ঢাকা, শুক্রবার, ১৬ মাঘ ১৪৩১, ৩১ জানুয়ারি ২০২৫, ০০ শাবান ১৪৪৬

জাতীয়

এপারে ভালো আছি, তারপরও ফিরে যেতে চাই

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৩৫৩ ঘণ্টা, আগস্ট ২৫, ২০১৮
এপারে ভালো আছি, তারপরও ফিরে যেতে চাই নির্যাতনের মুখে গত বছর এভাবেই সাগর পাড়ি দিয়ে লাখও রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করে (ফাইল ছবি)

কক্সবাজার: ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মধ্যরাত। মিয়ানমারের রাখাইনদের উপর নেমে আসে নির্মম নির্যাতন। সেদিন রাতে সেদেশের সেনাবাহিনী গুলি করে অথবা পুড়িয়ে হত্যা করে অসংখ্য রোহিঙ্গা নারী, পুরুষ ও শিশুকে। হাজারও কিশোরী, তরুণী ও যুবতী ধর্ষণের শিকার হয়। এমন নির্মম পরিস্থিতিতে জীবন বাঁচাতে মাতৃভূমি ছেড়ে পালিয়ে আসে লাখও রোহিঙ্গা।

দিনের পর দিন হেঁটে, কাঁধে চড়ে, পাহাড় জঙ্গলে লুকিয়ে থেকে, নৌকা কিংবা ভেলায় চড়ে উত্তাল সাগর পাড়ি দিয়ে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে আশ্রয় নেয় প্রায় সাড়ে ৭ লাখ রোহিঙ্গা। মিয়ানমারে নিপীড়নের মুখে গত কয়েক দশকে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়ে আছে আরও প্রায় সাড়ে তিন লাখ রোহিঙ্গা।

উখিয়া ও টেকনাফের ৩০টি ক্যাম্পে বাস করছে প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গা।  

এপারে পার হয়ে পেয়েছে তারা খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান ও চিকিৎসার নিশ্চয়তা। কিন্তু জীবন বাঁচাতে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা এপারে বাস্তুচ্যুত জনগোষ্ঠী হিসেবে আশ্রয় নেওয়ার পর থেকে প্রহর গুণছে নিজ জন্মভূমি রাখাইনে ফিরে যাওয়ার। নিরাপদে নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার অপেক্ষায় থাকতে থাকতেই কেটে গেছে একটি বছর। কিন্তু শুরু হয়নি প্রত্যাবাসন। এরইমধ্যে বছর ঘুরে আবারও এসেছে ২৫ আগস্ট।  নিজ দেশে ফিরে যেতে চায় রোহিঙ্গারা-ছবি-বাংলানিউজসেদিনের সেই দুঃসহ স্মৃতিকে স্মরণ করে এবারের ২৫ আগস্ট শোক দিবস কিংবা কাল দিবস হিসেবে পালন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাস্তুচ্যুতরা। নিরাপদে স্বদেশে ফিরে যাওয়ার দাবিতে বিক্ষোভ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে রোহিঙ্গারা।  
 
এ বিষয়ে কুতুপালং-২ এ বসবাসকারী রোহিঙ্গা নারী মর্জিনা বলেন, আমরা এখানে ভালো আছি। বাংলাদেশ সরকার সব কিছু দিচ্ছে, তারপরও নিজ দেশে ফিরে যেতে চাই।
 
বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পের হাসান আলী বলেন, এদেশ আমাদের চাওয়ার চেয়ে বেশি দিয়েছে। শুধু থাকা-খাওয়া নয় বাংলাদেশ আমাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে। বাচ্চাদের জন্য শিক্ষা, আমাদের জন্য চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছে। আমরা এদেশের কাছে সবসময় ঋণী থাকবো। এত কিছু পাওয়ার পরও আমরা নিজ ভূমিতে ফিরতে চাই।
 
এক বছর আগে রাখাইনের বুচিদং থেকে পালিয়ে আসা শামসু বলেন, পরদেশে আশ্রিত হিসেবে রয়েছি এক বছর হলো। এই সময়ে প্রতিক্ষণ চিন্তা করেছি কখন নিজ দেশে ফিরে যাবো। আমাদের নাগরিক অধিকার ফিরিয়ে দিলেই আমরা চলে যাব।
 
কতুপালং ‘ই’ ব্লকের নারী মাঝি হাসিনা বেগম বলেন, রাখাইনের মুংড়ুর দক্ষিণে আমাদের গ্রাম। রাতের আঁধারে সেই গ্রামে ধ্বংসযজ্ঞ চালায় সেনাবাহিনী। গ্রামে আগুন ধরিয়ে দেয় তারা। পালাতে গিয়ে পথে আমার মা ও এক বোন মারা গেছে। পরিবার নিয়ে আটদিন পর আমরা এদেশে প্রবেশ করি। সেই থেকে এখানে রয়েছি। এপারে খাবারের চিন্তা কিংবা রাতের আঁধারে হামলার চিন্তা নেই সত্য। তারপরও আমরা চাই নিরাপদে নিজ দেশে ফিরে যেতে।
 
এদিকে রোহিঙ্গার নিরাপদ প্রত্যাবাসনের লক্ষ্যে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে চুক্তি হলেও এখন পর্যন্ত একজন রোহিঙ্গাও ফিরে যেতে পারেনি। বরং এখনও রোহিঙ্গারা মিয়ানমার থেকে আসছে। তাই প্রত্যাবাসন নিয়ে চিন্তিত রোহিঙ্গারা।
 
টেকনাফের লেদা ক্যাম্পে অবস্থানরত মিয়ানমারে মুংড়ুর বলি বাজারের মাহবুব বলেন, আমরা আন্তর্জাতিক সংস্থার সহযোগিতায় মিয়ানমারে ফিরে যেতে চাই।  
 
এ বিষয়ে রোহিঙ্গাদের দলনেতা ডা. জাফর আলম বলেন, আমাদের ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য আন্তর্জাতিক চাপে বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি করেছে মিয়ানমার সরকার। কিন্তু চুক্তির শর্ত বাস্তবায়ন করছে না অং সান সুচি। আসলে মিয়ানমার টালবাহনা করছে আমাদের ফিরিয়ে নিতে। তারা ফিরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ না নিয়ে উল্টো সীমান্তে নিরাপত্তা বাড়াচ্ছে, ভারী অস্ত্র আনছে। এছাড়া রাখাইনে থাকা অনেক রোহিঙ্গাকে বাধ্য করছে এদেশে প্রবেশ করতে। মিয়ানমার সামরিক জান্তা সরকার সব সময় ভোল পাল্টাচ্ছে। আমরা কিছু চাই না আমরা নাগরিক অধিকার নিয়ে স্বদেশে ফিরে যেতে চাই।
 
নাম প্রকাশ না করার শর্তে মধুরছড়া ক্যাম্পের এক মাঝি বলেন, বছর ঘুরে চলে এলো সেই কালদিন। এ দিনটিকে আমরা কালদিবস হিসেবে পালন করবো। শনিবার (২৫ আগস্ট) আমরা সব ধরনের কাজকর্ম থেকে বিরত থাকবো। ঘরে রান্নাবান্নাও হবে না।  

তিনি আরও বলেন, দিনটি উপলক্ষে আমরা বিক্ষোভ ও মানববন্ধন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ৩০টি ক্যাম্পের সব ব্লকেই ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে শান্তিপূর্ণভাবে আমরা নিরাপদ প্রত্যাবাসনের দাবিতে কর্মসূচি পালন করবো।
 
রোহিঙ্গা প্রতিরোধ কমিটির সাধারণ সম্পাদক নুর মোহাম্মদ সিকদার বলেন, বহির্বিশ্বের চাপে পড়ে মিয়ানমারের সরকার ও সামরিক জান্তা ইতোমধ্যে কিছুটা নমনীয় হলেও তারা তাদের কৌশলগত অবস্থান থেকে এক চুলও সরেনি। যে কারণে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার বিষয়ে অগ্রগতি আশাব্যঞ্জক নয়।

উখিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ নিকারুজামান বলেন, শনিবার রোহিঙ্গারা নিরাপদ প্রত্যাবাসনের দাবিতে বিক্ষোভ করতে পারে বলে আমাদের কাছে খবর রয়েছে। সেজন্য ক্যাম্পের ভেতর ও বাইরের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সেখানে অতিরিক্ত পুলিশ, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও সেনাবাহিনী দায়িত্ব পালন করবে।

শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) মোহাম্মদ আবুল কালাম বলেন, মিয়ানমার প্রতিশ্রুত পদক্ষেপ দেখার অপেক্ষায় আছি আমরা। আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের জন্য প্রাথমিকভাবে সরকার তিন বছরের পরিকল্পনা নিয়েছে। আন্তর্জাতিক মহল রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের পাশে থাকবে এই সময়ে এমনটাই কামনা করি।
 
বাংলাদেশ সময়: ০৯৫২ ঘণ্টা, আগস্ট ২৫, ২০১৮
টিটি/আরআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।