ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২ মাঘ ১৪৩১, ১৬ জানুয়ারি ২০২৫, ১৫ রজব ১৪৪৬

জাতীয়

নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসে জড়িত ব্যাংকের ৩ কর্মকর্তা

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮৩৬ ঘণ্টা, নভেম্বর ১০, ২০২১
নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসে জড়িত ব্যাংকের ৩ কর্মকর্তা

ঢাকা: সম্প্রতি ব্যাংকের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস করে একটি চক্র দুই শতাধিক পরীক্ষার্থীর কাছ ৬০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। চক্রটি এর আগেও অনুষ্ঠিত হওয়া চারটি নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করেছে বলেও তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে।

এই চক্রে তিনটি সরকারি ব্যাংকের তিন কর্মকর্তা প্রত্যক্ষভাবে জড়িত রয়েছেন।

অভিযান চালিয়ে ব্যাংকে নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসকারী চক্রের সরকারি ব্যাংকের তিন কর্মকর্তাসহ ৫ সদস্যকে গ্রেফতার করেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগ।

চক্রের গ্রেফতার সদস্যরা হলেন—প্রশ্ন ও উত্তর ফাঁসের মূল হোতা আহসানউল্লাহ বিশ্ববিদ্যায়ের আইসিটি টেকনিশিয়ান মোক্তারুজ্জামান রয়েল (২৬), জনতা ব্যাংকের গুলশান শাখার অফিসার শামসুল হক শ্যামল (৩৪), রূপালী ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার জানে আলম মিলন (৩০), পূবালী ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার মোস্তাফিজুর রহমান মিলন (৩৮) ও রাইসুল ইসলাম স্বপন (৩৬)।

বুধবার (১০ নভেম্বর) বিকেল সাড়ে ৩টায় ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) এ কে এম হাফিজ আক্তার।

বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক অনুষ্ঠিত ৫টি ব্যাংকের ১ হাজার ৫১১টি ‘অফিসার ক্যাশ’ পদের নিয়োগ পরীক্ষা গত ৬ নভেম্বর বিকেলে অনুষ্ঠিত হয়। এর মধ্যে সোনালী ব্যাংক ১৮৩টি, জনতা ব্যাংক ৫১৬টি, অগ্রণী ব্যাংক ৫০০টি, রূপালী ব্যাংক ৫টি এবং বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকে ৭টি পদ রয়েছে। বিকেল ৩টা থেকে ৪টা পর্যন্ত ঢাকার বিভিন্ন কেন্দ্রে এমসিকিউ পদ্ধতিতে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকার সিলেকশন কমিটির মাধ্যমে প্রশ্নপত্র তৈরি ও পুরো পরীক্ষা সম্পাদনের দায়িত্বে ছিল আহসানুল্লাহ ইউনিভার্সিটি অব সাইন্স অ্যান্ড টেকনোলজি।

সংবাদ সম্মেলনে এ কে এম হাফিজ আক্তার বলেন, গত ৬ নভেম্বর থেকে ১০ নভেম্বর পর্যন্ত বিশেষ অভিযান পরিচালনা করে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রশ্নফাঁসের ঘটনায় জড়িত ৫ জনকে গ্রেফতার করে ডিএমপির গোয়েন্দা তেজগাঁও বিভাগ।

গোয়েন্দা পুলিশের প্রাথমিক তদন্তে বেরিয়ে এসেছে, গ্রেফতার হওয়া সরকারি ব্যাংক কর্মকর্তাদের যোগসাজশে প্রশ্নপত্র প্রণয়নসহ নিয়োগ পরীক্ষা আয়োজনের দায়িত্বপ্রাপ্ত আহসানউল্লাহ ইউনির্ভাসিটি অব সাইন্স অ্যান্ড টেকনোলজির আইসিটি বিভাগ থেকে প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে। এ পর্যন্ত চক্রটি প্রশ্নপত্র ও উত্তরপত্র ফাঁসের মাধ্যমে চাকরিপ্রত্যাশীদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছে ৬০ কোটি টাকা।

তিনি বলেন, গত ৫ নভেম্বর দিবাগত রাতে এই পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হবে বলে তথ্য আসার পর ডিবির টিমটি ছদ্মবেশে পরীক্ষার্থী সাজিয়ে পরীক্ষার দিন (৬ নভেম্বর) সকাল ৭টায় প্রশ্নপত্রসহ উত্তর পাওয়ার জন্য চক্রের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। প্রশ্নপত্র ও উত্তরপত্র ফাঁস চক্রের অন্যতম হোতা রাইসুল ইসলাম স্বপনকে অগ্রিম টাকা পরিশোধ করা হলে তিনি পরীক্ষার্থীকে নিয়ে যান। এরপর পরীক্ষার উত্তরপত্রসহ স্বপনকে হাতেনাতে আটক করা হয়। গত ৬ নভেম্বর পরীক্ষায় আসা প্রশ্নের সঙ্গে সকালে পাওয়া প্রশ্ন ও উত্তর হুবহু মিলে গেলে আটক স্বপনের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে শ্রীনগর থেকে রূপালী ব্যাংকের সাভার শাখার সিনিয়র অফিসার জানে আলম মিলনকে গ্রেফতার করা হয়। পরে জানে আলম মিলনের তথ্যের ভিত্তিতে ঢাকার দক্ষিণ বাড্ডা থেকে প্রশ্নপত্র ও উত্তরপত্র সরবরাহকারী শামসুল হক শ্যামলকে গ্রেফতার করা হয়।

এ কে এম হাফিজ আক্তার বলেন, জিজ্ঞাসাবাদে শ্যামল প্রশ্নপত্রসহ উত্তরপত্র ফাঁস করার কথা স্বীকার করেছেন। তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে চক্রের মূল হোতা মুক্তারুজ্জামান রয়েলকে বাড্ডার আলিফনগর থেকে গ্রেফতার করা হয়। মুক্তারুজ্জামান আহসানউল্লাহ ইউনির্ভাসিটি অব সাইন্স অ্যান্ড টেকনোলজিতে আইসিটি টেকনিশিয়ান হিসেবে কর্মরত আছেন। পরে গ্রেফতার আসামিদের দেওয়া তথ্য, মোবাইল ফোনে থাকা তথ্য এবং হোয়াটসঅ্যাপ চ্যাটের তথ্যের ভিত্তিতে রাজধানীর লালবাগ থেকে প্রশ্নপত্র ও উত্তরপত্র ফাঁস চক্রের অন্যতম হোতা পূবালী ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার মোস্তাফিজুর রহমান মিলনকে গ্রেফতার করা হয়।

এই পুলিশ কর্মকর্তা আরও বলেন, পরীক্ষার আগে চক্রের সদস্যরা রাজধানীর বাড্ডা, উত্তরা, মোহাম্মদপুর, কল্যাণপুর, রূপনগর, মিরপুর, মাতুয়াইল, শেওড়াপাড়া, শেরে বাংলানগর, পল্লবী এলাকায় বুথ বসান। সেখানে পরীক্ষার ৫/৬ ঘণ্টা আগে নিজস্ব লোকের মাধ্যমে পরীক্ষার্থীদের ফাঁস করা প্রশ্ন ও উত্তরপত্র মুখস্থ করানো হয়। চক্রের সদস্যদের তত্ত্বাবধানে প্রত্যেক বুথে ২০/৩০ জন পরীক্ষার্থীকে পরীক্ষার প্রশ্ন ও উত্তর মুখস্থ করিয়ে কেন্দ্রে পাঠানো হয়।

জিজ্ঞাসাবাদে, মুক্তারুজ্জামান ও শ্যামল জানান, এর আগে আরও তিনটি বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন ও উত্তর ফাঁস করেছেন তারা। তারা পরীক্ষার ৫/৬ ঘণ্টা আগেই বিভিন্ন সোস্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে প্রায় ২ হাজার পরীক্ষার্থীদের মাঝে ওই পরীক্ষার প্রশ্ন ও উত্তর সরবরাহ করেছেন। প্রত্যেক পরীক্ষার্থীদের কাছ থেকে নিয়োগ পাওয়ার আগ পর্যন্ত বিভিন্ন ধাপে ৫ থেকে ১৫ লাখ টাকা পর্যন্তও নিয়েছেন তারা। এমসিকিউ পরীক্ষার আগে ২০ শতাংশ, লিখিত পরীক্ষার আগে আরও ২০ শতাংশ ও নিয়োগ পাবার পর বাকি ৬০ শতাংশ টাকা পরিশোধের শর্তে পরীক্ষার্থীদের সঙ্গে চুক্তি করতেন।

পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, আমরা এ পর্যন্ত ১১টি বুথ, চক্রের ২৫/৩০ জনের নাম এবং প্রায় ২০০ জন পরীক্ষার্থীর নাম পেয়েছি। মোক্তারুজ্জামান রয়েল প্রশ্নত্তোর ফাঁসের মূল হোতা। মোক্তারের কাছ থেকে প্রশ্ন নিয়ে শামসুল হক শ্যামল বিভিন্ন বুথে সরবরাহ করেন। জানে আলম মিলন পরীক্ষার্থী সংগ্রহ ও বুথ নিয়ন্ত্রণ করেন, পরীক্ষার্থীদের প্রশ্ন-উত্তর মুখস্থ করান, অর্থের মাধ্যমে প্রশ্ন-উত্তর দেন। মোস্তাফিজুর রহমান মিলন পরীক্ষার্থী এবং বুথ নিয়ন্ত্রণ করেন। এ পর্যন্ত এই চক্রের শনাক্ত সদস্য সংখ্যা ২৫/৩০ জন বলে জানা গেছ।  

এক প্রশ্নের জবাবে ডিবি প্রধান বলেন, এই প্রশ্নফাঁস চক্রের সঙ্গে আহসান উল্লাহ ইউনিভার্সিটিসহ বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটির কেউ জড়িত থাকলে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এই চক্রে আর যারা জড়িত তাদের গ্রেফতারে অভিযান চলছে।

অভিযোগ সত্ত্বেও বাংলাদেশ ব্যাংক দাবি করেছিল প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়নি। ডিবির অভিযানে প্রমাণিত হচ্ছে প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছিল। বিগত তিনটি পরীক্ষার নিয়োগ প্রক্রিয়া বাতিলের সুপারিশ গোয়েন্দা পুলিশ করবে কিনা? জানতে চাইলে হাফিজ আক্তার বলেন, আমরা ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংককে প্রশ্নপত্র ফাঁসের তথ্য জানিয়েছি।

আরও পড়ুন: ব্যাংকে নিয়োগ পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁস, গ্রেফতার ১০

বাংলাদেশ সময়: ১৮৩৪ ঘণ্টা, নভেম্বর ১০, ২০২১
এসজেএ/এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।