ঢাকা: শিশুকালেই ছোট্ট মুন্নীর মায়া ছাড়েন দরিদ্র মা-বাবা, দত্তক দিয়ে দেন। পালক মা-বাবার হাত ঘুরে ভারতে পাচার হয়ে যায় সে কৈশোরেই।
মুন্নী আক্তারের আপাত ঠিকানা গাজীপুরের একটি শেল্টার হোম। বিএনডব্লিউএলএ তাকে উদ্ধার করে পুনর্বাসিত করার চেষ্টা করছে। কিন্তু তার বিশ্বাস অর্জন করতে পারছেন না কেউই।
বাংলানিউজের সঙ্গে আলাপে মুন্নী কান্নাচাপা কন্ঠে বলছিলেন, মানসিক ধকল এখনো কাটেনি তার।
‘পৃথিবীর কোথাও কেউ আমার আছে বলে কখনো ভাবি নাই। ইন্ডিয়ায় যতোদিন ছিলাম, প্রতিদিন অত্যাচার হইতো। মনে হইতো, আল্লাহ-ভগবান কেউ আসলে নাই’- বলেন মুন্নী।
এমন লাখো মুন্নী নিপীড়নের ভয়ংকর স্মৃতি নিয়ে বিচার প্রত্যাশী হয়ে বেঁচে রয়েছেন বলে বাংলানিউজের সঙ্গে আলাপে জানান সংশ্লিষ্টরা।
তারা বলছেন, মেয়েদের অগ্রযাত্রায় বড় অন্তরায় হচ্ছে যৌন হয়রানি। ধর্ষণ, ধর্ষণের পর হত্যাসহ নানাভাবে যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে মেয়েরা।
ইউনিসেফ বলছে, বাংলাদেশের মোট জনগোষ্ঠীর ৪৫ শতাংশ শিশু। আর সেসব শিশুর মধ্যে আবার ৪৮ শতাংশই মেয়েশিশু। তাদের অধিকাংশই সহিংসতা ও বিকাশের অধিকার থেকে বঞ্চিত।
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, বিরাজমান অস্থিতিশীল সমাজ ও পুরুষতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণা ও অসচেতনতার কারণে বিপুল সংখ্যক মেয়েশিশু নানাভাবে নির্যাতন ও বঞ্চনার শিকার হচ্ছে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে। বেড়েই চলেছে মেয়েশিশু নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ড। আর তাদের কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতিতে এসবই বড় বাধা।
সংশ্লিষ্টরা আরও বলছেন, নিপীড়িতের প্রতি বৈষম্য ও নিপীড়নের ঘটনায় দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়া, ঘটনাগুলো সাইবার জগতে ছড়িয়ে ধকল বাড়ানোর ঘটনাসহ নানা কারণে মেয়ে ও তাদের পরিবারের সদস্যরা আতঙ্কিত হয়ে পড়ছেন।
সংশ্লিষ্টদের আশঙ্কা, এভাবে চললে ভবিষ্যত প্রজন্ম এক ধরনের অসুস্থতা নিয়ে এগোবে।
তারা বলছেন, নিপীড়নের সব ঘটনা সামনে আসে না। বাস্তবের চিত্র অনেক ভয়াবহ। অনেক সময় সমাজ-সম্মান রক্ষায় ঘটনা গোপন রাখছে ভিকটিমরা। কেউ আবার বিচার পাবে না ধরে নিয়ে আইনের আশ্রয় নেয় না। কেউ নিপীড়কের ভয়ে চুপ বা টাকায় মীমাংসায় বাধ্য হয়। এভাবে পরিস্থিতি ক্রমশ খারাপ হচ্ছে। লাগাম না ধরলে বিপদ কেবলই বাড়বে।
শুধু সমস্যা নয়, এর সঙ্গে সমাধান নিয়েও কথা বলেছেন তারা।
অধ্যাপক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল
যৌন হয়রানি বন্ধে সম্মিলিত উদ্যোগকেই সমাধান মনে করছেন শিশুসাহিত্যিক, পদার্থবিদ, কলামিস্ট, অধ্যাপক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল।
তিনি বলেন, শুধু সরকার-প্রশাসন নয়, সম্মিলিতভাবে সবাইকে সোচ্চার হয়ে এটি বন্ধ করতে হবে। পরিবার, পাঠ্যসূচি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে প্রতিটি স্তরে চাই উদ্যোগ।
জাফর ইকবাল বলেন, যখন থেকে শিশু বুঝতে শিখবে, তখন থেকেই মা-বাবা শিশুর দৃষ্টিভঙ্গি গড়বেন, যাতে তারা মেয়েদের সম্মান দিতে শেখে। পরিবারে ভাই-বোন, স্বামী-স্ত্রীর অধিকারের বৈষম্য চলবে না। শিশুকে শেখাতে হবে- প্রত্যেকেই যার যার ভূমিকায় অনবদ্য। তবেই সে সবার সম্মান দিতে শিখবে।
‘পাঠ্যসূচিতে এমন কোনো বৈষম্যপূর্ণ পাঠ রাখা যাবে না, যাতে মানসিকভাবে ছেলেটি মেয়েটিকে নিজের চেয়ে কম মর্যাদার মনে করে। শিক্ষক যখন পড়াবেন, তাকে এ বিষয়ে মনোযোগী হতে হবে’- বলেন তিনি।
সেলিনা হোসেন
বাংলাদেশ শিশু একাডেমির সভাপতি সেলিনা হোসেন নিপীড়িতের মানসিক ট্রমার বিষয়টি নিয়ে বেশি উদ্বিগ্ন। তিনি বলছেন, নির্যাতিতার পুনর্বাসনের বিষয়টি খুব বেশি জরুরি।
‘নিপীড়িতের ট্রমা থেকে মুক্তির ব্যবস্থা নেই সমাজে। পরিবার থেকে শুরু করে সমাজের সর্বত্রই সে বৈষম্যের শিকার হয়। অথচ ঘটনার দায় তার নয়। সমাজ ও প্রশাসন তার কাছে ক্ষমা চাওয়ার বদলে তার সঙ্গে খারাপ আচরণ করে। এসব কারণে মেয়েরা পিছিয়ে থাকছে, অভিভাবকরা পিছিয়ে রাখছে, দায়ীরা সাহসী হচ্ছে’- বলেন তিনি।
সেলিনা হোসেন বলেন, পরিবারে ছেলে সন্তানটির অপরাধ মার্জনা করে, মেয়েটিকে বিভিন্ন বিষয়ে দায়ী করার প্রবণতা দেখা যায়। এভাবে ছেলেটি পরিবার থেকে ভুল শিক্ষা পাচ্ছে, মেয়েটিও আত্মমর্যাদা বুঝতে পারছে না। সন্তানদের সামাজিকীকরণ ও বিকাশে সমস্যা হলে অপরাধী হয়ে উঠতে পারে- এটা মা-বাবাকে বুঝতে হবে। অপরাধের দায়ও শুধু অপরাধীর নয়, পুরো সিস্টেমের মধ্যে দায়ী অনেকেই।
সালমা আলী
বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক অ্যাডভোকেট সালমা আলী বাংলানিউজকে বলেন, শুধু সেপ্টেম্বরেই রাজধানীতে ওসিসি’তে (ওপেন ক্রাইসিস সেন্টার) মামলা হয়েছে ৪১টি, যার মধ্যে ধর্ষণের ঘটনাই বেশি। যৌন নির্যাতনের ঘটনাগুলো মামলা পর্যন্ত অনেক সময়ই আসে না, আপোস করে ফেলা হয় টাকার বিনিময়ে বা হুমকিতে। এভাবে অপরাধ আরও বেড়ে যাচ্ছে।
বিশিষ্ট এই আইনজীবী বলেন, সমাজে বিকারগ্রস্ত মানুষের যৌন লালসার শিকার হচ্ছে মেয়েরা। এমনকি কেউ কেউ নিজের বাবা-ভাই, মামা-চাচার কাছেও নিরাপদ নয়। একটি শিশু যখন যৌন নিপীড়নের শিকার হচ্ছে, সে জানতেই পারছে না, তার সঙ্গে কী ভয়াবহ অন্যায় হচ্ছে। মা বা অন্য স্বজনরা জানার পর গোপন করেন, আলামত নষ্ট করেন। কিন্তু ভাবেন না যে, শিশুটি সারাজীবন এ ঘটনার রেশ টানবে।
সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট হাসিনা রশিদ বলেন, যৌন হয়রানি বা ধর্ষণ ঘটনার পরে কী করা উচিত অনেকেই জানেন না। ধর্ষিতাকে গোসল করানো হলে অনেক আলামত নষ্ট হয়ে যায়। প্রমাণ করা মুশকিল হয়। অনেক অভিভাবক ভাবেন, যা হওয়ার হয়েছে, লোক জানাজানি বা মামলা করে লাভ নেই। তার চেয়ে দায়ী ব্যক্তি টাকা দিতে চাচ্ছে, নিয়ে চুপ থাকি। এসব সমস্যা মোকাবেলা করতে হয়।
তাদের সংগঠন ছাড়াও অপরাজেয় বাংলা, আল নাহিয়ান, নির্মল আশ্রয়কেন্দ্র, এসওএসের নিজস্ব শেল্টার হোম রয়েছে। কিন্তু আরও অনেক প্রয়োজন। আর্থিক সমস্যাসহ বিভিন্ন কারনে শেল্টার হোম বাড়ছে না সেভাবে। এ বিষয়ে সমাজের স্বচ্ছলরা এগিয়ে এলে ভালো হয়- বলেন তিনি।
সংগঠনের সহ সভাপতি অ্যাডভোকেট সীমা জহুর বলেন, মা-বাবারা নিশ্চয়ই চান না, তাদের ছেলে বখে যাক বা মেয়ে হয়রানির শিকার হোক। তাই জন্মের পর থেকেই একটু একটু করে তাদের বিকাশে যত্নশীল হতে হবে।
ইনসিডিন’র সেন্ট্রাল ইনচার্জ লায়লা কামাল অবশ্য হতাশ হন না। তিনি বলেন, প্রতিবাদ করতে শিখেছেন সমাজের অনেকেই। তাই আশা করি, এরপরের পদক্ষেপগুলোও নেওয়া যাবে। বন্ধ হবে যৌন হয়রানির মতো বিকৃতি।
বাংলাদেশ সময়: ০৮৩০ ঘণ্টা, অক্টোবর ৩০, ২০১৫
এসকেএস/এএসআর