ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

আলো হাতে চলিয়াছি 

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৪০৭ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৫, ২০১৮
আলো হাতে চলিয়াছি  অধ্যাপক ড. এএইচএম মোস্তাফিজুর রহমান, উপাচার্য, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় 

শুরু থেকেই বিভিন্ন সংকট নিয়ে পথচলা জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের। তবে সব সমস্যাকে সম্ভাবনায় পরিণত করে বিশ্ববিদ্যালয়টিকে উচ্চশিক্ষার রোল মডেলে পরিণত করার স্বপ্ন নিয়ে যাত্রা শুরু করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়টির পঞ্চম ভাইস-চ্যান্সেলর সমাজবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. এএইচএম মোস্তাফিজুর রহমান। 

তিনি এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে এই বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ে তার স্বপ্নের কথা বলেছেন। বাংলানিউজের পক্ষে টেলিফোনে সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন ড. শাখাওয়াৎ নয়ন।

 

একজন নবনিযুক্ত উপাচার্য হিসেবে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে ড. এএইচএম মোস্তাফিজুর রহমানের মূল্যায়ন কেমন জানতে চাইলে তিনি বলেন, এই বিশ্ববিদ্যালয়টি বয়সে নবীন, মাত্র এগারো বছরে পা দিয়েছে। শিশু-কিশোররা যেমন নানা রকম মরবিডিটিতে ভোগে, তেমনি এই বিশ্ববিদ্যালয়টিও নানা সমস্যায় ভুগছে। এ অবস্থায় প্রয়োজন একজন দূরদৃষ্টি সম্পন্ন শিক্ষাবিদের, যিনি হবেন একই সঙ্গে একজন দক্ষ প্রশাসক এবং স্বপ্নদ্রষ্টা একাডেমিক। আমি জানি না, আমার মধ্যে তেমন গুণাবলী আছে কি না? তবে মাননীয় রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা, স্থানীয় সুধীজন এবং রাজনৈতিক এলিটরা আমাকে এই মহান দায়িত্ব দিয়েছেন। আমি আনন্দের সঙ্গে তা গ্রহণ করেছি। এরই মধ্যে এই বিশ্ববিদ্যালয়টি বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের মানুষের শিক্ষা, সংস্কৃতির কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হতে শুরু করেছে। এই অগ্রগতি অব্যাহত থাকলে এবং আরো কিছু প্রয়োজনীয় সময়োপযোগী পদক্ষেপ নিতে পারলে, উচ্চশিক্ষা ও গবেষণায় আমরা দ্রুতই ঈপ্সিত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারবো।

এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন সমস্যাকে প্রধান সমস্যা বলে মনে করেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, এই বিশ্ববিদ্যালয়ে যেমন প্রধান প্রধান সমস্যা আছে, তেমনি অনেক অনেক সম্ভাবনাও আছে। আমি সাধারণত সম্ভাবনার কথা বলতে পছন্দ করি। স্বপ্ন দেখতে এবং দেখাতে ভালোবাসি। সমস্যাকে সমস্যা হিসেবে দেখি না, চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিতে পছন্দ করি। দায়িত্ব গ্রহণের আগে উপস্থিত সবার কাছে একটু সময় চেয়ে নিয়ে আমার গর্ভধারিণী মাকে ফোন করে দোয়া চেয়েছি। বলেছি, মা তুমি আমাকে দোয়া করো, আমি এই মহান দায়িত্ব নিতে যাচ্ছি। তিনি আমাকে অনুমতি দিয়েছেন। মায়ের দোয়া নিয়ে শুরু করেছি। আমি বিশ্বাস করি, যার সঙ্গে মায়ের দোয়া আছে, তার জন্য কোনো সমস্যাই সমস্যা নয়। তবে একজন উপাচার্য হিসেবে যোগদানের পরপরই আমার জন্য প্রধান চ্যালেঞ্জ ছিল, সম্পূর্ণ দুর্নীতিমুক্ত একটি ভর্তি পরীক্ষার ব্যবস্থা করা। আমার যোগদানের মাত্র পাঁচদিনের মধ্যে ভর্তি পরীক্ষার তারিখ নির্ধারিত ছিল। শুভাকাঙ্ক্ষীদের মধ্যে অনেকেই আমাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন, ভর্তি পরীক্ষা একটু পিছিয়ে দেয়া যায় কি না? কারণ এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিগত দশ বছরে বার বার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে; লাখ লাখ টাকার ভর্তি বাণিজ্য হয়েছে, দুর্নীতি হয়েছে। যা বন্ধ করা ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। আমি সেই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছি। প্রায় ৩৯ হাজার ছাত্র-ছাত্রীদেরকে কোনো ভোগান্তিতে আমি ফেলতে পারি না। তাই একদিনও না পিছিয়ে আমরা সম্পূর্ণ দুর্নীতিমুক্ত একটি ভর্তি পরীক্ষার ব্যবস্থা করতে পেরেছি। যা আগে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটেনি। সম্প্রতি বাংলাদেশে প্রশ্নপত্র ফাঁস হবার ঘটনা একটি মারাত্মক সমস্যায় পরিণত হয়েছে। আমি দ্ব্যর্থহীনভাবে বলতে চাই, আমার অধীনে অনুষ্ঠিত ভর্তি পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়নি। ভর্তি বাণিজ্য হয়নি। এটাই আমার প্রথম সফলতা। আর এটা সম্ভব হয়েছে আমার সহকর্মীদের আন্তরিক সহযোগিতার কারণে। তাছাড়া কোনোভাবেই সম্ভব হতো না। আমি তাদের সবাইকে কৃতজ্ঞতা এবং আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি।  
  
অধ্যাপক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল সব বিশ্ববিদ্যালয়ে অভিন্ন ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তাব করেছিলেন, এ ব্যাপারে ড. এএইচএম মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, এটি একটি সময়োপযোগী প্রস্তাবনা। আমি অবশ্যই নীতিগতভাবে এর সঙ্গে একমত পোষণ করি। তবে আমার আরো স্পেসিফিক প্রস্তাবনা হচ্ছে, বিষয়টি হতে হবে আরো বেশি স্পেসিফিক। যেমন, সব বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান অনুষদের জন্য একটি অভিন্ন প্রশ্নপত্র এবং পরীক্ষা, কিংবা সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের জন্য একই দিনে অভিন্ন প্রশ্নপত্র এবং পরীক্ষা, আবার কলা কিংবা বাণিজ্য অনুষদের জন্য একই নিয়ম অনুসরণ করা যেতে পারে। তাহলে ছাত্র-ছাত্রী এবং তাদের অভিভাবকদের অনেক দুর্ভোগ লাঘব হবে।  

একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে মাত্র একটি উপাচার্য এবং একটি উপ-উপাচার্য পদ। কিন্তু অনেকেরই এই মর্যাদাবান পদ পাওয়ার স্বপ্ন থাকে। ফলে তারা যে কোনোভাবে ওই পদাধিকার করতে চায়। আমরা জানি, অস্ট্রেলিয়া কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষদ ভিত্তিক প্রো-ভিসির পদ আছে। প্রো-ভিসি হিসেবে কাজের অভিজ্ঞতা ছাড়া এসব দেশে কেউ ভিসি হতে পারে না। এতে প্রো-ভিসি হিসেবে তারা ভালো কাজ করে, সুনাম অর্জন করার চেষ্টা করে। অন্যদিকে, পরে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও অভিজ্ঞ ভিসি পায়। আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভিসি খেদাও আন্দোলনের সঙ্গে অনেক সময় পদ প্রত্যাশী কোনো না কোনো শিক্ষক জড়িত থাকেন। এটি একটি প্রশাসনিক কাঠামোগত সমস্যা কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন,   আমি মনে করি, প্রো-ভিসি’র রাখাটা ভালো ব্যবস্থা। আমাদের দেশেও এরকম ব্যবস্থা থাকা দরকার। বেশি যদি না-ও হয়, অন্তত দু’জন প্রো-ভিসি থাকা উচিত। একজন প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করবেন, আরেকজন একাডেমিক দিকগুলো দেখবেন।  

ধরা যাক কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩০০টি ক্লাস রুম আছে। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে মাত্র তিন/চার ঘণ্টা রুমগুলো ব্যবহার করা হয়। বাকি প্রায় ২০ ঘণ্টা তালাবদ্ধ থাকে। অন্যদিকে সীমিত আসন সংখ্যার কারণে দেশের লাখ লাখ ছাত্র-ছাত্রী স্বল্প খরচে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পাচ্ছে না। অথচ খুব সহজেই একাধিক শিফট চালু করে প্রায় দ্বিগুণ সংখ্যক ছাত্র-ছাত্রীকে ভর্তি করা সম্ভব। থাইল্যান্ডে প্রাইমারি স্কুলগুলো পর্যন্ত সাপ্তাহিক ছুটির দিনে এবং নৈশকালীন কারিগরি শিক্ষাসহ বিভিন্ন কাজে ব্যবহৃত হয়। তারা সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার করছে। সে ক্ষেত্রে কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পদ সঠিকভাবে ব্যবহার হচ্ছে কি না জানতে চাইলে ড. এএইচএম মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, আমার মনে হয়, এটি একটি ভালো প্রস্তাব। সে ক্ষেত্রে শিক্ষক সংখ্যাও বাড়াতে হবে। একটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন, আমাদের ক্লাসরুমে এতো বেশি ছাত্র-ছাত্রী থাকে যে শিক্ষকরা সঠিকভাবে পাঠদান করতে পারেন না। একটি ক্লাসরুমে ২৫/৩০ জনের বেশি ছাত্র-ছাত্রী থাকা উচিত নয়। শিক্ষক যদি ছাত্রের সঙ্গে সরাসরি ইন্টার‌্যাক্ট করতে না পারেন, তাহলে পড়াবেন কীভাবে? 

এই বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে নিজের স্বপ্ন ও পরিকল্পনা সম্পর্কে ড. এএইচএম মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, এই বিশ্ববিদ্যালয়টি হবে আলোকিত বাংলাদেশের সূতিকাগার। এটি হবে ল্যান্ড অফ মোর‌্যাল কাল্টিভেশন, প্লেস অফ ইনোভেশন অ্যান্ড ডিস্কভারি, ফ্যাক্টরি ফর প্রোডিউসিং ফিউচার লিডারস। এখানে আমি একজন টর্চ বেয়ারার মাত্র। আমার কাজ আলোর পথ দেখানো। আলো হাতে চলিয়াছি...।  

বাংলাদেশ সময়: ১০০১ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৫, ২০১৮
এসআই

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।