউজকে তিনি জানান, এ বছরই গোপালগঞ্জ বঙ্গবন্ধু কলেজ থেকে স্নাতক (ডিগ্রি) পরীক্ষা দিয়েছেন। চাকরির পদোন্নতি নিয়ে একটু সমস্যা হচ্ছে। এরপরও সব মিলিয়ে ভালো আছেন।

তবে নির্দেশনা দেওয়ার কেউ থাকলে  আরও ভালো থাকতে পারতেন বলে দাবি করেন বীথি।

তিনি বলেন, ১৮ বছর বয়স হলে বীথিসহ আরও কয়েকটি মেয়েকে হোস্টেল ছেড়ে দিতে বলে কর্তৃপক্ষ। কিন্তু তারা হোস্টেল কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করে কয়েক মাস সময় নিয়েছিলেন।
 
তিনি জানান, এক শিক্ষকের সহযোগিতায় ২০১০ সালে চাকরি নিয়ে হোস্টেল থেকে বের হয়ে আসেন বীথি। সে সময় তিনি পড়ালেখা চালিয়ে যেতে পারলে অবশ্যই ভালো কোনো পদে চাকরি করতে পারতেন।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে বীথি বলেন, কপালেই লেখা নেই আমার।

তার কাছ থেকে জানা গেল, তার সময়ের সানজিদা, আনোয়ারাসহ হোস্টেল ছেড়ে যাওয়া আরও কয়েকজনের কথা। তবে এরা সবাই বিয়ে করে স্বামীর সংসার করছেন বলেই জানান বিথী।

স্বপ্ন পূরণের অপূর্ণতা নিয়ে এভাবেই দিন কাটাচ্ছেন অনাথ হোস্টেল ছেড়ে যাওয়া মেয়েরা। সঠিক নির্দেশনার অভাবে মুখ থুবড়ে পড়েছে তাদের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা।

সলিমুল্লাহ এতিমখানার হোস্টেল সুপার মো. সাদাত হোসেন জানান, বর্তমানে স্যার সলিমুল্লাহ এতিমখানার গালর্স হোস্টেলে একশ’ চারজন মেয়ে থাকে। বয়স অনুযায়ী প্রতি বছর ১০ থেকে ১৫ জন মেয়ে এখান থেকে বের হয়ে যায়।

তবে বেরিয়ে যাওয়া ১০ জনের মধ্যে গড়ে প্রায় আটজনেরই বিয়ে হয়ে যায় বলে জানান তিনি।

এ প্রসঙ্গে সমাজ কল্যাণমন্ত্রী সৈয়দ মহসীন আলী বাংলানিউজকে বলেন, বিষয়টি নিয়ে আমরা চেষ্টা করছি। যেন ২২ বছর পর্যন্ত মেয়েরা এতিমখানায় থাকতে পারে। এটা আমাদের পরবর্তী পরিকল্পনা। যা বাস্তবায়নের জন্য এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা।

মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি বলেন, ১৮ বছর হলে সাধারণত একটি মেয়েকে পূর্ণবয়স্ক ধরা হয়। এজন্যই গঠনতন্ত্রে বয়স ১৮ করা হয়েছে। যদিও এতিম মেয়েদের জন্য আলাদা করে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। তবে তারা যদি কাজ করেও পড়ালেখা করতে চায় সেক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রশিক্ষণসহ কর্মক্ষেত্রে তাদের কোটা ব্যবস্থার কথা চিন্তা করবে সরকার।

বাংলাদেশ সময়: ১৩৩৮ ঘণ্টা, মার্চ ৯, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।