নদীটির সিংহ ভাগই এখন দখলদারদের কবলে। এতে নাব্যতা হারিয়ে নদীটি এখন মৃত প্রায়।
তবে, দখলদারদের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নেয়নি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। অনেকেই এক সময়কার প্রমত্তা মরিচ্চাপ নদীর নাম বদলে নালা বলতে শুরু করেছেন। এখনই এ ব্যাপারে পদক্ষেপ না নিলে ক’দিন পর তাও অবশিষ্ট থাকবে না বলে আশঙ্কা এলাকাবাসীর।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, প্রবাহহীন সামান্য পানি নিয়ে মরিচ্চাপ নদীর সাক্ষ্য দিচ্ছে নালাটি। দেবহাটা থেকে সাতক্ষীরা সদর উপজেলার মধ্য দিয়ে আশাশুনি উপজেলা পর্যন্ত বিস্তৃত ৩৭ কিলোমিটার দীর্ঘ মরিচ্চাপের পুরোটাই চলে গেছে দখলদারদের কবলে। বিলশিমুলবাড়িয়া, বালিথা, চরবালিথা, এল্লাচর, ফিংড়ী, ব্যাংদহ, টিকেট, কামালকাটি, নইহাটি গ্রামের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত নদীর দু’ধারে চলছে দখলের মহোৎসব। মূল নদীর দু’ধারে বেড়ির মধ্যে নির্মাণ করা হয়েছে অসংখ্য পাকা-কাঁচা বাড়ি, ধর্মীয় স্থাপনা, ব্যবসায়ীক প্রতিষ্ঠান, ইটেরভাটা, মুরগির খামার, ঘেরসহ বিভিন্ন স্থাপনা।
স্থানীয়দের অভিযোগ, নদীটি খননের নামে চলছে মেরে ফেলার উৎসব। খননের সময় নদীর মধ্যভাগ থেকে মাটি তুলে নদীর মধ্যেই দু’পাশে বেড়ির উপর রাখা হয়েছে। এতে ৮-১০ মিটারের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে নদীটি।
নদী তীরবর্তী এলাকাবাসী জানান, এক সময় মরিচ্চাপ ছিলো খরস্রোতা। এতে নিয়মিত জোয়ার-ভাটা হতো। মরিচ্চাপ ছিলো স্থানীয়দের জীবন-জীবিকার উৎস। এই নদী দিয়ে চলতো বড় বড় লঞ্চ-স্টিমার, পাল তোলা নৌকা। আর এই নদী দিয়ে সাতক্ষীরাসহ বিভিন্ন এলাকার মানুষ কলকাতায় যেতো ব্যবসা-বাণিজ্য করতে। আশাশুনি, দেবহাটা এবং সদরের বিভিন্ন এলাকায় যাওয়ার অন্যতম প্রধান পথ ছিলো এই নদী।
বিশেষ করে সাতক্ষীরা শহরে আসতে এই নদীই ছিলো প্রাণসায়ের খালে প্রবেশের পথ। খুলনাসহ বিভিন্ন এলাকার ব্যবসা-বাণিজ্যের রুট ছিলো এটি। নদীটির সাতক্ষীরা সদরের এল্লারচরে ছিলো স্টিমার ঘাট। ভাঙা-গড়ার দৃশ্য দেখা যেত নদীর দু’পাড়ে। দু’ধারে নদীকে কেন্দ্র করে বিস্তৃত ছিলো ফসলের মাঠ। নদীতে রাত-দিন মাছ ধরে সংসার চালাতো তীরবর্তী মানুষ। এছাড়াও অনেক জায়গায় খেয়াঘাট ছিল। কিন্তু আজ সবই স্মৃতি। স্থানীয়রা জানায়, বছর সাতেক আগে পানি উন্নয়ন বোর্ডের তত্ত্বাবধানে নদীটি খননের কাজ করা হয়। ওই সময় অপরিকল্পিকতভাবে নদী খননের সেই মাটি নদীর মধ্যেই ফেলে বেড়িবাঁধ উঁচু করা হয়। খননের সময় নদীর ভেতর থেকে মাটি তুলে নদীর দু’ধারের ১০ মিটার জায়গা উঁচু করায় ১০ মিটারের বাইরে নদীর যে জায়গা ছিলো তা খুব দ্রুত দখল হয়ে যায়। এখন নদীটি কোথাও কোথাও সরু নর্দমায় পরিণত হয়েছে।
এছাড়া ষাটের দশকে নদীটির বাকে বাকে অপরিকল্পিতভাবে স্লুইস গেট করায় খালগুলোর পানি প্রবেশ ও পানি বের হতে না পারায় জোয়ারে আসা পলি নদীর বুকে জমে যাওয়ায় নাব্যতা হারায় নদীটি। ফলে এখন আর জোয়ার-ভাটা হয় না। তার উপর আবার নেট-পাটা ও অবৈধ বাঁধ দিয়ে মাছ চাষ করা হচ্ছে।
ফিংড়ী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. সামসুর রহমান বাংলানিউজকে জানান, নদীর অধিকাংশ জায়গা দখল হয়ে গেছে। তার অভিযোগ ভূমি অফিসের কিছু কর্মকর্তার কারণে এটা হয়েছে। নদীটি খননে যদি ইউনিয়ন পরিষদকে দায়িত্ব দিয়ে এলাকার মানুষ দিয়ে করা হয় তবে কিছুটা কাজ হবে। আর নদীর জায়গা দখল থেকে রক্ষা পেতে সরকারিভাবে নির্দিষ্ট জায়গা নির্ধারণ করে দিতে হবে।
সাতক্ষীরা নদী বাঁচাও আন্দোলন কমিটির নেতা অধ্যক্ষ আশেক-ই-এলাহী বাংলানিউজকে জানান, মরিচ্চাপ নদীটি দখল হয়ে গেছে। এটা এখন মরা খাল। এটা রক্ষায় তেমন কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। নদী দখল মুক্ত করতে নদীর জায়গা মাপ করা দরকার। কিন্তু পানি উন্নয়ন বোর্ডসহ সংশ্লিষ্ট প্রশাসন এটা কখনো করেনি। মরিচ্চাপ রক্ষা করতে দ্রুত উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
এ ব্যাপারে সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড-১ এর উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী রাশিদুর রহমান বাংলানিউজকে জানান, নদী পাড়ের জমি আমাদের না। এটা জেলা প্রশাসনের আওতায়। তাই এই জায়গা রক্ষা করার দায়িত্ব তাদের। তবে আমরা নদীটি খননের জন্য একটা প্রকল্প তৈরি করে মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি। পাস হলে খুব দ্রুত খননের কাজ শুরু হবে।
বাংলাদেশ সময়: ০১৩০ ঘণ্টা, আগস্ট ২৮, ২০১৮
আরএ