খুলনা: প্রথমবারের মতো এ বছর উত্তর আমেরিকার ফসল কিনোয়ার চাষ হয়েছে খুলনার সুন্দরবন সংলগ্ন উপকূলীয় উপজেলা কয়রায়। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের সার্বিক সহযোগিতায় কয়রায় চাষ হচ্ছে পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ সুপার ফুড কিনোয়া।
জানা গেছে, এ ফসল ধান চাষের চেয়েও লাভজনক। কিনোয়া কাউনের মতো দেখতে। এটি উচ্চমান সম্পূর্ণ পুষ্টিকর খাদ্য ও ক্যালোরি যুক্ত দানাদার খাবার। ভাত, রুটির বিকল্প হিসেবে ইউরোপ, দক্ষিণ আমেরিকা, উত্তর আমেরিকা, চীন ও ভারতের মানুষ খায়। শের-ই-বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় দীর্ঘ ৫ বছর ধরে কিনোয়া জাতের ফসল নিয়ে গবেষণা করছে। সেই গবেষণার পর মাঠ পর্যায়ে গত বছর ২০২১ সালে কিছু চাষ করা হয়। কিন্তু এ বছর ব্যাপকভাবে চাষ হচ্ছে। আর তারই ধারাবাহিকতায় চাষ শুরু করছে কয়রায়।
সরেজমিন গবেষণা বিভাগের বৈজ্ঞানিক সহকারী জাহিদ হাসান বাংলানিউজকে বলেন, এটি উচ্চমান সম্পূর্ণ পুষ্টিকর খাদ্য ও ক্যালরি যুক্ত দানাদার খাবার। ভাত, রুটির বিকল্প হিসেবে ইউরোপ, দক্ষিণ আমেরিকা, উত্তর আমেরিকা, চীন ও ভারতের মানুষ খায়। কিনোয়া ফসলের শস্য দানার রং তিন ধরনের হয়ে থাকে সাদা, লাল ও কালো।
কয়রা উপজেলার ৪ নম্বর কয়রা গ্রামের কৃষানি টুম্পা রাণী সরদার জানান, কিনোয়া সম্পর্কে তার আগে কোনো ধারণা ছিল না। সরেজমিন গবেষণা বিভাগের পক্ষ থেকে জানানো হয়, কিনোয়া লাভজনক ফসল। তাদের পরামর্শে নিজ বাড়ির জমিতে কিনোয়া চাষ করা হয়। সরেজমিন গবেষণা বিভাগ ইতোমধ্যে বীজ ও সার সহায়তা দিয়েছে। মাঠ পর্যায়ে ফসলের চাষ পদ্ধতি শিখিয়েছে। তবে এ কিনোয়া চাষে কোনো রাসায়নিক সারের ব্যবহার করা হয়নি। শুধু জৈব সার ব্যবহার করা হয়েছে।
সরেজমিন গবেষণার বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মুস্তফা কামাল শাহাদাৎ বলেন, কিনোয়া লবণ ও খরা সহনশীল ফসল। এজন্য এ ফসল চাষ করলে কৃষকরা লাভবান হবে। কিনোয়ার আন্তর্জাতিক বাজারে ব্যাপক চাহিদা রয়েছে।
কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট খুলনার প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. হারুনর রশিদ জানান, কিনোয়া হলো হাই প্রোটিন সম্পন্ন খাবার। এটিকে সুপার ফুডও বলা হয়। কিনোয়াতে আ্যামিনো অ্যাসিড থাকে এবং লাইসিন সমৃদ্ধ, যা সারা শরীরজুড়ে স্বাস্থ্যকর টিস্যু বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য খুবই উপকারী। কিনোয়া আয়রন, ম্যাগনেশিয়াম, ভিটামিন-ই, পটাশিয়াম ও ফাইবারের একটি উৎকৃষ্ট উৎস। রান্না করা হলে এর দানাগুলো আকারে চার গুণ হয়ে যায়। খরা ও লবণাক্ত অঞ্চলসহ সারাদেশে রবি মৌসুমে এ ফসলটি চাষ করা সম্ভব হবে। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের সর্বাধিক ঝুকিপূর্ণ দেশসমূহের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। সেক্ষেত্রে খরা ও লবণাক্ততা সহনশীল ফসল হিসেবে সম্ভাবনায় হয়ে উঠতে পারে নতুন ফসল কিনোয়া। তাই কয়রায় প্রথমবারের মতো শুরু করা হয়েছে এ দানাজাত ফসল। আগামীতে আরও অনেক জায়গায় কিনোয়া চাষাবাদ শুরু করা হবে।
কিনোয়া কিন্তু খাদ্য হিসেবে অত্যন্ত প্রাচীন। উৎপত্তিগত দিক থেকে দক্ষিণ আমেরিকার এ ফসলের নিদর্শন ও বর্ণনা পাওয়া যায় প্রাচীন ইনকা সভ্যতার সাক্ষী সব পুরাকীর্তি খুঁজতে গিয়ে। নৃতত্ত্ববিদরা জানিয়েছেন, সেই সাত হাজার বছর আগে দক্ষিণ আমেরিকার আন্দেস অঞ্চলে কিনোয়া ফলানো হতো। ইনকা ভাষায় একে কিনোয়া বা খাদ্যশস্যের জননী বলা হতো। একে পবিত্রও মনে করা হতো। এর কারণ ইনকা যোদ্ধারা অমিত শক্তির অধিকারী হতেন কিনোয়া খেয়ে, এমনটাই বিশ্বাস ছিল প্রাচীন ইনকাদের মধ্যে। পরবর্তী সময়ে পুষ্টিবিজ্ঞানীরা কিনোয়ার পুষ্টিগুণ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে রীতিমতো অবাক হয়ে গেছেন। আধুনিক যুগে এ সুপারফুডের প্রচলন এতটাই সময়োপযোগী ও প্রয়োজনীয় মনে করা হয় যে ২০১৩ সালটিকে আন্তর্জাতিক কিনোয়া বর্ষ ঘোষণা করা হয়েছিল জাতিসংঘের পক্ষ থেকে।
ফসলটির পুষ্টি সমৃদ্ধতার কারণে ল্যাটিন আমেরিকাভুক্ত দেশে দানা, ফ্লেক্স, পাস্তা, রুটি, বিস্কুট, বেভারেজ হিসেবে কিনোয়া ব্যবহার করে আসছে। বর্তমানে উত্তর আমেরিকা, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, ইতালি, সুইডেন, ডেনমার্ক, নেদারল্যান্ডস, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, চীন, থাইল্যান্ড, ভারতসহ ৯৫টিরও অধিক দেশে কিনোয়া চাষাবাদ হচ্ছে। এসব দেশের পুষ্টি সমৃদ্ধ খাদ্য তালিকায় স্থান পেয়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ১৬৫১ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৭, ২০২২
এমআরএম/আরবি