ঢাকা, বুধবার, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ মে ২০২৪, ২৮ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

আন্দোলন সফল করতেই কি তাহলে ‘হিজাব বিতর্ক’

সাগর ফরাজী, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২৩২ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৮, ২০২২
আন্দোলন সফল করতেই কি তাহলে ‘হিজাব বিতর্ক’

সাভার (ঢাকা): সাভারের আশুলিয়ায় চুল দিয়ে বিভিন্ন পণ্য তৈরির একটি কারখানায় হিজাব নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। কারখানাটির বিউটি সেকশন নামের একটি শাখার শ্রমিকরা ১৬ এপ্রিল এই আন্দোলন করেছেন।

বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আলোচনার জন্ম দিয়েছে।  

কারখানার কর্তৃপক্ষ বলছে, কাজের পিস রেট বৃদ্ধির (বেতন বৃদ্ধি) আন্দোলন সফল করতে হিজাব বিতর্কে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এছাড়া একজন কর্মকর্তার চক্রান্তে হিজাবের বিষয়টি সামনে এনে আন্দোলন সফল করার চেষ্টা করেছে। কারখানার কাউকে হিজাব খুলতে বলেনি কেউ। যেনো দুর্ঘটনা না ঘটে সে জন্য হিজাবের মুখের অংশের পরিবর্তে মাস্ক এবং হাতের ঝুলে থাকা অংশ কেটে চাপিয়ে নেওয়ার কথা বলা হয়েছে।

অন্যদিকে শ্রমিকরা বলছেন, হিজাব ও বেতন দুই বিষয়ে আন্দোলন করা হয়েছে। সেই সঙ্গে সুপারভাইজারের চাকরি পূর্ণবহালের জন্য দাবি করা হয়েছে। হিজাবের কথা বলতে গিয়েই সুপারভাইজারের চাকরি হারিয়েছেন ও তাদের বেতনও কমেছে বলে মনে করছেন শ্রমিকরা।

এর আগে ১৬ এপ্রিল সকালের আন্দোলনে শ্রমিকদের বিভিন্ন দাবি প্রশাসন ও শ্রমিক নেতাদের সামনে মেনে নিয়ে শ্রমকিদের সঙ্গে সমাধানের সিদ্ধান্তে এসেছে কারখানা কর্তৃপক্ষ। এর মধ্যে রয়েছে-ঈদ পর্যন্ত আন্দোলনরত শ্রমিকরা সর্ম্পূণ ছুটিতে থাকবেন, ঈদের ছুটি শেষে আন্দোলনরত শ্রমিকরা আবার কাজে ফিরবেন এবং এপ্রিল মাসের বেতন ও ঈদের বোনাস ২৩ তারিখের ভেতর দেওয়া হবে।

এই হিজাব কাণ্ডের পেছনের ঘটনা জানার জন্য রোববার (১৭ এপ্রিল) সকালে কারখানায় গিয়ে শ্রমিক ও কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা হয়েছে বাংলানিউজের। কারখানায় পরিবেশ সুন্দর দেখা গেছে নারী শ্রমকিরা যে যার মতো হিজাব পরে বা হিজাব ছাড়া কাজ করছেন।

কারখানার কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, চায়নাদের ইয়াংজিন ইন্টারন্যাশনাল কোম্পানির একটি লাইনের অর্ধশতাধিক শ্রমিক কয়েক মাস ধরে কারখানায় উৎপাদিত বিভিন্ন পণ্যের মজুরি বাড়ানোর দাবি জানিয়ে আসছিলেন। ১১ এপ্রিল এই দাবিতে শ্রমিকরা কাজ না করে কারখানা থেকে বের হয়ে গিয়ে কর্মবিরতি পালন করেন। পরে গতকাল আবার আন্দোলনের সময় কিছু শ্রমিক হিজাব নিয়ে কথা বলেন। শ্রমিকদের লাইনের সুপার ভাইজার ফেরদৌস হোসেন তালুকদার এই চক্রান্তটি করে শ্রমিকদের উস্কে দেন।

হিজাব আন্দোলনে উপস্থিত থাকা শ্রমিক পারুল আক্তার বাংলানিউজকে বলেন, আমাদের বেতন উৎপাদনের ওপর নির্ভর করে। আর এই উৎপাদিত পণ্যের মজুরি (পিস রেট) একদম কম। এছাড়া আমাদের মালিক যখন কারখানা পরিদর্শনে আসেন তখন সবাইেকে হিজাব খুলে কাজ করতে বলেন। তাই আমাদের আন্দোলন দুই বিষয়েই ছিল। এক হিজাব ও দুই পিস রেট অর্থাৎ বেতন বাড়ানো।  

কারখানার সুপারভাইজার ফেরদৌস হোসেন তালুকদার বাংলানিউজকে বলেন, শ্রমকিরা প্রথম আন্দোলন শুরু করে হিজাব নিয়েই। সেই হিজাবের ঘটনায় কারখানা কর্তৃপক্ষ মেনে নিলেও সেই প্রভাব পরে বেতনের ওপর। এরপর এটা নিয়ে আমি ও শ্রমকিরা কথা বলতে গেলে সাবাইকে কারখানা থেকে বের করে দিয়েছেন। আসলে হিজাবের বিষয়টি কারখানা কর্তৃপক্ষ এড়িয়ে গিয়ে এখন সেই চাপ পিস রেটএর ওপর দিচ্ছেন।  

কারখানার প্রশাসন বিভাগের কর্মকর্তা ইমরান হাসেম বাংলানিউজকে বলেন, এক মাস আগে কারখানা পরিদর্শনে আসেন আমাদের বিদেশি মালিক। এ সময় হিজাব পরা শ্রমিকদের হিজাবের সামনের অংশ মেশিনের সামনে ঝুলে ছিল। এছাড়া হাতের অংশ মেশিনের ভেতরে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। বিষয়টি দেখে যেকোনো সময় দুর্ঘটনা ঘটার শঙ্কা করেন মালিক। তখন শ্রমিকদের হিজাবের সামনের অংশের পরিবর্তে মাস্ক পরে ও হাতের অংশে চাপিয়ে কাজ করলে দুর্ঘটনা ঘটার ঝুঁকি কম বলে জানান তিনি। কারখানার শ্রমিকরা হিজাব পরে কাজ করার কথা জানালে মালিক মেনে নেন। সেদিনই এই আলোচনা শেষ হয়ে যায়। হঠাৎ এক মাস পর গত শনিবার হিজাবের বিষয়টি সামনে এনে বিতর্কের সৃষ্টি করেন শ্রমিকরা।

কারখানাটির চাইনিজ ব্যবস্থাপক ইয়ং হং টাউ ফ্রেংক বাংলানিউজকে বলেন, আসলে কিছু শ্রমিক আমাদের কাজের মজুরিতে সন্তুষ্ট ছিলেন না। আমরা কাজের মজুরি কিছুটা বাড়ানোর জন্য সময় নিয়েছিলাম। এই বিষয়টি নিয়ে আমাদের এক কর্মকর্তার ইন্ধনে কয়েকদিন থেকেই কারখানায় কর্মবিরতি করেন শ্রমিকরা। পরে ১৬ এপ্রিল এই আন্দোলন হিজাবের বিষয়ে নিয়ে যান শ্রমকিরা। পরে পুলিশ ও স্থানীয়রা মিলে আন্দোলন থামিয়ে শ্রমিকদের সব দাবি আমাদের মানতে বললে আমরা মেনে নেই।

তিনি বলেন, আমরা বাইরে দেশ থেকে ব্যবসা করতে এসেছি এই দেশে। এতে এই দেশের মানুষেরও লাভ আমাদেরও লাভ। কিন্তু কিছু কিছু বিষয় আমাদের এই দেশে বিনিয়োগের ব্যাপারে অনীহা জন্মায়। আমি এই বিষয়টির সুষ্ঠুভাবে তদন্ত করার জন্য সরকারের কাছে অনুরোধ করবো।

প্রশাসনের পক্ষ থেকে শ্রমিক ও কারখানা কর্তৃপক্ষের সমস্যা সমাধানের সময় উপস্থিত ছিলেন শিল্প পুলিশ-১ এর সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসাই) মো মিরন ইসলাম। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, প্রতি পিস কাজের রেট বাড়ানো জন্য আন্দোলন করেছেন শ্রমিকরা। কারখানার মালিকের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। মালিক বলছেন আমরা কখনো হিজাব পরতে নিষেধ করিনি। সামনেও কখনো করবো না। আর শ্রমিকরা কাজের রেট বৃদ্ধি ব্যাপারে একটি প্রস্তাবনা দিয়েছেন, মালিক বিষয়টি দেখবেন বলে জানিয়েছেন।  

বাংলাদেশ সময়: ১২৩১ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৮, ২০২২
এসএফ/এসআইএস
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।