ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

সুপারির রাজ্য লক্ষ্মীপুর

মো. নিজাম উদ্দিন, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১৪৮ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৯, ২০২১
সুপারির রাজ্য লক্ষ্মীপুর

লক্ষ্মীপুর: সুপারি লক্ষ্মীপুরের একটি অর্থকরী ফসল। জেলার প্রায় প্রতিটি বাড়িতে রয়েছে সুপারি গাছ।

আর প্রতিটি ঘরে ১২ মাসই শুকনো বা কাছা সুপারি থাকেই। মৌসুমে সুপারি বিক্রি করে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হচ্ছেন অনেকে। এছাড়া মৌসুমী এ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত রয়েছেন জেলার অনেক মানুষ। প্রায় সারাদেশেই চাহিদা রয়েছে লক্ষ্মীপুরের সুপারির।

লক্ষ্মীপুরের মাটি এবং আবহাওয়া সুপারি চাষের জন্য উপযোগী। তাই প্রতিটি স্থানেই দেখা মেলে গাছটির। অল্প পরিমাণ জমিতে বেড়ে উঠায় রাস্তার পাশে, বাড়ির আঙ্গিনায়, ঝোপ-ঝাড়ে, ফসলি খেতের কাছে, পুকুর বা খাল পাড়সহ আনাচে-কানাচে লাগানো হয় গাছটি। জেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি সুপারি বাগান রয়েছে রায়পুর উপজেলাতে। জেলার মোট সুপারির প্রায় অর্ধেক সুপারি উৎপন্ন হয় এ উপজেলায়। এছাড়া লক্ষ্মীপুরের দক্ষিণ অঞ্চলের তুলনায় উত্তর এবং পশ্চিম অঞ্চলে সুপারির আবাদ বেশি হচ্ছে।

এসব অঞ্চলের প্রায় সব শ্রেণির মানুষ প্রতি হাটেই সুপারি বিক্রি করে সেই টাকা দিয়ে নিত্য প্রয়োজনীয় বাজার-সদাই করেন। সুপারির মৌসুমে এটি যেন একটি রেওয়াজে পরিণত হয়। লক্ষ্মীপুরে সুপারির সবচেয়ে বড় হাট সদর উপজেলার দালালবাজারে। প্রতি শুক্রবার সেখানে বড় পরিসরে সুপারির হাট বসে।

তবে লক্ষ্মীপুর উত্তর তেমুহনী, জকসিন, মান্দারী, বটতলী, হাজিরপড়া চন্দ্রগঞ্জ, ভবানীগঞ্জ, রায়পুরের হায়দরগঞ্জ, বাসাবাড়ি, মোল্লারহাটসহ জেলা এবং উপজেলার সবগুলো বাজারেই বসে সুপারি ক্রয়-বিক্রয়ের হাট। এছাড়া প্রায় প্রত্যেক গ্রামগঞ্জের আনাচে-কানাচে এবং রাস্তার মোড়ে খুচরা ব্যবসায়ীরা গেরস্তো থেকে সুপারি ক্রয় করে বাজারগুলোতে এনে পাইকারী দামে বিক্রি করে।

লক্ষ্মীপুরে সুপারি গননা হয় পোন এবং ক্রাউনে। ৮০টি সুপারিতে এক পোন এবং ১৬ পোনকে এক ক্রাউন ধরা হয়।

বৃহস্পতিবার বিকেলে সরেজমিনে দেখা যায়, লক্ষ্মীপুরের উত্তর তেমুহনীতে জমজমাট সুপারি ক্রয়-বিক্রয়ের হাট বসেছে। আকার ভেদে পাকা প্রতি পোন সুপারি বিক্রি হচ্ছে ১১০ থেকে ১৩০ টাকা পর্যন্ত। আর কাঁচা সুপারির পোন বিক্রি হচ্ছে ৬০-৭০ টাকায়। তবে প্রতি হাটে বাজার মূল্য উঠানামা করে বলে জানান ব্যবসায়ীরা। এখন সুপারির বাজার মূল্য কিছুটা কম।

আলামিন নামে এক মাদরাসা ছাত্র ৫ পোন সুপারি নিয়ে এসেছেন হাটে বিক্রি করার জন্য। সাড়ে পাঁচশ টাকায় তিনি সুপারিগুলো বিক্রি করেন। এ টাকা দিয়ে তিনি লেখাপাড়ার খরচ চালাবেন বলে জানান।

কথা হলে আব্দুর রহমান নামে আরেক গেরস্তো জানান, ৭ পোন সুপারি তিনি বিক্রি করেছেন ৮শ’ টাকার। এ টাকা দিয়ে পরিবারের জন্য বাজার সদাই করবেন তিনি।

রুহুল আমিন নামে ওই বাজারের একজন খুচরা ব্যবসায়ী বলেন, তিনি গেরস্তো থেকে পোন হিসেবে সুপারি ক্রয় করে পাইকারী ব্যবসায়ীদের কাছে ক্রাউন হিসেবে বিক্রি করেন। প্রতি ক্রাউনে তার ১৬০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত লাভ হয়। দিনে যত বেশি সুপারি কিনতে পারেন, তত বেশি আয় হয় তার।  

একই বাজারের পাইকারী ব্যবসায়ী মাইন উদ্দিন জানান, তিনি খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে সুপারি কিনে ট্রাক ভরে চট্টগামে নিয়ে যান। সেখানে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বড় ব্যবসায়ীরা আসেন। তাদের কাছে তিনি সুপারি বিক্রি করেন।

অনেক সুপারি বাগানের মালিক খুচরা সুপারি বিক্রি না করে মৌসুমের আগেই পুরো বাগান বিক্রি করে দেন। আবার কেউ কেউ শুকিয়ে বা পানিতে ভিজিয়ে বিক্রি করেন।

সদর উপজেলার পৌর এলাকার দক্ষিণ মুজুপুর গ্রামের বাগান মালিক মো. দুলাল উদ্দিন জানান, তিনি পৌনে এক একরের সুপারি বাগান এক মৌসুমের জন্য ৩৫ হাজার টাকায় বিক্রি করে দিয়েছেন।

একই এলাকার আরেক বাগান মালিক আবুল কালাম জানান, তার প্রায় দুই একরের দুটি বাগান রয়েছে। তিনি মৌসুমে সুপারি বিক্রি না করে শুকিয়ে বিক্রি করেন। এছাড়া পানের সঙ্গে খাওয়ার জন্য তাদের অনেক সুপারির প্রয়োজন। তাই শুকনো সুপারি সারাবছর সংরক্ষণ করে খেতে পারেন। অবশিষ্ট সুপারি বাজারে বিক্রি করে দেন তিনি। এছাড়া বড় আকারের গাছপাকা সুপারি তিনি দীর্ঘদিন পানিতে ভিজিয়ে খান।

সুপারির মৌসুমে ব্যবসায়ী বা বাগান মালিকদের আর্থিক স্বচ্ছলতার পাশাপাশি যারা গাছ থেকে সুপারি সংগ্রহ করেন, তারাও আর্থিকভাবে লাভবান হন।    

মো. কাশেম নামে এক ব্যক্তি বলেন, আমি মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাদের গাছ থেকে সুপারি নামিয়ে দিই। প্রতি গাছ বাবদ আমাকে সুপারি বা নগদ টাকা দিতে হয়। এতে প্রতিদিন আমার ৪-৫শ’ টাকা আয় হয়।

কাশেমের মতো অনেকেই সুপারির মৌসুমে গাছ থেকে সুপারি সংগ্রহের কাজ করেন।

কয়েকজন সুপারি বাগান মালিক ও গেরস্তোর সঙ্গে কথা বলেন জানা গেছে, সুপারি লাভজনক ফসল হওয়ায় প্রত্যেকে পতিত জমিতে সুপারির চারা বা বীজ রোপণ করেন তারা। মৌসুমে ভালো মানের সুপারিগুলো বীজ হিসেবে সংরক্ষণ করে তা মাটিতে পুতে রাখেন। বর্ষা মৌসুমে খালি জমিতে বা বাড়ির আঙ্গিনায় চারা গাছ রোপন করেন। তেমন কোনো পরিচর্যা ছাড়াই প্রাকৃতিক পরিবেশে গাছ বড় হতে থাকে। ৫-৭ বছরের মধ্যেই গাছে ফল আসতে শুরু হয়। একবার ফল দেওয়া শুরু করলে প্রতিটি গাছ ২৫-৩০ বছর পর্যন্ত ফলন দিতে থাকে। তবে গাছের বয়স যত বেশি হবে, ফলনের পরিমাণ তত কমতে থাকবে। প্রাপ্ত বয়স্ক একটি গাছে মৌসুমে ৪-৫ পোন সুপারি ধরে।

তারা আরও জানান, দিন দিন সুপারির বাগানের পরিধি কমতে শুরু করেছে। বাগান উজাড় করে ঘর-বাড়ি নির্মাণের ফলে সুপারির উৎপাদন কমে যাচ্ছে।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের হিসেব মতে, লক্ষ্মীপুরে ৬ হাজার ৮৮১ হেক্টর জমিতে সুপারির বাগান রয়েছে। গেল মৌসুমে ১৬ হাজার ৭৯০ মেট্র্রিক টন শুকনো সুপারি উৎপন্ন হয়েছে। যার বাজার মূল্য ছিলো প্রায় চার শ’ কোটি টাকা। গেল বছরের চেয়ে চলতি মৌসুমে সুপারির উৎপাদন ভালো হয়েছে। এতে উৎপাদন এবং বিক্রয় মূল্য গেল বছরের চেয়ে আরও বেশি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বনে জানায় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মুহাম্মদ আবুল হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, লক্ষ্মীপুর মেঘনা নদীর উপকূলীয় এলাকা। ফলে পলি মাটির পরিমাণ বেশি থাকায় সুপারির আবাদ বেশি হচ্ছে। আর অল্প জমি এবং যে কোন ধরণের উঁচু জমিতে অধিক পরিমাণে গাছ লাগানো যায় বিধায় সবাই সুপারি চাষের প্রতি আগ্রহী হচ্ছে।

বাংলাদেশ সময়: ১১৪৮ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৯, ২০২১
জেডএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।