ঢাকা, সোমবার, ১৩ মাঘ ১৪৩১, ২৭ জানুয়ারি ২০২৫, ২৬ রজব ১৪৪৬

জাতীয়

বইয়ের রাখাল হতে চেয়েছিলেন শাহীন

শরীফ সুমন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮২৮ ঘণ্টা, অক্টোবর ৪, ২০২১
বইয়ের রাখাল হতে চেয়েছিলেন শাহীন

রাজশাহী: অভাব-অনাটনের সংসার। তাই বই হাতে নেওয়া হয়নি শাহীন আলম শেখের।

যাওয়া হয়নি স্কুলেও। তাই লেখাপড়াটাও হয়নি। মাত্র ১০ বছর বয়সেই সংসারের জোয়াল পড়ে কাঁধে। তাকে গ্রামের এক গৃহস্থবাড়িতে কাজে দেওয়া। সেখানে গরুর রাখালী করার দায়িত্ব দেওয়া হয় তাকে। কিন্তু ওই গৃহস্থবাড়ির ছেলে-মেয়েরা যখন পড়তে বসতো তখন তারও খুব পড়তে মন চাইতো। এরপর ভেতর ভেতর বই পড়ার স্বপ্ন বুনতে থাকে ছোট্ট শাহীন। চলতে থাকে গরুর রাখালীও।

একদিন রেলস্টেশনের প্ল্যাটফর্মে আনমনে বসেছিল শাহীন। তখন তিনি দেখে একজন হকার মাথায় করে বই বিক্রি করছেন। তা দেখে নতুন করে চিন্তা আসে শাহীনের মাথায়। ভাবতে থাকে গরুর রাখালী ছেড়ে বইয়ের রাখালী করলে কেমন হয়? বিক্রিও হবে হয়তো একদিন পড়াও হবে। সেই থেকে শুরু। তবে বই বিক্রি শুরু করলেও আর পড়াশোনা হয়নি শাহীনের। তাতে কী? বিক্রির জন্য বইপত্র নাড়াচাড়া করতে করতে এক সময় বই পড়তেও শিখে যায়। আজ সেই ছোট্ট শাহীনের বয়স ৫৫ বছর। একাডেমিক কোনো বিদ্যা শাহীনের পেটে না থাকলেও সশিক্ষত হয়ে উঠেছেন তিনি।  


ট্রেনে বই বিক্রি করেন শাহীন আলম শেখ। কিন্তু যে বই বিক্রি করেন সে বই আগেই তিনি পড়ে নেন। এভাবে যত বই বিক্রি করেন, তত বই-ই পড়া হয়ে যায় শাহীনের। অক্ষরজ্ঞান না থাকলেও অসংখ্য বই এরই মধ্যে পড়ে ফেলেছেন তিনি। এখনও পড়ছেন। নামিদামি লেখক ও মনীষীদের লেখা বইয়ের অনেক উক্তিই তার ঠোটস্থ। কোন বই কার লেখা? কবে প্রকাশ ইত্যাদি সব তথ্যই তার জানা। তার সঙ্গে অন্তত বই নিয়ে তর্কে জড়াতে হলে যে কাউকেই সাতবার ভেবে নিতে হবে।  
বলছিলাম শাহীন আলম শেখের কথা। পাবনা জেলার ঈশ্বরদী সদর পৌরসভার পশ্চিম টেংরি পেয়ারাখালী গ্রামে তার বাড়ি। বাবার নাম আলী আহম্মেদ শেখ। বাবার সংসারে তারা চার ভাই ও চার বোন। ভাতের মাড় খেয়ে দিন কাটাতে হয়েছে এমনও দিন কেটেছে শাহীনের। এখন নিজের সংসারে অনেকটায় স্বাবলম্বী তিনি। রোজ সকাল ৮টা ৪০ মিনিটে পাবনার ঈশ্বরদী রেলওয়ে জংশনে সিল্কসিটি আন্তঃনগর এক্সপ্রেস ট্রেনে বই নিয়ে চেপে বসেন শাহীন।  

রাজশাহী থেকে ঢাকাগামী সিল্কসিটি ট্রেনই তার গন্তব্য। এ ট্রেন ছাড়া আর অন্য কোনো ট্রেনে ওঠেন না তিনি। সকালে ঈশ্বরদী থেকে ট্রেন ওঠেন ঢাকা থেকে আবারও ফেরেন ঈশ্বরদী। সন্ধ্যা ৭টা ৪০ মিনিটে নামেন স্টেশনে।

রাজশাহী-ঢাকা বা ঢাকা-রাজশাহী রুটে সিল্কসিটি ট্রেনে যারা যাতায়ত করেন তারা অনেকেই এক নামে চেনেন শাহীন আলম শেখকে। তার কাছে খোঁজেন নতুন প্রকাশিত বিভিন্ন লেখকের বই। কারণ ট্রেনে ভ্রমণকারীদের কখোনই হতাশ করেন না শাহীন। কোনো পাইরেটেড কপি নয়, মূল বই-ই বিক্রির জন্য সংগ্রহ করেন।  বই দেখতে সুদূর কলকাতায়ও যান। বই কিনতে ঋণ নেন ব্যাংক থেকেও। আর নিজেরই রয়েছে সংগ্রহশালা। দেশের সব ভালো লেখকের বইয়ের কপি রাখেন নিজের সংগ্রহেও। ট্রেনে বিক্রি করার পর গ্রামে ফিরে মানুষকে বিনামূল্যে বই পড়তে দেন। রাজশাহীর বাঘার প্রয়াত পলান সরকার তার আদর্শ। এজন্য গ্রামের মানুষও তাকে একজন বইপাগল মানুষ হিসেবেই চেনেন।  

ট্রেনেই কথা হয় বই বিক্রেতা শাহীন আলম শেখের সঙ্গে৷ কথায় কথায় জানান, যাপিত জীবনের করুণ কাহিনী। বইয়ের প্রসঙ্গ উঠতেই শাহীন বলেন, রাজশাহী-ঢাকা-রাজশাহী রুটের আন্তঃনগর ট্রেন সিল্কসিটি এক্সপ্রেস ছাড়া আর কোনো ট্রেনে ওঠেন না। এই ট্রেনের সময়টা তার ব্যবসার সঙ্গে যায়। তার একাডেমিক পড়াশোনা না থাকলেও বইয়ের সর্বোচ্চ সংগ্রহ রাখার চেষ্টা করেন। কি নেই তার কাছে! এরিস্টটলের লেখা সরদার ফজলল করিমের অনুবাদ করা ‘পলিটিকস’ থেকে, বারাক ওবামার ‘মাই ফাদারস ড্রিম’, আহমদ ছফা রচনাসমগ্র, আবুল মনসুর আহমেদের ‘আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর’, হালের ক্রেজ হারুকি মুরাকামির লেখা ‘নরওয়েজিয়ান উড’ , বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘কারাগারের রোজনামচা’সহ বিচিত্র সব বই রয়েছে তার বিক্রিতব্য বইয়ের সংগ্রহে। পুরো ট্রেনে জ্ঞানের আলোর বিচ্ছুরণ ঘটাতে যেন তার এই সংগ্রই যথেষ্ট।

আরও যেসব বই ছিল সেগুলোর নাম দেখে মালুম হলো তার কাছে ‘হালকা’ কোনো বই-ই নেই! এগুলো ছাড়াও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, সৈয়দ মুজতবা আলী, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, হুমায়ূন আহমেদ, মুহম্মদ জাফর ইকবাল, হাসান আজিজুল হক, অরুন্ধতী রায়, মহিউদ্দিন আহমেদসহ অনেক নামিদামি লেখক, কবি, সাহিত্যিক ঔপন্যাসিকের বই রয়েছে তার ঝুলিতে। দারিদ্রতা নিয়ে বেড়ে ওঠা শাহীন আলম এই মধ্য বয়সে যেন দীপ্তোজ্জ্বল তারা হয়ে উঠেছেন। এমন প্রতিভা আর অর্জনগুলো বই বিক্রেতা শাহীন আলমের চোখ দুটোকে যেন দেদীপ্যমান করে তুলেছে। খুব বেশি চাওয়া-পাওয়া নেই। প্রায় ১২ ঘণ্টার এই ট্রেন ভ্রমণে দিনে ২/৩ হাজার টাকার বই বিক্রি হয়। এতে ৬/৭শ টাকা লাভ হয়। এতেই খুশি। ভ্রমণ ও বই তাকে বড্ড টানে। এজন্য ছোট্ট বেলার বই পড়ার নেশাকেই পেশা হিসেবে পেয়ে তিনি ভীষণ খুশি।

তিনি বলেন, ‘গরুর রাখালী ছেড়ে বইয়ের রাখাল হতে চেয়েছিলাম। তাই-ই হয়েছি। এখন আমার দুই হাতজুড়ে শুধু বই আর বই। আর হৃদয়েও।  

ব্যক্তি জীবন নিয়ে সন্তুষ্ট বলেও জানান শাহীন আলম শেখ। বলেন- এক ছেলে দুই মেয়ে রয়েছে তার। বড় মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন পাশের গ্রামেই। তার মেঝ ছেলেও বই বিক্রি করে। আর ছোট মেয়ে অনার্সের শিক্ষার্থী। পাশাপাশি মেয়েকে কম্পিউটার শেখাচ্ছেন। এর সঙ্গে কুটিরশিল্পের ওপরও প্রশিক্ষণ করাচ্ছে। বলেন- ‘মেয়ের একটা সুন্দর ভবিষ্যত দেখে যেতে পারলে মরেও শান্তি পাবো’।
 
বাংলাদেশ সময়: ০৮২৭ ঘণ্টা, অক্টোবর ০৪, ২০২১
এসএস/এএটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।