ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৯ মাঘ ১৪৩১, ২৩ জানুয়ারি ২০২৫, ২২ রজব ১৪৪৬

জাতীয়

ভাষাসৈনিক ইউসুফ কালু আর নেই

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০২২ ঘণ্টা, মার্চ ২৯, ২০২১
ভাষাসৈনিক ইউসুফ কালু আর নেই ইউসুফ কালু

বরিশাল: ভাষাসৈনিক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. ইউসুফ কালু (৯১) আর নেই (ইন্নালিল্লাহি ওয়া লিল্লাহি রাজিউন)।

তিনি বার্ধক্যজনিত কারণে বিভিন্ন ধরনের রোগে আক্রান্ত হয়ে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন।

 

চিকিৎসাধীন অবস্থায় সোমবার (২৯ মার্চ) সন্ধ্যা পৌনে ৬টায় তিনি ওই হাসপাতালেই শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন বলে জানিয়েছেন তার ছেলে মো. সোহাগ।

তার নামাজের জানাজা ও দাফন কার্যর সময়সূচি পরবর্তীতে জানিয়ে দেওয়া হবে।

এদিকে তার মৃত্যুতে গভীর শোক জানিয়েছেন পার্বত্য শান্তি চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটির আহ্বায়ক (মন্ত্রী) আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ, বরিশাল সিটি করপোরেশনের মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ, বরিশালের জেলা প্রশাসক জসীম উদ্দিন হায়দার, বরিশাল রিপোর্টার্স ইউনিটি, বরিশাল সাংবাদিক ইউনিয়ন, বরিশাল হেলথ জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন, বরিশাল কোর্ট রিপোর্টার্স ইউনিটিসহ বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন।

মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ এবং বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে উদ্বেলিত হয়ে উঠতেন শতবর্ষী এই যোদ্ধা।

১৯৩১ সালের ১৭ জানুয়ারি বর্তমান ঝালকাঠী জেলার রাজাপুরের কানুদাসকাঠী মিয়াবাড়িতে তার জন্ম। বাবা ওবায়দুল করিম (রাজা মিয়া) ও মা ফাতেমা খাতুন। ৩ ভাই, ২ বোনের মধ্যে তিনি সবার ছোট ছিলেন তিনি। বাবা রাজা মিয়া প্রথমে ১৯২০ সালের দিকে কলকাতা পোর্ট কমিশনে চাকরি করতেন। পরবর্তীতে চাকরি ছেড়ে দেন এবং রাজা রায় বিহারীর জমিদারির নায়েব নিযুক্ত হন। আমুয়া, ভান্ডারিয়া, কানুদাসকাঠী অঞ্চলের দায়িত্বে ছিলেন তিনি। ভাষা সংগ্রামী মো. ইউসুফ কালুর পড়াশুনার প্রথম পাঠ গ্রামের পাঠশালায়। এরপর এসে ভর্তি হন বরিশাল ব্রজমোহন বিদ্যালয়ে (বি.এম স্কুল )।

১৯৪৮ সালে অষ্টম শ্রেণির ছাত্র থাকাকালীন সময়ে দেখেছেন বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার আন্দোলন তুঙ্গে থাকার বিষয়টি। তখন থেকেই তিনি এর সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন।  সেসময়েই একদিন প্রগ্রেসিভ ছাত্রফ্রন্টের নেতা এমায়দুল এর নেতৃত্বে মিছিলে যোগ দেন এবং পুলিশের লাঠির আঘাতে প্রথম দিনেই আহত হন। এরপর মেট্রিকুলেশন পাস করে ১৯৫১ সালে আইএ ভর্তি হন বিএম কলেজে কমার্স বিভাগে। তখন থেকে ভাষা সংগ্রামে সম্পৃক্ততা আরও বেড়ে যায়।  

তৎকালীন ছাত্রলীগের সভাপতি ও বিএম কলেজ ছাত্র সংসদের ভাইস প্রেসিডেন্ট সৈয়দ গোলাম কিবরিয়াকে আহ্বায়ক করে বিএম কলেজে গঠন হয় ২৫ সদস্যের ‘ভাষা সংগ্রাম পরিষদ। যেখানে তাকেও কমিটির সদস্য করা হয়। তবে কিছুদিন পরে আন্দোলনে দেশ উত্তাল হয়ে উঠলে ৮১ সদস্য বিশিষ্ট বৃহত্তর বরিশাল ভাষা সংগ্রাম পরিষদে যুক্ত করা হয় তাদের।

ভাষা সংগ্রাম চলাকালীন সময়ে যুক্ত হয় ১৯৫৪ সালের নির্বাচন। নির্বাচনের আগে বরিশালে প্রচারণায় আসে পাকিস্তান মুসলিম লীগ সভাপতি ও কেন্দ্রীয় মন্ত্রী খান আব্দুল কাইউম। তখন ইউসুফ কালু ও তার সহযোদ্ধারা রাষ্ট্রভাষা বাংলা ও স্বৈরাচারী সরকার নিপাত যাওয়ার দাবিতে কালো পতাকা বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। এই সময় পুলিশের সঙ্গে ঘটে তুমুল সংঘর্ষ হলে শহরের কাউনিয়ার নিবাসী মালেক নামে একজন মারা য়ায়। এই ঘটনায় ইউসুফ কালুসহ ৩৫ জনের মত গ্রেফতার হন। ২২ দিন পর জামিনে বের হয়ে নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের হয়ে কাজ শুরু করেন তারা।

প্রথম জীবনে শিশু কিশোর সংগঠন মুকুলফৌজ করা এই প্রবীণ ব্যক্তিত্ব ৬৯’র গণঅভ্যুত্থান সহ প্রতিটি আন্দোলনেই দেশ ও মানুষের জন্য সক্রিয়ভাবে কাজ করেছেন। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলে, দেশের হয়ে মুক্তিযোদ্ধা খাতায় নাম লেখান। ৭১’র ১৪ মে কোলকাতা লালবাজার চলে যান। সেখানে বাংলাদেশ সহায়ক সমিতির সহযোগিতায় হাসনাবাদ, হিংগলগড়, টাকি হেড কোয়াটার থেকে প্রশিক্ষণ নেন। পরবর্তীতে ৯ নম্বর সেক্টরের অধীনে কালীগঞ্জ, সাতক্ষীরার সীমান্ত এলাকায় পাকবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন।  

মুক্তিযুদ্ধকালীন নুরুল আলম ফরিদ সম্পাদিত রণাঙ্গনের মুখপত্র ‘বিপ্লবী বাংলাদেশ’ পত্রিকার পরিচালকদের একজন ছিলেন। ৭১ সালে তার বাড়ি লুট হয়। তখন দলিলপত্র,ব্যক্তিগত কাগজপত্র সবকিছুই খোয়া যায় তার আর নষ্ট হয়ে যায় বহু স্মৃতি। মো. ইউসুফ কালু কখনো রাজনীতিক, কখনো সাংবাদিক, কখনো সুধী সমাজের প্রতিনিধিত্ব করা, বহু গুণে গুণান্বিত একজন মানুষ।

শিক্ষা জীবনের প্রথমে ছাত্র ইউনিয়ন করেছেন তিনি। ৫২ সালে যোগ দেন ছাত্রলীগে। পরে জড়িয়ে পড়েন আওয়ামী রাজনীতির সঙ্গে। তিনি স্বৈরাচার বিরোধী ও প্রতিটি প্রগতিশীল আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন সক্রিয়ভাবে।

১৯৬২ সালে সাংবাদিকতা শুরু করেন। প্রথমে আজাদ ও পরে দৈনিক পয়গামের বরিশাল সংবাদদাতা হিসেবে কাজ করেছেন। বরিশাল প্রেসক্লাবের (বর্তমানে শহীদ আব্দুর রব সেরনিয়াবাত বরিশাল প্রেসক্লাব ) সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন ১৯৬২ সাল থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত। ফুটবল, ক্রিকেট, ভলিবল খেলায় পারদর্শী তিনি বরিশাল ক্রীড়া সংস্থারও সদস্য ছিলেন ১৯৬২-১৯৭৩ পর্যন্ত।

বাংলাদেশ সময়: ২০০৫ ঘণ্টা, মার্চ ২৯, ২০২১
এমএস/এএটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।