ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১১ পৌষ ১৪৩১, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

ছয়শ মুক্তিযোদ্ধার নেতৃত্ব দেওয়া লতিফ মির্জাও রাজাকার!

স্বপন চন্দ্র দাস, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০২৪২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৮, ২০১৯
ছয়শ মুক্তিযোদ্ধার নেতৃত্ব দেওয়া লতিফ মির্জাও রাজাকার! শহরে মুক্তিযোদ্ধা লতিফ মির্জার নামে সড়কের নামকরণ ফলক

সিরাজগঞ্জ: মির্জা আব্দুল লতিফ ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে সিরাজগঞ্জসহ উত্তরাঞ্চলের কিংবদন্তী একজন মুক্তিযোদ্ধার নাম। লতিফ মির্জা নামেই তিনি সব মহলে পরিচিত। যুদ্ধকালীন হানাদার বাহিনী ও রাজাকারদের কাছে মূর্তিমান আতংক ছিলেন তিনি। অথচ সেই লতিফ মির্জার নাম এসেছে ঘোষিত রাজাকারের তালিকায়!

সম্প্রতি মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত সিরাজগঞ্জের ৭২ জন রাজাকারের তালিকার মধ্যে রয়েছে মির্জা আব্দুল লতিফ ও বিএলএফ মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট খোরশেদ আলমের নাম। রাজশাহী বিভাগের ৩৪ নম্বর ক্রমিকে এ দু'জনের নাম লিপিবদ্ধ হয়েছে।

এ নিয়ে সমগ্র সিরাজগঞ্জজুড়ে বিরাজ করছে তীব্র ক্ষোভ। ইতোমধ্যে ক্ষুব্ধ সহকর্মী ও সমর্থকরা প্রতিবাদ কর্মসূচি আহ্বান করেছেন।

পলাশডাঙ্গা যুব শিবিরের সর্বাধিনায়ক ও সদ্য বিলুপ্ত মুক্তিযোদ্ধা সংসদ জেলা ইউনিট কমান্ডের কমান্ডার গাজী সোহরাব আলী সরকার বলেন, লতিফ মির্জার নেতৃত্বে সমগ্র উত্তরাঞ্চলে আমরা প্রতিরোধ যুদ্ধ গড়ে তুলেছিলাম। তিনি শুধু মুক্তিযোদ্ধা নন, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠকও। রাজাকারের তালিকায় তার নাম ওঠার ঘটনাটি পলাশডাঙ্গা যুব-শিবিরসহ সব মুক্তিযোদ্ধার কাছে লজ্জাজনক।  
...
পলাশডাঙ্গা যুব-শিবিরের সহ অধিনায়ক ও জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি অ্যাডভোকেট বিমল কুমার দাস, এ ঘটনায় আমরা বিস্মিত ও স্তম্ভিত। প্রায় ৬শ মুক্তিযোদ্ধার নেতৃত্ব দিয়েছেন লতিফ মির্জা। তার নাম কীভাবে রাজাকারের তালিকায় আসে? সরকারকে প্রশ্নবিদ্ধ করতেই এমনটা করা হয়েছে বলে দাবি করেন তিনি। এটা করে স্বাধীনতাকেই কলঙ্কিত করা হয়েছে। এ তালিকা প্রণয়নকারীর শাস্তির দাবি করেন বিমল কুমার দাস।  

মুক্তিযোদ্ধা (বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স) ও জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ইসহাক আলী বলেন, স্বাধীনতা পরবর্তীতে লতিফ মির্জা শ্রমিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন। ওই সময় তিনি ও অপর মুক্তিযোদ্ধা সংগঠক (বিএলএফ) অ্যাডভোকেট খুরশিদ আলম তাঁত শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে আন্দোলন করেন। এ কারণে শাহজাদপুর ও চৌহালীর তাঁত মালিকদের পক্ষে জহুরুল ইসলাম মোল্রা তাদের বিরুদ্ধে পাবনা জেলা প্রশাসক বরাবর একটি অভিযোগ করে। সেই অভিযোগের জেরেই তাদের নাম তালিকায় এসেছে বলে দাবি করেন তিনি। যাচাই-বাছাই না করে দুজন প্রতিষ্ঠিত মুক্তিযোদ্ধা ও সংগঠকের নাম রাজাকার তালিকায় দেওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশও করেন এ মুক্তিযোদ্ধা সংগঠক।
লতিফ মির্জার স্ত্রী হোসনে আরা মির্জাপ্রয়াত আব্দুল লতিফ মির্জার স্ত্রী জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি হোসনে আরা মির্জা কান্নাজড়িত কন্ঠে বলেন, আমরা কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছি। পুরো পরিবার স্তম্ভিত হয়ে পড়েছে। সিরাজগঞ্জ নয়, সারাদেশের মানুষই কিংবদন্তী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে লতিফ মির্জাকে চেনেন। তাকেই রাজাকারের তালিকায় আখ্যা দেওয়া হলো। দেশের জন্য যুদ্ধ করে, সারাজীবন মানুষের জন্য রাজনীতি করে গেলেন। মৃত্যুর পর তার নামেই কলঙ্কের কালিমা লেপন করা হলো। যারা এ ধরনের তালিকা করেছে তাদের সুষ্ঠু বিচার চাই।

লতিফ মির্জার মেয়ে সেলিনা মির্জা মুক্তি বলেন, কোনো প্রকার যাচাই-বাছাই ছাড়াই এই তালিকা প্রণয়ন করে আমার বাবাকে অপমান করা হয়েছে। আমরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে এর বিচার দাবি করছি। পাশাপাশি এ তালিকা প্রকাশের জন্য মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করেন তিনি।

একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ৬ জুন সিরাজগঞ্জের কামারখন্দ উপজেলা ভদ্রঘাট ইউনিয়নের জাঙ্গালিয়াগাঁতী এলাকায় গঠিত হয় উত্তরাঞ্চলের বেসরকারি সাব সেক্টর পলাশ ডাঙ্গা যুবশিবির। যার প্রতিষ্ঠাতা পরিচালিক ছিলেন প্রয়াত আব্দুল লতিফ মির্জা। বৃহত্তর পাবনা-রাজশাহ-বগুড়া অঞ্চলে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও রাজাকারদের বিরুদ্ধে মোট ৪৮টি সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নেয় এ পলাশডাঙ্গা যুবশিবির। তার মধ্যে ১১ নভেম্বর নওগাঁ যুদ্ধ ছিল অন্যতম। এই যুদ্ধে ১৩০ জন পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার নিহত হয়। একজন ক্যাপ্টেনসহ ৯ জন সেনা আত্মসমর্পণ করে। তবে কোনো মুক্তিযোদ্ধা নিহত হননি। এছাড়াও পাবনার ফরিদপুর, সাঁথিয়া, নাটোরের গুরুদাসপুর ও সিরাজগঞ্জের তাড়াশ থানা লুটসহ কালিয়া হরিপুর যুদ্ধ ছিল অন্যতম।  

লতিফ মির্জা যুদ্ধ পরবর্তীতে শ্রমিক আন্দোলন ও পরে জাসদের রাজনীতিতে যুক্ত হন। ১৯৭৯ সালে জাসদ থেকে সর্বকনিষ্ঠ সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৮৮ সালে শেখ হাসিনা দেশে ফেরার পর আওয়ামী রাজনীতিতে যোগ দেন এবং ১৯৯৬ সালে সিরাজগঞ্জ-৪ আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে দ্বিতীয়বারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি জাতীয় সংসদের প্যানেল স্পিকার ও শ্রম মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতির দায়িত্বও পালন করেন। দীর্ঘদিন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০০৭ সালের ৫ নভেম্বর মৃত্যুবরণ করেন কিংবদন্তী এই মুক্তিযোদ্ধা ও রাজনীতিবিদ।  

এদিকে আব্দুল লতিফ মির্জার নাম রাজাকারের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় সিরাজগঞ্জের বিভিন্ন মহলে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। বাদ যায়নি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকও। সিরাজগঞ্জ সরকারি কলেজ মাঠের একটি অনুষ্ঠানে মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রী শহীদ এম মনসুর আলীর কাছে অস্ত্র জমা দিচ্ছেন লতিফ মির্জা এমন ছবি নিজ নিজ ফেসবুকে আপলোড করে প্রতিবাদ জানোচ্ছেন সর্বস্তরের মানুষ।  

অপরদিকে লতিফ মির্জা স্মৃতি পরিষদ বুধবার (১৮ ডিসেম্বর) সকালে মানববন্ধন কর্মসূচি আহ্বান করেছে। অপরদিকে একই দিন বিকেলে মুক্তিযোদ্ধারা সভা আহ্বান করেছেন বলে জানিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধা সংসদ জেলা কমান্ডের সাবেক ডেপুটি কমান্ডার গাজী আশরাফুল ইসলাম চৌধুরী জগলু।  

বাংলাদেশ সময়: ২১৪১ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৭, ২০১৯
এসএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।