ঢাকা: বাংলাদেশে প্রতিবছর বাজেট ঘোষণার সময় আসলেই বিড়ির ওপর করবৃদ্ধি ঠেকাতে শ্রমিকদের আন্দোলন করতে দেখা যায়। এমনকি বাজেট পাস হওয়ার পরও এই আন্দোলন চলতে থাকে।
গবেষণায় দেখা গেছে, বিড়ি শ্রমিকদের এই আন্দোলন আয়োজনের পুরো দায়িত্বে থাকে মালিক পক্ষের কিছু লোক এবং বিড়ি কোম্পানির মার্কেটিং অফিসার ও এজেন্ট। বিক্ষোভ সমাবেশ ও মানববন্ধন কর্মসূচিগুলোতে তথাকথিত শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে কোম্পানির লোকজনও বক্তৃতা দেয়। শ্রমিকদের কাজ শুধু রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা। মূলত সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে শ্রমিকদের ঢাকায় নিয়ে আসে বিড়ি কোম্পানির মালিকরা। আন্দোলনে অংশ নেওয়ার জন্য শ্রমিকদের পরিবহন, খাবারসহ সব ব্যয় মালিক পক্ষ বহন করে। নিজস্ব অর্থ দিয়ে এসব আন্দোলনে অংশ নেওয়ার সামর্থ্য দরিদ্র বিড়ি শ্রমিকদের নেই।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এবং জাতীয় তামাকবিরোধী মঞ্চের আহ্বায়ক ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেন, ‘গবেষণার ফলাফলের সঙ্গে আমি একমত। এটা একটা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ খাত। সরকারের উচিত হবে এই শিল্পকে নিরুৎসাহিত করা। ’
অনুষ্ঠানে সভাপতির বক্তব্যে সিটিএফকে, বাংলাদেশের লিড পলিসি অ্যাডভাইজর মো. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘শ্রমিক শোষণের বড় উদাহরণ হচ্ছে বিড়ি শিল্প। সাজানো আন্দোলনে প্রকৃত লাভবান হয় মালিক পক্ষই। ’
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক চেয়ারম্যান ড. নাসির উদ্দিন আহমদ বলেন, ‘বিড়ি শ্রমিকদের আন্দোলন যে সাজানো সে বিষয়ে আমি শতভাগ একমত। কারণ এনবিআর চেয়ারম্যান থাকা অবস্থায় আমি এগুলো দেখেছি। ’
জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেলের সমন্বয়কারী ও অতিরিক্ত সচিব হোসেন আলী খোন্দকার বলেন, ‘বিড়ি শিল্পে শিশু শ্রম ব্যবহার বন্ধ করতে কঠোর মনিটরিং করতে হবে। ’
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্রাটেজিক স্টাডিজের (বিআইআইএসএস) গবেষণা পরিচালক ড. মাহফুজ কবীর বলেন, ‘স্বল্প আয়ের মানুষরাই বিড়ির প্রধান ভোক্তা। উচ্চ হারে করারোপ করে বিড়ির ব্যবহার নিরুৎসাহিত করতে হবে। ’
গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্যে দেখা গেছে, আকিজ বিড়ি কোম্পানিই মূলত এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে থাকে এবং বাংলাদেশের যেসব অঞ্চলে আকিজ বিড়ির কারখানা রয়েছে সেসব জায়গায় এই আন্দোলন সবচেয়ে বেশি হয়। রংপুরের আজিজ বিড়ি, মায়া বিড়ি এবং পাবনার বাংলা বিড়ির মালিকপক্ষও শ্রমিকদেরকে আন্দোলনে নিয়ে যায়। এছাড়া স্থানীয় ছোট বিড়ি কারখানার কিছু মালিক এবং তাদের প্রতিনিধি ব্যবসা টিকিয়ে রাখার জন্য এসব আন্দোলনে অংশ নেয়। দাম বাড়লে বিড়ি বন্ধ হয়ে যাবে, শ্রমিকদের কাজ থাকবে না, সরকার বিড়ি শিল্প বন্ধ করে দিতে চায় এসব ভয় দেখিয়ে শ্রমিকদের আন্দোলনে নামায় মালিক পক্ষ। অনেক ক্ষেত্রে আন্দোলনে অংশ না নিলে শ্রমিক কার্ড বাতিল কিংবা কারখানা বন্ধ রাখার হুমকিও দেওয়া হয়। ফলে বিড়ি শ্রমিকরা বাধ্য হয়ে করবৃদ্ধি ঠেকানোর আন্দোলনে অংশ নেন।
গবেষণায় বিড়ি শ্রমিকদের কল্যাণে নিয়োজিত কোনো শ্রমিক সংগঠনের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। বিড়ি শ্রমিকদের অ্যাসোসিয়েশন হিসেবে দাবি করা সংগঠনগুলো মূলত মালিকদের স্বার্থ রক্ষায় কাজ করে। প্রকৃত বিড়ি শ্রমিকরা এসব সংগঠনের সদস্য নয়। বিড়ি কারখানাগুলোতে শ্রমিক ইউনিয়ন বা অ্যাসোসিয়েশন খোলার অনুমতি দেওয়া হয় না বরং বিভিন্ন কারখানায় শ্রমিকরা অ্যাসোসিয়েশন চালু করার চেষ্টা করায় অনেকেই কাজ হারিয়েছেন বলে গবেষণায় উঠে এসেছে।
গবেষণায় দেখা গেছে, বিড়ি শ্রমিকদের এই আন্দোলনে প্রকৃত লাভবান হয় বিড়ি মালিকরাই। ২০১৯ সালে বিড়ি শ্রমিকদের আন্দোলনের ফলে বিড়ির উপর বর্ধিত কর প্রত্যাহার করে নেয় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। ফলে এক হাজার শলাকা বিড়িতে মালিকদের আয় বাড়ে ২৮ টাকা। অথচ শ্রমিকদের মজুরি বাড়ানো হয় প্রতি হাজারে মাত্র ৬ টাকা। উল্লেখ্য, বাজেটে বিড়ির শুল্ক না বাড়িয়ে কেবল খুচরামূল্য বাড়ানোয় ২০১৮-২০২০ এই তিন বছরে প্রতি ১ হাজার শলাকায় মালিকদের মুনাফা বেড়েছে ১১৮.৮ টাকা।
গবেষণায় দরিদ্র জনগোষ্ঠির মধ্যে তামাকের ব্যবহার নিরুৎসাহিত করতে বিড়ির ওপর উচ্চহারে করারোপ করা, বর্ধিত কর থেকে আহরিত রাজস্ব বিড়ি শ্রমিকদের পুনর্বাসন ও বিকল্প কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে ব্যয় করা, কর আইন ও শ্রম আইন বিশেষত শিশুশ্রম ব্যবহার সংক্রান্ত আইন প্রতিপালনে বিড়ি শিল্পকে কঠোর মনিটরিংয়ের আওতায় আনা এবং বিড়ি শিল্প মালিকদের বিকল্প ব্যবসায় যেতে সরকারের পক্ষ থেকে ঋণসহ অন্যান্য সহযোগিতা দেওয়ার সুপারিশ করা হয়।
আত্মা’র কো-কনভেনর নাদিরা কিরণের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে গবেষণার ফলাফল তুলে ধরেন প্রজ্ঞার হাসান শাহরিয়ার। আত্মার কনভেনর মর্তুজা হায়দার লিটন, গ্লোবাল হেলথ অ্যাডভোকেসি ইনকিউবেটর (জিএইচএআই) এর বাংলাদেশ কান্ট্রি লিড মুহাম্মদ রূহুল কুদ্দুস, প্রজ্ঞার নির্বাহী পরিচালক এবিএম জুবায়েরসহ বিভিন্ন গণমাধ্যম প্রতিনিধি এবং তামাকবিরোধী সংগঠনের নেতারা অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন।
বাংলাদেশ সময়: ১৮২৩ ঘণ্টা, ১২মার্চ, ২০২২
টিআর/এমএমজেড