পূজাকে সামনে রেখে এখন ব্যস্ত সময় পার করছেন খুলনার সাতটি প্রতিষ্ঠানের বাদ্যযন্ত্র কারিগররা। এক সময় খুলনা মহানগরীতে প্রায় অর্ধশত প্রতিষ্ঠান থাকলে এখন মাত্র সাতটি প্রতিষ্ঠান টিকে রয়েছে।
সোমবার (৮ অক্টোবর) দুপুরে খুলনা মহানগরীর স্যার ইকবার রোডের তবলা বিতান, সৃষ্টি তবলা তরঙ্গ ও জয় বাদ্য বিতান সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, প্রতিটি বাদ্যযন্ত্র তৈরির দোকানেই ঢাক-ঢোল তৈরিতে ব্যস্ত কারিগররা। একদমই দম ফেলার ফুরসত নেই কারোর। কাঠের খুটখাট শব্দে মুখর দোকানগুলো। ঢাক-ঢোলের জন্য খোল তৈরি, রং করা, চামড়া লাগানো এবং মেরামতে ব্যস্ত দেখা গেল বেশিরভাগ কারিগরদের। ব্যস্ততার মধ্যেই কথা হয় কারিগরদের সঙ্গে।
ঢাক-ঢোল তৈরির কারিগররা জানান, পূজাতে ঢাক-ঢোলের বাজনা অপরিহার্য। কারণ হিন্দুশাস্ত্রেও এর ব্যবহারের উল্লেখ রয়েছে। তাই ঢাক-ঢোল ছাড়া পূজা-অর্চনার কথা ভাবাই যায় না। তবে বর্তমান সময়ে আধুনিক যন্ত্রপাতির আধিক্যে ঢাক-ঢোলের বাজনা কমে যাচ্ছে।
তারা আরও জানান, কাঠ, চামড়াসহ ঢাক-ঢোল তৈরির বিভিন্ন উপকরণের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় এখন খুব একটা লাভ হয় না।
সৃষ্টি তবলা তরঙ্গের মালিক মানিক দাস বাংলানিউজকে বলেন, আগের দিনের মতো ঢাক-ঢোলের তেমন চাহিদা নেই। যুগ পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে যেতে বসেছে ঢাক, ঢোল, তাল, তবলা। তবে পূজা উপলক্ষে ঢাক-ঢোলের চাহিদা কিছুটা বেড়েছে।
তিনি জানান, তিন পুরুষ ধরে এই পেশার সঙ্গে তারা জড়িত। অনেক কষ্ট করে বাপ-দাদার পেশার হাল ধরে রেখেছেন। এ ব্যবসায় এখন যা আয় হয় তা দিয়ে ভরণ-পোষণ করা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে।
দাম প্রসঙ্গে মানিক বলেন, বড় আকারের ঢাক ৮-৯ হাজার টাকা প্রতিটি। ছোট ও মাঝারি ৫-৬ হাজার টাকা। ঢোল বড়টি ৭ হাজার টাকা। ছোট ও মাঝারি ৫-৬ হাজার টাকা। খোল ৫ হাজার টাকা প্রতিটি।
জয় বাদ্য বিতানের মালিক ধীরেন্দ্রনাথ দাস বাংলানিউজকে বলেন, বছরে তিন (আশ্বিন, কার্তিক ও অগ্রাহয়ণ) মাসে কাজের চাপ বেশি থাকে। দুর্গাপূজার জন্য কিছু কাজ করছি। এই কাজ করে এখন সংসার চালানো যায় না।
তবলা বিতানের মালিক শ্যামল দাস বাংলানিউজকে বলেন, এখানে নতুন তবলা, ঢোল, খোল, স্কুল ড্রামসেটসহ যাবতীয় বাদ্যযন্ত্র বিক্রি ও মেরামত করা হয়।
একাধিক কারিগর জানান, গান বাজনা, যাত্রানুষ্ঠানসহ বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠান কম হওয়ায় ঢোলের চাহিদাও কমে যাচ্ছে দিন দিন। তাই সংসারের খরচ মেটানো কঠিন হয়ে পড়েছে। যার কারণে এ কাজের আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে কারিগররা।
আধুনিক বাদ্যযন্ত্রের কারণে উৎসব-অনুষ্ঠানে এখন আর ঢোলের তেমন কদর না থাকলেও পূজা-পার্বণে এখনও ঢাক-ঢোলের কদর রয়েছে। পূজার আরতিতে ঢোলের টাকডুম টাকডুম বোলের এখন কোনো বিকল্প নেই। তাই বছরের এ সময়টাতে ব্যস্ত সময় পার করেন ঢুলি থেকে শুরু করে ঢোল-খোলের কারিগররা। পূজা ছাড়াও বিভিন্ন লোকসঙ্গীতের আসরে ঢাক-ঢোল অন্যতম বাদ্যযন্ত্র।
বাদ্যযন্ত্র অনুরাগী খুলনার সরকারি মহিলা কলেজের বাংলা বিভাগের প্রভাষক বিকাশ রায় বাংলানিউজকে বলেন, আমাদের প্রায় সবারই পূজার সানাইয়ে মন কেমন করে ওঠে। শুধু সানাই নয়, জোড়া কাঠিতে ঢাক কিংবা কাসরের উপর একটানা একটি কাঠির তিনটি শব্দ-সুরের যে মুর্ছনা সৃষ্টি করে এসেছে তা বাঙালির একান্ত নিজের সুর। এ সুরের ইন্দ্রজাল ছিড়ে আমাদের বাঙালির গানে প্রবেশ করেছে গিটার, প্যাডড্রাম ইত্যাদি পাশ্চাত্য বাদ্যযন্ত্র। এর প্রভাবে আমাদের ঢাক-ঢোল লালিত সঙ্গীতে পড়েছে নেতিবাচক ছায়া। একথা অবশ্য সত্য যে সংস্কৃতি পরিবর্তনশীল এবং প্রবাহমান। ফলে নতুন বাদ্যযন্ত্র আমাদের সঙ্গীতে স্থান করে নেবে এটাই স্বাভাবিক। তবে একথাও সত্য যে, আমাদের দেশজ যন্ত্রে সুর ক্রমশ স্থিমিত হয়ে আসার অন্যতম কারণ হলো, এগুলো সঠিকভাবে বাজানো এবং সঠিক সঙ্গীতের উপযোগী করে তৈরি করা লোকের অভাব। তাই ঢাক-ঢোল মিশ্রিত সঙ্গীতের জন্য হৃদয় ব্যাকুল হলেও একদিন সত্যিই স্থিমিত হয়ে যাবে আমাদের দেশজ বাদ্যযন্ত্রের সুর।
তিনি আরও বলেন, বিচিত্র পেশার ভিড়ে দেশজ বাদ্যযন্ত্র তৈরির পেশায় অর্থের প্রাচুর্য না থাকায় মানুষ বংশানুক্রমিক এসব পেশা পরিবর্তন করে নতুন উপার্জনের পথ ধরেছে। ফলে কমে গেছে খুলনার বাদ্যযন্ত্র তৈরির ঘরগুলো।
বাংলাদেশ সময়: ০৬১৯ ঘণ্টা, অক্টোবর ০৯, ২০১৮
এমআরএম/আরআর