লক্ষ্মীপুর: সাত বছরের শিশু সাইমুন ইসলাম। পথ চেয়ে সে বসে আছে বিদেশ থেকে তারা বাবার ফেরার অপেক্ষায়।
গত ৩ অক্টোবর ওমানে ঘূর্ণিঝড় ‘শাহিন’-এ লক্ষ্মীপুরের একই পরিবারের তিন সদস্য নিহত হন। তাদের মধ্যে শামছুল ইমলাম একজন। বাড়িতে তার স্ত্রীসহ তিন মেয়ে ও এক ছেলে সন্তান রয়েছে। গত ২০ বছর থেকে ওমানে একটি খেঁজুর বাগানে শ্রমিক হিসেবে কর্মরত ছিলেন তিনি। আগামী এক মাস পর তার ছুটিতে বাড়িতে আসার কথা ছিল।
লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার পার্বতীনগর ইউনিয়নের মধ্যমকরধ্বজ গ্রামের শামছুল ইসলামের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, পুরো পরিবার শোকে কাতর। তার মাদরাসায় প্রথম শ্রেণিতে পড়ুয়া ছেলে আনমনে বাড়ির ওঠানে মাটি নিয়ে খেলা করছে। কাছে ডেকে তাকে তার বাবা কোথায় আছে জিজ্ঞেস করলে বিদেশে থাকার কথা জানায়। বলে, ‘আব্বুর সাথে মোবাইলে কথা হয়েছে। এক মাস পর আসবে। আসার সময় আমার জন্য খেলনা গাড়ি নিয়ে আসবে। ’
অবুঝ এ শিশুটি যখন তার বাবা ফিরে আসার স্বপ্ন দেখছে তখন তার বাবার মরদেহ বাক্সবন্দি হয়ে পড়ে আছে ওমানের একটি মর্গে। কবে মরদেহ দেশে আসবে, আর সেটির জানাজা এবং কবর দেওয়া হবে তা এখন পুরোপুরি অনিশ্চিত হয়ে আছে।
পরিবারের সদস্যরা জানান, শামছুল ইসমামের বড় তিন মেয়ে। এর মধ্যে দুই মেয়ের বিয়ে হয়েছে। ছোট মেয়ের এখনো বিয়ে হয়নি। আর শিশু পুত্রটি জানে না তার বাবা বেঁচে নেই। তার বারা ফিরে আসবেন এটাই তার ধারণা।
ঝড়ে শামছুল ইসলামের চাচাতো ভাই জিল্লুর রহমানও মারা গেছেন। পাশাপাশি তাদের বাড়ি। জিল্লুর তার বাবার একমাত্র সন্তান। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন তিনি। গত ১১ বছর আগে শামছুলের মাধ্যমে ওমান পাড়ি জমান জিল্লুর। বাড়িতে তার বাবা-মা, স্ত্রী ও চার সন্তান রয়েছে। সন্তানদের মধ্যে তিন ছেলে এক মেয়ে। ছোট মেয়ে জান্নাতের বয়স মাত্র দেড় বছর। আর বড় ছেলে রায়হানের বয়স ১৫। স্থানীয় একটি মাদরাসায় অস্মট শ্রেষিতে পড়ে সে। মেঝো ছেলে রাসেল (১১) পড়ে চতুর্থ শ্রেণিতে, আর চার বছরের রাশেদ এখনো বিদ্যালয়ে যাওয়া শুরু করেনি। জিল্লুরের পরিবার নির্ভর ছিল তার ওপর। মাসে ১৫-২০ হাজার টাকা পাঠাতো, তা থেকে বৃদ্ধ বাবা এবং মায়ের ওষুধ খরচ যেত। বাকি টাকা দিয়ে সাত সদস্যের সংসার চলতো। ছেলেকে হারিয়ে এখন চোখে মুখে অন্ধকার দেখছেন জিল্লুরের পিতা লুৎফর রহমান। চার বছর আগে পেশা ছেড়ে এখন বেকার তিনি। জিল্লুর রহমানের দেড় বছরের যে কন্যা সন্তান রয়েছে, তার সঙ্গে দেখা হয়নি তার। আর বাবার আদরও পাননি ছোট্ট শিশু জান্নাত। আর চার বয়র বয়সী শিশুপুত্র রাশেদও এখনো বুঝতে পারেনি তার বাবা নেই।
অন্যদিকে পরিবারের ছোট ছেলে আমজাদ হোসেন হৃদয়কে হারিয়ে তারা বাবা শহীদ উদ্দিনও অসহায় হয়ে পড়েছেন। ধার দেনা করে শামছুল ইসলামের মাধ্যমে ছেলেকে বিদেশ পাঠিয়েছেন। প্রায় দেড় বছরের মাথায় মারা গেলে ছেলেটি। তাই ঋণ পরিশোধ করতে পারেনি তারা।
তিনি বলেন, ছেলেটা দেশে আসলে তাকে বিয়ে করিয়ে ঘরে বৌ আনার স্বপ্ন দেখতাম। আর এখন মরদেহের অপেক্ষায় আছি। যেদিন মৃত্যু হয়েছে, ওইদিন বিকেলেও আমার সঙ্গে ফোনে কথা হয়েছে। তার কয়েকঘণ্টা পরই সে লাশ হলো। এটা আমার জন্য সবচেয়ে বড় কষ্টের।
নিহত তিনজনের পরিবারের সদস্য ও আত্মীয়-স্বজন ছাড়াও পুরো এলাকায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে। যারা মারা গেছেন তাদের মধ্যে জিল্লুর এবং আমজাদের পরিবারের আর্থিক অবস্থা একেবারে সঙ্কটাপন্ন। পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন তারা। তাদের মৃত্যুতে পরিবারের আয়ের উৎস বন্ধ হয়ে গেছে।
এলাকাবাসী জানান, সরকারিভাবে দ্রুত যদি মরদের ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করা হতো, তাহলে তাদের কষ্ট কিছুটা লাঘব হতো। এছাড়া আর্থিক সহযোগিতা করলে উপকৃত হতো তারা।
জেলা প্রশাসক মো. আনোয়ার হোছাইন আকন্দ বাংলানিউজকে বলেন, আমরা পরিবারের আবেদন পেলে মরদেহ দেশে ফিরিয়ে আনতে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় ও সেদেশের দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করবো।
ওমানে ঘূর্ণিঝড় ‘শাহিন’র আঘাতে লক্ষ্মীপুরের তিন প্রবাসী নিহত হন। তারা হলেন, সদর উপজেলার পার্বতীনগর ইউনিয়নের মধ্য মকরধ্বজ গ্রামের আব্দুল মজিদ চেরাংয়ের বাড়ির মৃত নুরুল আমিনের ছেলে শামছুল ইসলাম (৫০), চাঁন কাজী বাড়ির মো. লুৎফর রহমানের ছেলে জিল্লুর রহমান (৪০) ও হামিদ মিঝি বাড়ির শহিদ উল্যার ছেলে আমজাদ হোসেন হৃদয় (২৫)।
এদের মধ্যে শামছুল ইসলাম ও জিল্লুর রহমান আপন চাচাতো-জেঠাতো ভাই এবং আমজাদ হোসেন নিহত শামছুল ইসলামের বোনের ছেলে।
পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, ৩ অক্টোবর রাতে ওমানে ঘূর্ণিঝড় ‘শাহিন’র আঘাতে লক্ষ্মীপুরের একই পরিবারের তিন সদস্য নিহত হন। ভিন্ন ভিন্ন সময় বিভিন্ন এলাকায় তাদের মরদেহ খুঁজে পায় তাদের সহকর্মীরা। তাদের মরদেহ এখন ওমানের একটি মর্গে রয়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ১৫২২ ঘণ্টা, অক্টোবর ১০, ২০২১
এনটি