ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৮ মাঘ ১৪৩১, ২৩ জানুয়ারি ২০২৫, ২২ রজব ১৪৪৬

জাতীয়

আস্থা সঙ্কটে শেয়ারবাজার, কাটছে না পতন

সাঈদ শিপন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২২৪ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৯, ২০১৫
আস্থা সঙ্কটে শেয়ারবাজার, কাটছে না পতন

ঢাকা: আস্থা সঙ্কট থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না দেশের শেয়ারবাজার। ফলে একটু ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা দেখা দিলেই পরক্ষণে আবার পতনের কবলে পড়ছে।


 
বিশেজ্ঞরা বলছেন, এই মুহূর্তে দেশের অর্থনৈতিক সূচকগুলো ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি যে অবস্থায় রয়েছে, তাতে শেয়ারবাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার কথা নয়। মূলত বিনিয়োগকারীদের আস্থা সঙ্কটের কারণেই বাজারে নেতিবাচক প্রভাব দেখা যাচ্ছে।
 
তারা বলছেন, ২০১০ সালের মহাধসের পরই এ আস্থা সঙ্কটের সৃষ্টি হয়। এরপর কয়েক দফা বাজারে ইতিবাচক প্রবণতা দেখা দিলেও বিনিয়োগকারীদের আস্থা সঙ্কট কাটেনি।
 
ধসের পর কয়েক দফা সৃষ্টি হওয়া রাজনৈতিক অস্থিরতা, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের অনিয়মিত বিনিয়োগ, বিদেশি বিনিয়োগকারীদের চতুরতা ও সর্বশেষ বিদেশি নাগরিক হত্যার ঘটনা আস্থা সঙ্কট কাটানোর পথে অন্তরায় হিসেবে কাজ করেছে বলে মনে করছেন বিশেজ্ঞরা।
 
তারা বলছেন, সাম্প্রতিক সময়ে দু’জন বিদেশি নাগরিক হত্যার ঘটনায় দেশে এক ধরনের চাপা অসন্তোষ বিরাজ করছে। এ ঘটনায় সরকারের উপরেও এক ধরনের বৈদেশিক চাপ রয়েছে।
 
এ কারণে আবার দেশের ভিতরে অস্থিতিশীল অবস্থার সৃষ্টি হয় কিনা তা নিয়ে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক বিরাজ করছে। ফলে দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অবস্থা বেশ ইতিবাচক থাকলেও, আস্থা সঙ্কটের কারণে তার প্রভাব শেয়ারবাজারে পড়ছে না।
 
তারা বলছেন, বাংলাদেশ অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করার কারণেই নিম্নমধ্য আয়ের দেশের কাতারে উঠে এসেছে। মূল্যস্ফীতি নেমে এসেছে ছয় শতাংশের ঘরে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে একের পর এক রেকর্ড হচ্ছে। ইতিবাচক ধারায় রয়েছে রেমিটেন্স ও রফতানি আয়। কমেছে ব্যাংকের সুদ হার। জিডিপির প্রবৃদ্ধিও বেশ ইতিবাচক।

২০১৪-১৫ অর্থবছর শেষে সাড়ে ছয় শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে জিডিপির প্রবৃদ্ধি। চলতি অর্থবছরে তা আরও বাড়বে এমনটাই আভাস দিচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে বেসরকারি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে কিছুটা হতাশা রয়েছে।
 
এদিকে, শেয়ারবাজার পর্যালোচনায় দেখা যায়, আগস্ট মাসে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) নিয়মিতই ৬শ কোটি টাকার উপরে লেনদেন হয়েছে। এমনকি লেনদেনের পরিমাণ ৯শ কোটি টাকাও ছাড়িয়ে যায় কয়েক দিন। সেই লেনদেন এখন নেমে এসেছে ২শ কোটি টাকার ঘরে।
 
সূচকেও দেখা দিয়েছে নেতিবাচক প্রভাব। চলতি মাসেই ডিএসই’র প্রধান সূচক ২শ পয়েন্টের উপরে পড়ে গেছে। বাজার মূলধন কমেছে ১৮ হাজার কোটি টাকার উপরে। বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও তুলে নিয়েছেন বড় অংকের বিনিয়োগ।

এ নিয়ে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী বাংলানিউজকে বলেন, বর্তমানে দেশের অর্থনৈতিক সূচকগুলো বেশ ইতিবাচক রয়েছে। সেই সঙ্গে রাজনৈতিক পরিস্থিতিও বেশ স্থিতিশীল। এ পরিস্থিতিতে শেয়ারবাজারে নেতিবাচক প্রবণতা বিরাজ করার কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই।
 
তিনি বলেন, বাজারে ভালো ও খারাপ সময় উভয়ই থাকবে। কিন্তু বর্তমানে বাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার কোনো অর্থনৈতিক কারণ নেই। মূলত বিনিয়োগকারীরা আস্থা সঙ্কটে ভুগছেন। এ আস্থা সঙ্কটের কারণেই নেতিবাচক প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।
 
শেয়ারবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগ সমন্বয়ের বিষয়ে বিএসইসি’র সাবেক এ চেয়ারম্যান বলেন, শেয়াবাজারের অতিরিক্ত বিনিয়োগ সমন্বয়ের জন্য ব্যাংকগুলোকে যে সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে, তা বাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার মুখ্য কারণ নয়। তারপরও ব্যাংকগুলোকে অতিরিক্ত বিনিয়োগ সমন্বয়ের জন্য আরও সময় দেওয়া প্রয়োজন।
 
জানা গেছে, শেয়ারবজারে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ছয় হাজার কোটি টাকার মতো অতিরিক্ত বিনিয়োগ রয়েছে। এ অতিরিক্ত বিনিয়োগ আগামী বছরের জুলাইয়ের মধ্যে ব্যাংকগুলোকে সমন্বয় করতে হবে।
 
নতুন ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী, বাণিজ্যিক ব্যাংক শেয়ার বাজারে ইক্যুইটির ২৫ শতাংশ পর্যন্ত বিনিয়োগ করতে পারবে। এ ইক্যুইটির মধ্যে রয়েছে পরিশোধিত মূলধন, শেয়ার প্রিমিয়াম, সংবিধিবদ্ধ রিজার্ভ ও রিটার্ন আর্নিংস।
 
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সাবেক রিসার্চ কর্মকর্তা মো. বখতিয়ার হাসান বলেন, ২০১০ সালের ধসের মধ্য দিয়ে বিনিয়োগকারীদের যে আস্থা সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছিলো তা এখনও কাটেনি। মাঝে মধ্যে বাজারে যে ইতিবাচক প্রবণতা দেখা দিচ্ছে তাকে স্থিতিশীলতা বলা যায় না।
 
তিনি বলেন, দেশে নিয়মিতই কোনো না কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটছে। ২০১৪ সালে জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বড় ধরণের রাজনৈতিক সঙ্কট সৃষ্টি হয়। ২০১৫ সালে এসে আবার অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে রাজনৈতিক পরিস্থিতি।
 
এরপর রাজনৈতিক পরিস্থিতি অস্থিতিশীল অবস্থা কাটিয়ে ওঠার আভাস দিলেও দেশে কিছু অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে। একাধিক ব্লগারকে হত্যা করা হয়েছে। সম্প্রতি বিদেশি দু’জন নাগরিক হত্যার ঘটনা ঘটেছে।
 
এসব বিষয় বিনিয়োগকারীদের মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক সৃষ্টি করছে। ভবিষ্যতে আবার রাজনৈতিক পরিস্থিতি অস্থিতিশীল হয়ে পড়বে কিনা, তা নিয়েও বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আতঙ্ক রয়েছে।
 
এদিকে, বিদেশি নাগরিক হত্যার পর শেয়ারবাজারে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের শেয়ার বিক্রির এক ধরনের চাপ দেখা যায়। যদিও মুনাফা তুলে নেওয়া বিদেশিদের শেয়ার বিক্রির অন্যতম কারণ, তারপরও তা সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক সৃষ্টি করছে। এসব কারণেই অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ইতিবাচক থাকার পরও শেয়ারবাজারে নেতিবাচক প্রবণতা দেখা দিচ্ছে, বলেন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের এ অধ্যাপক।
 
বাজার মূলধন
চলতি বছরের প্রথম কার্যদিবস ০১ জানুয়ারি ডিএসই’র বাজার মূলধন ছিলো তিন লাখ ২৯ হাজার কোটি টাকা। টানা দরপতনে এক পর্যায়ে ০৪ মে তা নেমে আসে দুই লাখ ৯৩ হাজার কোটি টাকায়। আর বাজার ইতিবাচক ধারায় ফেরার কারণে ০৫ আগস্টের লেনদেন শেষে ডিএসই’র বাজার মূলধন বেড়ে দাঁড়ায় তিন লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকায়।
 
এরপর আবার নেতিবাচক প্রবণতা দেখা দেওয়ার কারণে সেপ্টেম্বরের শুরুতে বাজার মূলধন কমে দাঁড়ায় তিন লাখ ৩২ হাজার কোটি টাকায়। আর ২৮ অক্টোবরের লেনদেন শেষে ডিএসই’র বাজার মূলধন আরও কমে দাঁড়িয়েছে তিন লাখ ১৭ হাজার কোটি টাকায়।
 
সূচক ও লেনদেন
বছরের শুরুর দিন ডিএসইএক্স সূচক ছিলো চার হাজার ৯শ ৪১ পয়েন্টে। মে মাসে তা কমে তিন হাজার ৯শ ৫৯ পয়েন্টে চলে আসে। আগস্ট শেষে আরও কমে ডিএসইএক্স সূচক চলে আসে চার হাজার ৭শ ৬৮ পয়েন্টে।
 
এরপর সেপ্টেম্বর মাসের শেষ সময়ে এসে বাজারে কিছুটা ইতিবাচক প্রবণতা পড়ায় ডিএসইএক্স সূচক বেড়ে চার হাজার ৮শ ৫২ পয়েন্টে চলে আসে। তবে চলতি মাসে আবার পতন প্রবণতা দেখা দেওয়ায় ২৮ অক্টোবরের লেনদেন শেষে ডিএসইএক্স সূচক কমে দাঁড়িয়েছে চার হাজার ৫শ ৭৯ পয়েন্টে।
 
এদিকে, আগস্টে যে লেনদেন ৯শ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গিয়েছিলো তা ২৮ অক্টোবর শেষে হয়েছে ২শ ৬২ কোটি টাকা। আর শেষে ২৪ কার্যদিবসের মধ্যে ৫শ কোটি টাকার ঘর স্পর্শ করতে পারেনি ডিএসই’র লেনদেন।
 
প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ
ব্রোকারেজ হাউজ ও মার্চেন্ট ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বাজারে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের অংশ নেওয়া বেড়েছে।

প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের লেনদেন তথ্য থেকে দেখা যায়, জুন মাসে মোট লেনদেনে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের অবদান ছিলো ৪৭ শতাংশের মতো। আগস্টে তা বেড়ে ৫৪ শতাংশের কাছে চলে আসে। আর সেপ্টেম্বর শেষে তা আরও বেড়ে প্রায় ৫৫ শতাংশ হয়েছে।
 
বিদেশি বিনিয়োগ
বিদেশি বিনিয়োগ তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, চলতি বছরের মার্চ, এপ্রিল, মে, আগস্ট ও অক্টোবর এ পাঁচ মাসেই বিদেশিরা শেয়ারবাজার থেকে বিনিয়োগ প্রত্যাহার করেছে। শেয়ারবাজার থেকে এক বছরে বিদেশিদের পাঁচ মাস বিনিয়োগ প্রত্যাহার করার ঘটনা এটিই প্রথম।
 
এরমধ্যে মার্চ থেকে মে টানা তিন মাসে বিনিয়োগ উঠিয়ে নেওয়া হয় ১শ ৮৬ কোটি ৫৮ লাখ টাকা। এরপর দুই মাস গ্যাপ দিয়ে আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে বিনিয়োগ তুলে নেওয়া হয়েছে ১শ ৭৬ কোটি ৩৬ লাখ টাকা।
 
প্রথম ধাপে মার্চে ৩২ কোটি ২৯ লাখ টাকা, এপ্রিলে ৬৭ কোটি এক লাখ টাকা ও মে মাসে ৮৭ কোটি ২৮ লাখ টাকা বিনিয়োগ তুলে নেয় বিদেশি বিনিয়োগকারীরা। আর শেষ দুই মাসের মধ্যে আগস্টে ১শ ১৩ কোটি ৯৬ লাখ ও সেপ্টেম্বরে ৬২ কোটি ৪০ লাখ টাকা বিনিয়োগ তুলে নেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশ সময়: ১২২৪ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৯, ২০১৫
এএসএস/এসএস

** বিপাকে পদ্মা লাইফের শেয়ারহোল্ডাররা

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।