ঢাকা, শনিবার, ৩ মাঘ ১৪৩১, ১৮ জানুয়ারি ২০২৫, ১৭ রজব ১৪৪৬

জাতীয়

সাগরে চলছে খরা, ডাঙ্গায় মোরা মরা!

শফিকুল ইসলাম খোকন, উপজেলা করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮৪১ ঘণ্টা, নভেম্বর ৭, ২০২১
সাগরে চলছে খরা, ডাঙ্গায় মোরা মরা!

পাথরঘাটা (বরগুনা): জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধিতে সারাদেশে বাস, ট্রাক ও লঞ্চ চলাচল বন্ধ রয়েছে। এবার বন্ধ হয়েছে সমুদ্রগামী মাছ ধরার ট্রলারগুলো।

তেলের দাম না কমালে ট্রলার নিয়ে আর সাগরে যাবে না বরগুনার প্রায় ২ হাজার মাছ ধরা ট্রলারগুলো। এমনটাই জানিয়েছেন পাথরঘাটা মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের জেলে-ট্রলার মালিকরা। কয়েকদিন ধরে মৎস্যজীবীদের মুখে থাকলেও এবার প্রকাশ্যে এসে সাগরে যাওয়া বন্ধ ঘোষণা করেন তারা।

সমুদ্রগামী ট্রলারের জেলে মালিকরা জানান, এমনিতেই সাগরে মাছ নেই, তার ওপর আবার তেলের দাম বেড়েছে। এমন অবস্থায় সাগরে ট্রলার পাঠানো সম্ভব না। এ জন্য শনিবার থেকে পাথরঘাটা থেকে কোনো ট্রলার ছাড়েনি। সাগরে থাকা ট্রলারগুলো ফিরে আসার পর তাদের আর পুনরায় সাগরে যেতে দেয়া হবে না। কারণ যেখানে সাগরে মাছ নেই সেখানে বেশি দামে তেল কিনে লোকসান সম্ভব না। সাগরে মাছ শিকারের জন্য কত ট্রলার বা নৌকা রয়েছে তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান সরকারি বা বেসরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছে নেই।  

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের সমুদ্র সীমানায় দুই ধরনের ট্রলার বা বোট মাছ শিকার করে, একটি কাঠের তৈরি সাধারণ ট্রলার এবং অন্যটি আধুনিক বাণিজ্যিক বোট। ২০০৯/১০ সালে সামুদ্রিক মৎস্য দফতর, নৌ-পরিবহন অধিদফতর, জেলা প্রশাসন ও স্থানীয়দের নিয়ে একটি জরিপ করা হয়েছিল। প্রায় ৯ বছর আগের করা ওই জরিপে সাগরে সাধারণ কাঠের তৈরি ৬৭ হাজার ফিশ বোট গণনা করা হয়। স্থানীয় ট্রলার মালিকদের সংগঠনগুলোর কাছ থেকে পাওয়া তথ্যমতে মৌসুমে বঙ্গোপসাগরে এক লাখ ১০ হাজারের মত ট্রলার ইলিশ শিকার করে। তার মধ্যে বরগুনা জেলায় ছোট বড় মিলিয়ে দুই হাজারের বেশি ট্রলার রয়েছে। এছাড়াও নদ-নদীতে ডিজেল চালিত শ্যালো ইঞ্জিনের নৌকা ও অগভীর সমুদ্র ও মোহনায় ছোট ট্রলারে জেলেরা মাছ শিকার করে। এর সংখ্যাও প্রায় ২ লাখের মত। অর্থাৎ প্রতিদিন সাগর ও নদীতে মাছ শিকারে যাওয়া ট্রলার ও নৌকায় হাজার হাজার লিটার জ্বালানি তেলের দরকার হয়।

'ডিজেলের দাম কমাতে হবে, মৎস্য সেক্টর করতে হবে' এই স্লোগানকে সামনে রেখে রোববার বেলা ১১টায় পাথরঘাটা পৌর শহরের শেখ রাসেল স্কয়ার চত্বরে মানববন্ধন করেছে বরগুনা জেলা মৎস্যজীবী ট্রলার মালিক সমিতি, বরগুনা জেলা ফিশিং ট্রলার শ্রমিক ইউনিয়ন, বিএফডিসি মৎস্য আড়তদার সমিতি, বিএফডিসি মৎস্য পাইকার সমিতিসহ মৎস্য সেক্টরের সঙ্গে সম্পৃক্ত বিভিন্ন সংগঠনসহ কয়েক হাজার মানুষ অংশ নেন। পরে পাথরঘাটা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা
(ইউএনও) মাধ্যমে ৩ দফা দাবি উলে­খ করে প্রধানমন্ত্রীর বরাবরে একটি স্মারকলিপি দেন।  

দাবিগুলো হলো, অনতিবিলম্বে জ্বালানি তেলের দাম কমিয়ে পূর্ব নির্ধারিত মূল্য নির্ধারণ করা, বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশি জলসীমায় বিদেশি ট্রলার অনুপ্রবেশ বন্ধ করা এবং দেশীয় জলসীমায় নির্ধারিত জায়গায় ট্রলিং জাহাজ বাইচ করা নিশ্চিত করা।

এদিকে মৎস্যজীবীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এক একটা ট্রিপে যেতে তাদের ট্রলারে ৮০০ থেকে ১ হাজার লিটার ডিজেলের দরকার হয়। এরপর যদি খালি হাতে ফিরতে হয় তবে পুরোটাই লোকসান। জ্বালানি তেলের দাম দফায় দফায় বেড়েই চলছে। ডিজেলের দাম বাড়লেই বাস, ট্রাক লঞ্চের ভাড়া বাড়ে। তারা যাত্রীদের কাছ থেকে ভাড়া বেশি নিয়ে সমন্বয় করেন, কিন্তু উপকূলের অঞ্চলের জেলেরা কার ভাড়া বাড়াবে?

উপজেলার চরদুয়ানী ইউনিয়নের দণি চরদুয়ানী গ্রামের জেলে শাহ আলম, আব্বাস উদ্দিনসহ একাধিক জেলে বাংলানিউজকে বলেন, এমনিতেই সাগরে মাছ নাই, তাই সাগরে খরা যায়,
এর মধ্যে তেলের দাম বাড়ায় এখন আমরা মরা ছাড়া আর কিছুই নয়। হঠাৎ ডিজেলের দাম বাড়ার খবরে হতাশ এখন এসব জেলেরা।  

জেলেরা জানান, এমনিতেই এবার তারা কাঙ্ক্ষিত ইলিশ না পেয়ে লোকসানে আছেন। এর উপর দাম বাড়ায় এখন মাছ শিকার বন্ধ রাখতে হবে।  

বাংলাদেশের বৃহত্তম মৎস্য বন্দর পাথরঘাটার ট্রলার মালিক সেলিম মিয়া বাংলানিউজকে বলেন, আমার ৪টি ট্রলার সাগরে মাছ শিকার করে। প্রতি ট্রিপে একটি ট্রলারে ৮০০ থেকে ১ হাজার লিটার ডিজেল নিয়ে সাগরে পাঠাতে হয়, যার আগে দাম ছিল ৩৯ হাজার টাকা। এখন বাড়তি মূল্যে এখন কয়েকগুন টাকা গুনতে হবে। মৌসুমে একের পর এক ট্রিপে লসে আছি, এখন আবার ডিজেলের দাম বেড়েছে। ব্যবসা গুটিয়ে পথে বসা ছাড়া আমাদের উপায় নেই।

বাংলাদেশ ট্রলার মালিক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোস্তফা চৌধুরি বলেন, এবার এমনিতেই দক্ষিণাঞ্চলের সিংহভাগ ট্রলার মালিকেরা লাখ লাখ টাকা লোকসানে আছেন। এখন এ সময়ে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত আমাদের জন্য মরার ওপর খাড়ার ঘাঁ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটা আমাদের ট্রলার মালিকদের জন্য অসহনীয়।

তিনি আরও বলেন, সরকার জেলেদের কথা না ভেবেই ডিজেলের দাম বাড়িয়েছে। সাগরে মাছ থাকলেও সমন্বয় করা যেত। কিন্তু সাগরেও চলছে খরা। এই অবস্থায় এত দামে তেল কিনে আমাদের পোষাবে না। দাম না কমালে সাগরে ট্রলার পাঠাতে পারব না।

বাংলাদেশ সময়: ১৮১৭ ঘণ্টা, নভেম্বর ০৭, ২০২১
এনটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।