ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

অননুমোদিত অংশের বহির্গমন পথে আগুন, পুড়ে মরেছে ১০ শ্রমিক

ইসমাইল হোসেন, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫২৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৩, ২০১৯
অননুমোদিত অংশের বহির্গমন পথে আগুন, পুড়ে মরেছে ১০ শ্রমিক

ঢাকা: অননুমোদিতভাবে সম্প্রসারিত টিনশেডে ত্রুটিপূর্ণ বৈদ্যুতিক সংযোগ এবং এ কারণে নিয়ম মেনে বৈদ্যুতিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় আগুনে পুড়েছে গাজীপুরের রুজা হাইটেক ফ্যান কারখানা।

আর এই অননুমোদিত টিনশেডের একটিমাত্র বহির্গমন পথের কাছে আগুনের সূত্রপাত এবং অনিয়ন্ত্রিত কেমিক্যাল ব্যবহারের কারণে আগুন দ্রুত ছড়িয়ে গেলে ১০ জন শ্রমিক পুড়ে মরেছে।
 
গত ১৫ ডিসেম্বর গাজীপুর সদর উপজেলার বাড়ীয়া ইউনিয়নের কিশোরিতা গ্রামে রুজা হাইটেক কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ১০ জন নিহত ও বেশ কয়েকজন আহত হয়েছিলেন।


 
এ ঘটনায় শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর পৃথক দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করে।
 
শ্রম মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটি রোববার (২২ ডিসেম্বর) তাদের প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছে। এই প্রতিবেদনে কারখানাটির অব্যবস্থাপনার তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিবেদনের একটি কপি বাংলানিউজের হাতেও এসেছে।
 
মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম-সচিব একেএম রফিকুল ইসলামের নেতৃত্বে কমিটিতে ঢাকার কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান অধিদপ্তরের উপ-মহাপরিদর্শক মো. মতিয়ার রহমান, গাজীপুরের মো. ইউসুফ আলী, মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মো. হানিফ শিকদার এবং ঢাকা বিভাগীয় শ্রম দপ্তরের সহকারী পরিচালক মো. আলমগীর হোসাইন কমিটিতে ছিলেন।
 
তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, জাহিদ হাসান ঢালী ও নাসির এই কারখানার মালিক। কারখানার শ্রমিক সংখ্যা আনুমানিক ৩৪ জন। প্রধান উৎপাদিত পণ্য ছিল সিলিং ফ্যান। আর আহত দুইজন শ্রমিক স্থানীয় শহীদ তাজউদ্দিন আহমদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন।
 
প্রতিবেদনে বলা হয়, দুইতলা ভবনটির দ্বিতীয় তলায় ছাদের অর্ধেক অংশে টিনসেড বিদ্যমান। এই টিনসেড আগুনের সুত্রপাত হয়। আহত শ্রমিক আনোয়ারের সঙ্গে কথা বলে কমিটি জানিয়েছে, টিনসেড অংশের দরজার পাশে বৈদ্যুতিক সুইচ বোর্ড থেকে শর্ট সার্কিটের মাধ্যমে আগুনের সুত্রপাত হয়ে থাকতে পারে।  

তিনি ওই সময় টিনসেড অংশে কর্মরত ছিলেন। তিনি জানান, হঠাৎ একটি বিকট শব্দ শুনতে পান এবং মুহূর্তেই আগুন সম্পূর্ণ ফ্লোরে ছড়িয়ে পড়ে। এই ফ্লোরে উৎপাদন কাজে অকটেন ব্যবহার করা হতো। আগুন অকটেনের সংস্পর্শে আসার ফলেই দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।
 
তদন্ত কমিটির পর্যবেক্ষণ:
প্রতিবেদনে বলা হয়, অননুমোদিত সম্প্রসারিত/নির্মিত টিনশেডে কোনো নিয়ম মেনে বৈদ্যুতিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। বৈদ্যুতিক লোড বেড়ে যাওয়া বা ত্রুটিপূর্ণ বৈদ্যুতিক সংযোগের কারণে বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিটের ঘটনা ঘটতে পারে। ফলে টিনশেডের একটিমাত্র বহির্গমণ পথের কাছে আগুনের সূত্রপাত এবং অনিয়ন্ত্রিত কেমিক্যাল ব্যবহারের কারণে আগুন দ্রুত ছড়িয়ে গেলে নয়জন শ্রমিক সেই পথ দিয়ে বের হয়ে গেলেও বাকি ১০ জন বের হতে পারেনি।
 
তদন্ত কমিটি জানিয়েছে, বৈদ্যুতিক ব্যবস্থাপনা সঠিক থাকলে আগুনের সূত্রপাত হতো না। কেমিক্যাল ব্যবহারের নিয়ম মেনে চললে আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়তো না।  বিকল্প বহির্গমণ পথ থাকলে হতাহত/নিহতের ঘটনা এড়ানো সম্ভব ছিল। ফায়ার এক্সটিনগুইশার ব্যবহার জানা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকলে দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব ছিল।
 
প্রতিবেদন আরও বলা হয়, সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন থেকে প্রতিষ্ঠানের ট্রেড লাইসেন্স নেওয়া হয়, যা ২০১৮-২০১৯ সন পর্যন্ত হালনাগাদ রয়েছে। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স বিভাগ থেকে ইস্যুকৃত ফায়ার লাইসেন্সের মেয়াদ ৩০ জুন পর্যন্ত নবায়ন  করা ছিল। পরিবেশ অধিদপ্তর থেকেও পরিবেশ ছাড়পত্র রয়েছে।
 
গাজীপুরের কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের উপ-মহাপরিদর্শকের কার্যালয় থেকে ২০১৮ সালে ইস্যু করা লাইসেন্স আছে। লাইসেন্সটি ২০১৯ সনে নবায়ন করা হয়।
 
তবে পরবর্তীতে কারখানার মালিক কারখানা ভবনের ছাদে অবৈধ টিনশেড স্থাপন করায় এবং কারখানায় শ্রম আইনের ধারা/বিধি অনুযায়ী গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহ লঙ্ঘিত হওয়ায় গাজীপুর জেলা কার্যালয়ের সংশ্লিষ্ট পরিদর্শক মো. রোমেনুল ইসলামের পরিদর্শনের ভিত্তিতে কারখানাটিতে নোটিশ করা হয়েছে এবং শ্রম আদালতে মামলা করা হয়েছে।
 
৯ দফা সুপারিশ:
কারখানায় কর্মরত সবাই যেন জরুরি পরিস্থিতিতে দ্রুত নির্গমন করতে পারে সেজন্য নিরাপদ, সহজ এবং জরুরি বহির্গমন পথ রাখা বাঞ্ছনীয়। কারখানায় উৎপাদন প্রক্রিয়া চলাকালীন জরুরি বহির্গমন পথসমূহ খোলা রাখা নিশ্চিত করার জন্য এই দপ্তরের তত্ত্বাবধানে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য জরুরিভিত্তিতে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা যেতে পারে।
 
অতিমাত্রার দাহ্য পদার্থ, কেমিক্যাল, গ্যাস ব্যবহার করে ব্যবসা পরিচালনার ক্ষেত্রে বিস্ফোরক পরিদপ্তর থেকে সক্ষমতা/নিরাপত্তা সনদ নেওয়া বাধ্যতামূলক করা। কেমিক্যাল ব্যবহারকারী কারখানাগুলোতে সেফটি কমিটি গঠন জোরদার করতে হবে এবং শ্রমিকদের সেফটি কমপ্লায়েন্স বিষয়ক যথাযথ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।
 
কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট সব দপ্তরের কার্যক্রম আরো জোরদার করা প্রয়োজন। কারখানার ক্ষেত্রে বৈদ্যুতিক ওয়্যারিং লাইসেন্সপ্রাপ্ত ঠিকাদার কর্তৃক নিশ্চিত করা। বৈদ্যুতিক ডিবি বোর্ড ও ট্রান্সফরমার অগ্নি-নিরাপত্তামূলক দেয়াল ও ইনসুলেশন দিয়ে আলাদা এবং কর্মক্ষেত্র থেকে নিরাপদ দূরত্বে স্থাপন করলে দুঘটনা অনেকাংশে হ্রাস পাবে।
 
উচ্চ ঝুঁকি সম্পন্ন কারখানাগুলোর বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে তাৎক্ষণিকভাবে অবহিতকরণ এবং মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি এবং আরোপিত জরিমানা বা শাস্তি বৃদ্ধির ব্যবস্থা করার সুপারিশ করা হয়েছে।
 
কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের মহাপরিদর্শক শিবনাথ রায় বাংলানিউজকে বলেন, আমাদের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনও প্রস্তুত হয়েছে। সোমবার হয়তো হাতে পাবো।
 
তিনি বলেন, ২০১৮ সালে রুজা হাইটেকে অধিদপ্তর থেকে লাইসেন্স দেওয়া হয়েছিল। এছাড়াও ফায়ার সার্ভিস, পরিবেশ অধিদপ্তর থেকেও লাইসেন্স ছিল। তবে লাইসেন্স নবায়নের পরেও নভেম্বরে পরিদর্শনের সময় দ্বিতীয় তলার ছাদে টিনের ছাউনি দিয়ে কাজ করছিল বলে তাদের নোটিশ দেওয়া হয় এবং নোটিশের জবাব না পেয়ে মামলাও করা হয়।
 
কমপ্লায়েন্স না থাকায় প্রাণহানি বা বড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে- এই অভিযোগ এনে শ্রম আইনের ৩০৯ ধারার শ্রম আদালতে মামলা করা হয়, যার শাস্তি হতে পারে চার বছরের কারাদণ্ড।
 
মন্ত্রণালয়ের সচিব দেশের বাইরে থাকায় তার সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। তবে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের মহাপরিদর্শক শিবনাথ রায় বলেন, দুটি প্রতিবেদন হাতে পেলে বাকি অ্যাকশনে যাবো।
 
বাংলাদেশ সময়: ১০১৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৩, ২০১৯
এমআইএইচ/এমএ 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।