ঢাকা, মঙ্গলবার, ৯ পৌষ ১৪৩১, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

নরসিংদীর মোড়ে মোড়ে পিঠা খেতে ভোজন রসিকদের ভিড়

সুজন বর্মণ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৪৪ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৮, ২০২১
নরসিংদীর মোড়ে মোড়ে পিঠা খেতে ভোজন রসিকদের ভিড় নরসিংদীর মোড়ে মোড়ে পিঠা খেতে ভোজন রসিকদের ভিড়। ছবি: বাংলানিউজ

নরসিংদী: শীতের আগমনে প্রকৃতি এখন হিম হিম গন্ধ। শিশির ভেজা ঘাসের ডগায় মুক্তোর দানা।

ভোরের কাঁচা রোদ মৃদু হিমস্পর্শ প্রাণে শিহরণ তুলে বিদায় নিচ্ছে কার্তিক। সকালের কুয়াশা কিংবা সন্ধ্যার হিমেল বাতাসে ভাঁপা পিঠার গরম আর সুগন্ধি ধোঁয়ায় মন আনচান করে ওঠে। পিঠা ছাড়া ভোজন রসিক বাঙালির শীত যেন পরিপূর্ণ হয় না। সরষে বা ধনেপাতা বাটা অথবা শুঁটকির ভর্তা মাখিয়ে চিতই পিঠা মুখে দিলে ঝালে কান গরম হয়ে শীত পালায়। শীতের আমেজ শুরুর সঙ্গে সঙ্গে নরসিংদীর বিভিন্ন উপজেলার  মোড়ে মোড়ে এখন চলছে পিঠা তৈরি ও পিঠা খেতে ভোজন রসিকদের ভীড়।

পৌষের কনকনে শীতে ভোজন রসিকদের জন্য উপজেলার মোড়ে মোড়ে এমন কয়েক শতাধিক পিঠার দোকান রয়েছে। সন্ধ্যা হলেই প্রতিটি পিঠার দোকানে পড়ে পিঠা বিক্রির ধুম, চলে প্রায় মধ্য রাত পর্যন্ত।

শীতের পিঠর স্বাদ নেওয়ার সুযোগ হাতছাড়া করতে চান না অনেকে। অনেককেই দেখা যাচ্ছে পিঠার দোকানের চুলার পাশে বসেই গরম পিঠা খাওয়াকে রেওয়াজে পরিণত করেছেন। অনেকে পরিবারের চাহিদা মেটাতে পিঠা কিনে বাসায় নিয়ে যাচ্ছেন। তাই নরসিংদী শহরের হেমেন্দ্রসাহার মোড়, রেলস্টেশন এলাকা, শহরের বটতলা এলাকা, বাণিয়াছল মোড়, হাজীপুর ও উপজেলার বিভিন্ন মোড়ে মোড়ে গড়ে ওঠা মৌসুমি পিঠা পুলির দোকানে ক্রেতাদের ভিড়ই তার প্রমাণ।

সরেজমিনে দেখা যায়, সূর্যাস্তের পরপরই দোকানিরা তাদের পিঠার পসরা বসান রাস্তার মোড়ে কিংবা পাশের গলিতে। চুলায় আগুন জ্বেলে একের পর এক পিঠা বানাতে থাকেন তারা। অন্যদিকে ক্রেতারা গরম গরম পিঠা সাবাড় করতে থাকেন। এসব দোকানে পাঁচ টাকায় চিতই, ২০ টাকায় ডিম পিঠা এবং ১০ থেকে ১০০০ টাকায় ভাপা ও পাটিসাপটা পিঠা পাওয়া যায়। চিতই পিঠার সঙ্গে সরষে, ধনেপাতা, মরিচবাটা বা ঝাল শুঁটকির ভর্তা বিনামূল্যে মেলে।

বেলাব উপজেলার পাটুলী ইউনিয়নের দুলুর মোড়। প্রতিদিন সন্ধ্যাই মোড়ের পিঠার দোকানগুলোতে পিঠা প্রেমীদের ভিড় লেগেই থাকে। এই মোড়ে আট বছর ধরে পিঠা বিক্রি করেন মো. জাহাঙ্গীর। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, চিতই পিঠার চেয়ে ভাপা পিঠার  চাহিদা বেশি। আখের গুড়, খেজুরের গুড়, কিসমিস ও নারিকেল দিয়ে ভাপা পিঠা তৈরি করি। প্রতিদিন প্রায় ১০ থেকে ১২ হাজার টাকার পিঠা বিক্রি করি।

আরেক পিঠার দোকানি শরীফ বলেন, আমাদের মোড়ের পিঠার খ্যাতি রয়েছে। তাই আশেপাশের গ্রাম থেকে পিঠা খেতে এখানে লোকেরা আসে। তারা পিঠা দোকানে বসেও খায় আবার অনেকে পরিবারের জন্য ২০ থেকে ৩০টি পিঠা পার্সেল নিয়ে যায়।

দুলুর মোড়ে একটি বেসরকারি স্কুলের শিক্ষক সোহেল তানভীর পিঠা খেতে এসেছেন। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, পিঠা ছাড়া শীতের আমেজ পরিপূর্ণ হয় না। সরিষা অথবা ধনেপাতা ভর্তা দিয়ে গরম চিতই পিঠা খাওয়ার স্বাদই অন্য রকম। যা অন্য কোন খাবারের মধ্যে পাওয়া যায় না।

সন্ধ্যায় গরম চিতই পিঠা ফুঁ দিয়ে দিয়ে খেতে খেতে শ্যামল নামে এক ছাত্র বলেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনেই পিঠা খেতে এসেছি। গরম ভাপা পিঠার ধোঁয়া দেখে লোভ সামলাতে না পেরে বন্ধুদের নিয়ে পিঠা খেতে চলে এসেছি।

এদিকে নরসিংদী শহরের ভেলানগর ওভারব্রিজের নীচে মামার ভাপা পিঠার দোকানের মালিক মালেক মিয়ার সঙ্গে পিঠা নিয়ে কথা হয়। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, প্রতিবার শীতের শুরুতেই পিঠা বিক্রি শুরু করি। কিন্তু এবার করোনার কারণে শীতের মাঝামাঝিতে পিঠা বিক্রি শুরু করতে হয়। আমার পিঠার খ্যাতি পুরো জেলা জুড়ে। অনেক দূর দূরান্ত থেকে পিঠা খাওয়ার জন্য দোকানে লোক আসে। প্রতিদিন সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত পিঠা বিক্রি করি। সন্ধ্যা থেকেই দোকানে ভিড় বাড়তে থাকে। দোকানে ২০ টাকা থেকে ১০০০ টাকা পর্যন্ত পিঠা পাওয়া যায়। তবে ক্রেতাদের কাছে ১২০ ও ১৫০ টাকার পিঠার চাহিদা বেশি। প্রতিদিন দোকানে ১৫,০০০ টাকার মত পিঠা বিক্রি হয়।

এছাড়া শহরে বিভিন্ন ভ্রাম্যমাণ ভ্যানেও পিঠা বিক্রি করতে দেখা যায়। শহরের হেমেন্দ্র সাহার মোড়ে ভ্রাম্যমাণ ভ্যানের মাধ্যমে পিঠা বিক্রেতা কবির হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, সীমিত খরচে ভালো লাভের আশায় প্রতিদিন সন্ধ্যা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত পিঠা বিক্রি করেন। প্রতিদিন ১২০০ টাকা খরচ করে তিনি প্রায় ৭০০ টাকা লাভ হয়। এ ব্যবসা করে তিনি মোটামুটি ভালো ভাবে সংসার চালিয়ে যাচ্ছেন।

ভোজনরসিকদের মধ্যেও শীতের পিঠা নিয়ে উচ্ছাসের কমতি নেই। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী শতাব্দী দাস। তিনি বলেন, কাজের চাপের কারণে বাড়িতে পিঠা বানানোর সময় হয় না। তাই শীতের পিঠার খাওয়ার সাধ মেটাতে অস্থায়ী দোকান থেকে পিঠা কিনে খেতে হয়। স্বাদ গন্ধে অনেকটাই বাড়ির মতো। তাই  খেতেও ভালো লাগে।

নরসিংদী সরকারি মহিলা কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ কালাম মাহমুদ বাংলানিউজকে বলেন, বাঙ্গালির ঐতিহ্য অনুযায়ী শীতকালই হচ্ছে পিঠা খাওয়ার আসল সময়। শহরবাসীর পিঠার চাহিদা মেটাতে অলিতে গলিতে, রাস্তার মোড়ে, বাসস্ট্যান্ড ও বাজারে বসেছে ছোট ছোট পিঠার দোকান। পিঠার দোকানে প্রভাবিত হয়ে ক্রমেই আমাদের নিজ বাড়িতে পিঠা তৈরির ঐতিহ্য হারিয়ে যাচ্ছে। পিঠা আমাদেরই ঐতিহ্য, আমাদেরই সংস্কৃতি। এই ঐতিহ্য বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা তাই আমাদেরই করতে হবে।

করোনাকালে রাস্তার মোড়ের দোকানগুলোর পিঠা স্বাস্থ্যসম্মত কিনা এবং খাওয়াটা নিরাপদ কিনা, জানতে চাইলে নরসিংদী সদর উপজেলার স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. আবু কাউছার বাংলানিউজকে বলেন, পিঠার দোকান গুলোকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে পিঠা বিক্রি করতে হবে। আর ক্রেতাদের নিজেদের মধ্যে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে এবং হাত জীবাণুমুক্ত করে পিঠা খেতে হবে। তাহলেই করোনার মধ্যেও পিঠার স্বাদ উপভোগ করা যাবে।

বাংলাদেশ সময়: ১৬৪৪ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৮, ২০২১
কেএআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।