ঢাকা, শুক্রবার, ২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১৭ মে ২০২৪, ০৮ জিলকদ ১৪৪৫

জাতীয়

পানি ব্যবস্থাপনায় প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামো গড়ে তুলতে হবে

রেজাউল করিম রাজা, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১২৫ ঘণ্টা, মার্চ ২১, ২০২২
পানি ব্যবস্থাপনায় প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামো গড়ে তুলতে হবে ড. আইনুন নিশাত -ফাইল ছবি

ঢাকা: দেশে খাওয়া, সেচ ও শিল্পায়নের জন্য পানির চাহিদা বাড়ছে। তাই অবিলম্বে পানি ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে সমন্বিত প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামো গড়ে তুলতে হবে বলে উল্লেখ করেছেন পানি সম্পদ ও জলবায়ু পরিবর্তন বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাত।

মঙ্গলবার (২২ মার্চ) বিশ্ব পানি দিবস দিবস উপলক্ষে বাংলানিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে তিনি এ কথা জানান।

২২ মার্চ বিশ্ব পানি দিবস। ১৯৯৩ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী দিবসটি পালিত হচ্ছে। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য হচ্ছে ‘ভূগর্ভস্থ জল: অদৃশ্যকে দৃশ্যমান করা’।

দিবসটি উদযাপনের মূল লক্ষ্য হলো বিশ্বব্যাপী পানি সঙ্কট সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ৬-এ বর্ণিত ২০৩০ সাল নাগাদ সবার জন্য নিরাপদ পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা নিশ্চিতকরণ কার্যক্রমকে বেগবান করা।

ড. আইনুন নিশাত বলেন, বাংলাদেশে পানির কোনো দাম নেই। পানিকে পানির দামেই ব্যবহার করা হয়। বেনজামিন ফ্রাঙ্কলিনের একটা কথা আছে, ‘পানির দাম তখনই বোঝা যায়, যখন অনেক দূর থেকে হেঁটে কুয়ার কাছে এসে দেখা যায়, কুয়াটা শুঁকনো। তার আগ পর্যন্ত পানির দাম বোঝা যায় না। ’

বাংলাদেশের পানি ব্যবস্থাপনায় ভূগর্ভস্থ পানির দিকে নজর ছিল। ১৯৭২ সালের আগ পর্যন্ত বাংলাদেশের প্রধান ফসল ছিল আমন ধান। এই ধান ছিল বৃষ্টি নির্ভর, তারপরও কৃষকদের কিছু সম্পূরক সেঁচের ব্যবস্থা রাখতে হত। তখন আশপাশের ডোবা নালা, খাল বিলে প্রচুর পানি থাকতো, সেখান থেকেই পানি সেচ দিয়ে আমন ধান আবাদ করা হত। আমাদের দেশে সেচের যত বড় বড় প্রকল্প আছে, সবগুলোই হচ্ছে বর্ষাকালে সম্পূরক সেচ দেওয়ার প্রকল্প।

তিনি বলেন, ১৯৭২ সালের পর বোরো ধান চাষের দিকে নজর দেওয়া হয়। বর্তমানে বোরো ধান হচ্ছে বাংলাদেশের প্রধান ফসল। খাদ্য নিরাপত্তা পুরোপুরি নির্ভরশীল হচ্ছে আমন ও বোরো ধানের ওপরে। এর মধ্যে বোরো ধান প্রধান। আবার এই বোরো ধান সম্পূর্ণ সেচ নির্ভর। এই সেচের ৮০ শতাংশ হচ্ছে ভূগর্ভস্থ পানি থেকে। সুতরাং আমাদের দেশের খাদ্য নিরাপত্তা ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীল। এটা আমরা কেউ অনুধাবন করি না। আমরা ডেল্টা প্লান বলি, কিংবা তার আগে যতগুলো জাতীয় পরিকল্পনা হয়েছে, তার সবগুলোই  ভূগর্ভস্থ পানিকে লক্ষ্য রেখে। ১৯৫০, ৬০ এবং ৭০ এর দশকে বন্যাকে ফসলের প্রধান শত্রু মনে করা হত। তাই বন্যা ব্যবস্থাপনায় নজর দিয়েছি, কিন্তু ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবস্থাপনায় নজর দেওয়া হয়নি।

খাবার পানির প্রসঙ্গ উল্লেখ করে তিনি বলেন, দ্বিতীয়ত হচ্ছে খাবার পানি। আমরা কুয়ার পানি, পুকুরের পানি খেতাম। পুকুরের পানি সংরক্ষিত করা থাকতো, সেই পানি নিরাপদে পান করা যেত। ক্রমান্বয়ে পানির ওপর চাপ বাড়ায় পানি দূষিত হওয়া শুরু হয়। সেচের ব্যবহার শুরু হওয়ায় ভূগর্ভস্থ পানিও কমে যায়।

তিনি বলেন, বিশেষজ্ঞরা মনে করলেন ভূগর্ভস্থ পানি নিরাপদ, তাই টিউবওয়েল বসিয়ে পানি খাওয়া শুরু হল। কিন্তু সেই পানিতেও শহরাঞ্চলে দূষণ, আর গ্রামাঞ্চলে আর্সেনিক পাওয়া গেল। দূষণ, অতিরিক্ত পানি উত্তোলন এবং ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ার কারণে সেটাও এখন সহজলভ্য নয়। এরই মধ্যে আবার আমাদের ভূ-উপরিস্থিত পানি ব্যবহারের যে ব্যবস্থা ছিল, সেটাও নষ্ট হয়ে গেছে। এখন আবার পদ্মা, মেঘনা, হালদা থেকে পানি আনার কথা হচ্ছে।  

তিনি আরও বলেন, জেলা শহরগুলো এখনও ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীল। সুতরাং এই যে সম্পদ যা আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা এবং খাবার পানির চাহিদা পূরণ করছে, তার ব্যবস্থাপনায় আমরা নজর দেই নাই। এই অদৃশ্য সম্পদের মূল্য আমরা বুঝিনি। এখন সময় হয়েছে এই অদৃশ্য সম্পদের সৎ ব্যবহার করার। কোথায় কী পরিমাণ পানি আছে, কী কী সমস্যা আছে, সেটা বের করা।   ভূগর্ভস্থ এবং ভূ-উপরিস্থিত পানির ব্যবহারের মধ্যে একটা সামঞ্জস্য আনতে হবে। গুণগত মানের দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। পাশাপাশি পানির অপচয় রোধ করতে হবে। পানির জন্য কোন দাম দিতে হয় না, তাই আমরা পানির অপব্যবহার করি।  

শিল্পক্ষেত্রে পানির ব্যবহার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে এই বিশেষজ্ঞ বলেন, খাবার পানি এবং সেচ ছাড়াও তৃতীয় ফ্যাক্টর হচ্ছে, শিল্পের জন্য পানি। আমরা বড় বড় টিউবওয়েল বসিয়ে পানি তুলে কলকারখানা চালাচ্ছি। তাই শিল্পের জন্যও পানির ব্যবস্থাপনা করা দরকার। তাই খাবারের পানি, সেচের ও শিল্পায়নের জন্য পানি, এই তিন বিষয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য এনে জাতীয় পরিকল্পনা করে এখনই একটা ব্যালেন্সিং অ্যাক্ট করতে হবে। কিন্তু তার জন্য আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক কোন ব্যবস্থা নেই। তাই অবিলম্বে পানি ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামো গড়ে তুলতে হবে।

পানির বাড়তি চাহিদার উল্লেখ করে আইনুন নিশাত আরও বলেন, মানুষ বাড়ছে, সেই সঙ্গে পানির চাহিদাও বাড়ছে। সেঁচের জন্য, খাবারের পানির জন্য, স্যানিটেশন এবং শিল্পায়নের জন্য পানির চাহিদা বাড়ছে। গ্রামের লোক পুকুরে একটা ডুব দিয়ে আসলেই হয়, কিন্তু নগরের লোকদের প্রচুর পানি লাগে, নগরায়নে প্রচুর পানির চাহিদা বাড়ছে। তাই পানি ফ্রি পাওয়া যায়, এটা ভুলে গিয়ে জাতীয়ভাবে সমন্বিত পরিকল্পনা নিতে হবে, আরও আগে এটা করা উচিৎ ছিল। পানি সবার জন্যে ফ্রি হতে পারে না।

বাংলাদেশ সময়: ০৯২৭ ঘণ্টা, মার্চ ২২, ২০২২
আরকেআর/এমএমজেড

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।