আবার এখান থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরের মুক্তাগাছা উপজেলার তারাটি ইউনিয়নের বাজারটিও মুক্তিযুদ্ধের সময়ে প্রেরণা সঞ্চারী স্লোগান ‘জয় বাংলা’ থেকেই নামকরণ। দু’টি বাজারই এখন স্ব স্ব এলাকার গর্ব ও ঐতিহ্য।
সেই কথাই জানালেন স্থানীয় চর গোবিন্দপুর গ্রামের ৮৫ বছরের বৃদ্ধ হাজী আফতাব উদ্দিন। একাত্তরে তার বয়স ছিল ৩৫ বছর। মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোর স্মৃতি সব সময় তার চোখে ভাসে। সম্প্রতি নিজ বাড়িতে বসে বাংলানিউজের সঙ্গে কথা হয় তার।
তিনি বলতে থাকেন, ‘কী দিন ছিল। সারাক্ষণ ভয়। এই বুঝি পাঞ্জাবিরা আসলো। এই বুঝি বম্বিং হবে। সতর্ক মানুষজন। ঘর ছেড়ে বাজারে যাওয়া হতো শত্রু-সেনাদের খোঁজ খবর নিতে। গতিবিধির ওপর নজর রাখতে। ’
হাজী আফতাব যেন স্মরণ করার চেষ্টা করলেন তখনই, কে যেন বাজারটির নামকরণ করলো ‘জয় বাংলা’ বাজার। বললেন, সংগ্রামের সময়েই বাজারটার নাম হয়ে গেলো ‘জয় বাংলা’ বাজার।
সংগ্রাম। সংগ্রাম বলতে মুক্তিযুদ্ধের উত্তাল দিনগুলোর কথা বুঝালেন হাজী আফতাব। আব্দুর রহমান (৫২), আমিনুল ইসলাম (৩৫), চাল ব্যবসায়ী ফকর উদ্দিনসহ (৫৫) আরো অনেকের কথা- জয় বাংলা বাজারটি মুক্তিযুদ্ধের সময়ের এলাকার ইতিহাস, অবস্থান ও স্মৃতি। যা নতুন প্রজন্মের কাছে স্মারক। ফিরে দেখা একাত্তর।
ময়মনসিংহ জেলা শহরের কাচারী ঘাটের ঠিক ওপারেই জয় বাংলা বাজারের রাস্তা। ব্রহ্মপুত্রের উভয় পাশে প্রায় এক কিলোমিটার দূরের বাজার। চর সিরতা ইউনিয়নের ‘জয় বাংলা’ বাজারটির বৈশিষ্ট্য হলো- এর পার্শ্ববর্তী স্থানকেই সরকার ময়মনসিংহ বিভাগীয় শহর হিসেবে বেছে নিয়েছে।
অদূর ভবিষ্যতে ময়মনসিংহ বিভাগ সদর সংলগ্ন স্থানে পরিণত হবে জয় বাংলা বাজার। জনপ্রত্যাশা রয়েছে বিভাগীয় সদরের নতুন নামকরণে ‘জয় বাংলা’ নামটির প্রস্তাবনা ও বিবেচনার জন্য।
চর আনন্দীপুর, চর ভবানীপুর ও চর গোবিন্দপুর। চরাঞ্চলের তিন গ্রামের সংযোগস্থলেই জয় বাংলা বাজার। চর সিরতা ইউনিয়নের জয় বাংলা বাজারের এক কিলোমিটার উত্তরে চর আনন্দীপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও এক কিলোমিটার পশ্চিমে চর ভবানীপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, এতথ্য তুলে ধরেন বরকত উল্লাহ সানি নামের এক তরুণ।
এই বাজারটিকে কেন্দ্র করে চাঙ্গা হয়ে ওঠেছে গ্রামীণ অর্থনীতি। ময়মনসিংহ শহরের অদূরের এলাকাটি এক সময় হয়তো মহানগরের আওতাভুক্ত হতে পারে।
স্থানীয় চরাঞ্চলের এই সমৃদ্ধ বাজার (জয় বাংলা) ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসারে ৪৭ বছরে অনেক দূর এগিয়েছে। ধান, চাল থেকে শুরু করে কাপড়ের দোকান, ফার্নিচার, ফ্রিজ, টেলিভিশন, ক্রোকারিজসহ সব ধরনের দোকান রয়েছে বাজারটিতে।
মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকজন নিজেদের বিজয় বা উল্লাস প্রকাশ করতে মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের আগ মুহুর্তে বাজারটির নামকরণ করেন ‘জয় বাংলা’। এই বাজারের ব্যবসায়ীসহ সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ‘জয় বাংলা’ তাদের আবেগ। এলাকায় দলমত নির্বিশেষে মানুষ এই বাজারের নাম নিয়ে গর্ববোধ করেন।
স্থানীয় তারাটি ইউনিয়নের শশা নলজুড়া গ্রামের হযরত আলী (৬০) বাংলানিউজকে বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় মুরব্বিরা বাজারটির নাম দেওয়ার সময় মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে কাজে লাগিয়েছেন। সরকার পরিবর্তন হলেও এই নাম থেকে যায়। এমনকি আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য সরকারের সময়েও কেউ এই বাজারের নাম নিয়ে প্রশ্ন বা আপত্তি তুলেনি। ’
‘এ অঞ্চলের মানুষের মাঝে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি এবং চেতনা প্রগাঢ় ছাপ ফেলেছিল যে তারা নতুন একটি বাজারের নাম দিয়েছিলেন আবেগঘন এক শব্দ ‘জয় বাংলা’ থেকে। তারপর তিলে তিলে বাজারটি গড়ে ওঠেছে। এখন সেটি গ্রামীণ জমজমাট এক বাজার।
ক্রমাগত উন্নয়নের পথে যাচ্ছে জয় বাংলা বাজার। এখন সেখানে মনোহারী, চা স্টল, সার, বীজ, কাপড়ের দোকান সবই রয়েছে। এই বাজারের নামকরণের প্রস্তাবকের একক কৃতিত্ব নেই কারো। এই কৃতিত্ব গোটা এলাকাবাসীর’ বলে যাচ্ছিলেন স্থানীয় ফ্লেক্সিলোড ব্যবসায়ী গোলাম মোস্তফা (৪৫)।
তিনি বলেন, এখানকার ব্যবসায়ীদের মধ্যেও রয়েছে ঐক্য। এলাকাটি রাজনীতি সচেতন। এখানে বেড়েছে শিক্ষার হার। নারী ও সমাজ উন্নয়নেও চরাঞ্চল অগ্রসরমান।
তাকে সমর্থন দিয়ে স্থানীয় শশা নলজুড়া গ্রামের মফিজুল ইসলাম (৪৫), দর্জি সাইফুদ্দিন (৪০) ও বিল্লাল উদ্দিন (৫০) বাংলানিউজকে জানান, এখানকার গ্রামের লোকজনের সচেতনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার স্বপক্ষের আবেগের বহিঃপ্রকাশ জয় বাংলা বাজার। এই নাম এখন একটি ইতিহাস এবং একটি বিস্ময়!
বাংলাদেশ সময়: ০৮৫৭ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১০, ২০১৮
এমএএএম/আরএ