পাবনা: স্বাধীনতার ৫০ বছর উদযাপন উপলক্ষে পাবনায় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মতবিনিময় করেছেন কথাসাহিত্যিক ও ইস্ট ওয়েস্ট মিডিয়া গ্রুপ লিমিটেডের পরিচালক ইমদাদুল হক মিলন। মুক্তিযুদ্ধ ও নতুন প্রজন্ম শীর্ষক মতবিনিময়সভায় অংশগ্রহণ করেন পাবনার বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা।
শনিবার (২৬ মার্চ) সকালে মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উপলক্ষে পাবনা টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজ মাঠে পাবনার বিভিন্ন স্কুল ও কলেজের চার শতাধিক শিক্ষার্থী অংশ নেন। ইমদাদুল হক মিলনের মুখ থেকে নানাধরনের মুক্তিযুদ্ধের ঘটনা শুনে আবেগে আপ্লুত হয় শিক্ষার্থীরা, ক্ষণে ক্ষণে তাদের চোখ মুছতে দেখা যায়।
শিক্ষার্থীদের মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনাতে গিয়ে ইমদাদুল হক মিলনের চোখেও জল আসে, তাকেও চোখ মুছতে দেখা যায়।
ইমদাদুল হক মিলন বলেন, নতুন প্রজন্মকে অবশ্যই বাংলাদেশ ও স্বাধীনতাযুদ্ধ সম্পর্কে জানতে হবে। কারণ, বাংলাদেশের জন্য বাঙালিরা যুদ্ধ করেছিল বলেই আজ স্বাধীন দেশ পেয়েছি। তোমরা এখানে বসতে পেরেছ।
মুক্তিযুদ্ধে তরুণ প্রজন্ম ও শিক্ষার্থীদের সাহসী অবদানের কথা স্মরণ করে মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনাতে গিয়ে তিনি বলেন, গজারিয়া একটি জায়গা, এই জায়গাটি হচ্ছে মুন্সিগঞ্জের শীতলক্ষা নদীর পাড়ে। সেখানে একটা ব্রিজ আছে। খবর পাওয়া গেল যে পাকিস্তানিরা আসবে। এই ব্রিজটা ভেঙে ফেললে পাকিস্তানিরা এখানে ঢ়ুকতে পারবে না। তা গ্রামের লোকজন ব্রিজটি ভাঙতে গেছে তাদের সঙ্গে তোমাদের বয়সী সাতজন বাচ্চা ছেলেও গিয়েছে যারা সিক্স, সেভেন, এইট, নাইনে পড়ে। তারাও গিয়েছে। তারাও ব্রিজ ভাঙার কাজ করছে। কিন্তু ব্রিজ ভাঙা শেষ হওয়ার আগেই আর্মি ওখানে এসে পড়েছে। মিলিটারিরা এসে গ্রামে ঢুকে গেছে। সব লোক, বড় যারা, বয়স্ক যারা, তারা পালিয়ে গেছে, বাচ্চাগুলো পালাতে পারেনি।
এই সাতটি ছেলে তোমদের বয়সী। সাতটি ছেলে পালাতে পারেনি। তারা ভাবল যে আমরা কবরস্থানের মধ্যে ঢুকি, আমরা শুনেছি পাকিস্তানিরা মুসলমান আমরাওতো মুসলমান। আমরা যদি কবরস্থানে ঢুকে কবরের সামনে বসে থাকি এবং দোয়া দরুদ পড়তে থাকি তাহলে ওরা আমাদের মারবে না। এই ছেলেগুলো সেখানো গিয়ে বসেছে। এক জায়গায় বসে সবাই দোয়া পড়ছে। পাকিস্তানিরা সেখানে ঢুকল এবং বাচ্চাগুলোকে কিন্তু গুলি করে মারল। বাচ্চাগুলোকে বেয়োনেট চার্জ করে মারল। বেয়োনেট জিনিসটা বুঝো, বেয়োনেট হচ্ছে রাইফেলের ডগায় একটা ছুরি লাগানো থাকে। তোমরা দেখবে চকচকা একটা ছুরি লাগানো থাকে রাইফেলের ডগার সঙ্গে। সেটা দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে, খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে ছেলেগুলোকে মেরেছিল।
আর একটি মেয়ের কথা তোমাদের বলি। বিলোনিয়া বলে একটি জায়গা আছে কুমিল্লায়। সেই নদীতে, নদীটা ছোট, নদীর এক পাশে ধরে নাও এইটা নদী, এই পাশে পাকিস্তানিরা বাঙ্কার করেছে তারা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে রেডি। এ পাশে এসে আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা বাঙ্কার করে যুদ্ধ করছে প্রতিদিন। প্রতিরাত মুখোমুখি যুদ্ধ হচ্ছে, মানে এপার-ওপার আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা যেখানে বঙ্কার করেছে তার পেছনেই একটি গ্রাম আছে। সেই গ্রামে পানি নেই, কোনো চাপকল নেই, কতগুলো পুকুর আছে পুকুরগুলো নষ্ট হয়ে গেছে। মাঝে মধ্যে এই নদীটা থেকে এসে মানুষ পানি নিয়ে যায়, খাওয়ার পানি। একদিন এক মা তার বাচ্চা মেয়েটিকে তোমাদের বয়সী হবে ১২/১৩ বছর। সে মেয়েটিকে বলছে দেখ বড়রা ওই জায়গাটিতে গেলে আমাদের গুলি করে দেবে পাকিস্তানিরা, তুই যা। একটা কলসি নিয়ে, যা যতটুকু পানি পারিস ওই নদী থেকে নিয়ে আয়। আমাদের খাওয়ার জন্য।
মেয়েটি একটা পানির মাটির কলস কাখে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সে নদীর তীরে আসছে। তখন সে মুক্তিযোদ্ধাদের বাঙ্কারের সামনে দিয়ে যাচ্ছে। মেয়েটি যখন পানি আনতে যাচ্ছে তখন বাঙ্কার থেকে একজন মুক্তিযোদ্ধা বলল- দেখ তুমিতো পানি আনতে যাচ্ছ, আমাদের বাঙ্কারটাতে গত তিন দিন ধরে পানি নেই, আমরা পানি খেতে পারছি না, আমরা যুদ্ধ করছি গলা শুকিয়ে গেছে। পাকিস্তানিদের ভয়ে উঠে যে পানি আনব, ওরা তো দেখলেই গুলি করবে অবিরাম গুলি ছুড়ছে। মানে কাউকে দেখলেই গুলিটা হয়। তুমি আমাদের এক কলস পানি এনে দেবে। মেয়েটি বলছে আমি আমার কলসটা ভরে প্রথমেই আপনাদের পানিটা দিয়ে যাব। তারপর আমাদের বাড়ির পানিটা নিয়ে যাব।
মেয়েটি গিয়ে মাটির কলসে পানি ভরে কাঁখে নিয়েছে, ওপার থেকে পাকিস্তানিরা দেখেছে যে একটা বাচ্চা মেয়ে পানি নিয়ে যাচ্ছে, ওরা তাকিয়ে আছে যে, মেয়েটি কি করে। দেখা গেল মেয়েটি বাঙ্কারের সামনে এসে তার কলস রাখবার আগেই পাকিস্তানিরা বুঝে গেছে মেয়েটি মুক্তিযোদ্ধাদের পানি পৌঁছে দিচ্ছে। ওরা গুলি শুরু করল। গুলি শুরু করল মেয়েটিকে। মেয়েটি ভাবল, এখনতো গুলিতে আমার কলসটা ঝাঁঝরা হয়ে যাবে, পানিটা পড়ে যাবে, আমিতো মুক্তিযোদ্ধাদের পানিটা পৌঁছে দিতে পারব না। তখন সে কি করল; মাটির কলসটাকে বুঁকের সামনে এনে ধরল, ধরে পিছন ফিরে হাঁটতে শুরু করল, অর্থাৎ গুলি লাগলে যেন তার পিঠে লাগে।
পাকিস্তানিরা গুলি করতে শুরু করল এবং মেয়েটির পিঠে লাগল। ঝাঁঝরা হয়ে গেল; মেয়েটি গুলিতে গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গেল, কিন্তু সে কলসটা ফেলেনি, সে ভাবল আমি মরে যাই, যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করছে আমি তাদের একটু পানি খাইয়ে বাঁচাবার চেষ্টা করি। সে মেয়েটি এনে, যখন পানির কলসটা রাখল, কলসের সঙ্গে সঙ্গে সে-ও পড়ে গেল, রক্তে ভেসে গেছে। মেয়েটি মারা গেছে কিন্তু সে মুক্তিযোদ্ধাদের পানিটা পৌঁছে দিয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধ ও নতুন প্রজন্ম শীর্ষক মতবিনিময় অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন পাবনা টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজের অধ্যক্ষ হাফিজুর রহমান, পাবনা সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ আব্দুল মান্নান, কালের কণ্ঠ শুভসংঘ পাবনা জেলা শাখার উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য কামরুন নাহার লুনা, কালের কণ্ঠ শুভসংঘের কেন্দ্রীয় কমিটির পরিচালক জাকারিয়া জামান, শুভসংঘ পাবনা জেলা শাখার উপদেষ্টা মাহবুবুল আলম ফারুক, নিউজটোয়েন্টিফোরের পাবনা প্রতিনিধি আহমেদুল হক রানা, কালের কণ্ঠ পাবনা প্রতিনিধি প্রবীর কুমার সাহা, যমুনা সমাজকল্যাণ সংস্থার নির্বাহী পরিচালক মো. মনজেদ আলী, শুভসংঘ পাবনা জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক সুচিত্রা পুজা, সহসভাপতি সাহেরা আক্তার উর্মি, সহসম্পাদক মো. শেখ ফকরুল ইসলাম লিয়ন, সাংগঠনিক সম্পাদক জীবন কুমার সরকার, অর্থ সম্পাদক হাবিবুর রহমান স্বপন, প্রচার প্রকাশনা সম্পাদক শুক্লা খাতুন, নারী বিষয়ক সম্পাদক রুখশানারা শবনম, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সম্পাদক আশিকুল আলম তমাল, দপ্তর সম্পাদক আসাদুল ইসলাম জনম, শুভসংঘ সুজানগর উপজেলা কমিটির সভাপতি জাহিদুর রহমান টিটু।
অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন শুভসংঘ পাবনা জেলা কমিটির উপদেষ্টা আলি আকবর রাজু।
বাংলাদেশ সময়: ২১০৪ ঘণ্টা, মার্চ ২৬, ২০২২
এনটি