ঢাকা, শুক্রবার, ২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১৭ মে ২০২৪, ০৮ জিলকদ ১৪৪৫

জাতীয়

ঈদ হামার খাইলো হুড়কা আর বানে!

খোরশেদ আলম সাগর, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১১৪ ঘণ্টা, মে ২, ২০২২
ঈদ হামার খাইলো হুড়কা আর বানে! তিস্তার পাড়ে বসে আছেন চাষিরা। ছবি: বাংলানিউজ

লালমনিরহাট: ‘চৈত মাসের বান (বন্যা) আর বৈশাখের হুড়কা (ঝড়) বাতাসে খাইলো হামার এবারকার (এ বছরের) ঈদ। চৈত মাসের বান ও বৈশাখে হুড়কা বাতাস আর এত বড় বড় শিলাবৃষ্টি জীবনে কোন দিন দেখং নাই বাহে।

ঈদের প্রস্তুতি কেমন জানতে চাইলে লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার মহিষখোচা ইউনিয়নের গোবর্দ্ধন গ্রামের কৃষক মোক্তার আলী (৭০) এ কথা বলেন।

মোক্তার আলী জানান, তিস্তার বাম তীরে বসবাস করা প্রতিটি পরিবার একাধিকবার তিস্তা নদী ভাঙনের শিকার হয়েছেন। বসতভিটার সঙ্গে বিলিন হয়েছে ফসলি জমি। শুষ্ক মৌসুমে তিস্তার বুকে জেগে উঠা বালু চরে কঠোর পরিশ্রম করে ধান, আলু, তামাক, পিঁয়াজ, রসুন, ভুট্টা, বাদামসহ নানান জাতের ফসল বুনেন চরাঞ্চলের কৃষকরা। শুষ্ক মৌসুমের এ ফসল থেকে বন্যাসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের জন্য সঞ্চয় করেন তারা। শুধু তাই নয়, মেয়ের বিয়ে ও সব উৎসব চলে এই ফসলে। মূলত শুষ্ক মৌসুমের ৩/৪ মাসের ফসলে চলে তাদের পুরো বছর। তাই সব বিনিয়োগ করে শুষ্ক মৌসুমে ফসল বুনেন তিস্তা চরাঞ্চলের মানুষ। প্রতি বছর শুষ্ক মৌসুমের এসব ফসল বর্ষার আগেই ঘরে তুলেন চাষিরা। কিন্তু এ বছর চৈত্র্য মাসে হঠাৎ বৃষ্টি আর উজানের পাহাড়ি ঢলে তিস্তার পানি বৃদ্ধি পেয়ে অসময়ে বন্যার সৃষ্টি করে। অসময়ের এ বন্যার পানিতে ডুবে নষ্ট হয় কৃষকদের সর্বস্ব বিনিয়োগে উৎতি ফসল। এতেই শেষ নয়, বৈশাখ মাসের শুরু থেকে প্রায় প্রতি দিনই বৃষ্টি হচ্ছে তিস্তা পাড়ে। এ মাসেই কয়েক দফায় আঘাত হেনেছে কালবৈশাখী ঝড়। এ ঝড়ে লণ্ডভণ্ড হয়েছে বন্যার রেখে যাওয়া উচ্ছিষ্ট ফসল। লণ্ডভণ্ড হয়েছে ঘর বাড়ি। এক দিকে ফসলহানী অন্যদিকে কালবৈশাখীর ছোবলে ভেঙেছে আশ্রয়স্থল। সবমিলে নিদারুন কষ্টে চলছে তিস্তা চরাবাসীর জীবন।

প্রকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোতে নেই ঈদের কোন আমেজ। তাদের মধ্যে শুধু হতাশা আর হাহাকার। ঈদ উদযাপন নয় বরঞ্চ আসন্ন বন্যা মোকাবিলা নিয়ে চিন্তিত তিস্তা পাড়ের মানুষ। প্রতি বছর বন্যার জন্য যা সঞ্চিত থাকে। তা এ বছর বন্যাই নষ্ট করেছে। ঈদ প্রস্তুতি কেমন জানতে চাইলে গোবর্দ্ধন গ্রামের মোক্তার আলী বলেন, হামার এবারকার ঈদ খাইছে হুড়কা আর বানে। সব কিছু বিক্রি করি ধান,তামাক, ভুট্টা আর পিঁয়াজ-রসুন আবাদ করেছি। পাকা পাকা অবস্থায় চৈত মাসের বানে ডুবি সব নষ্ট হইছে। যেটুকু ছিল তা শিলাবৃষ্টি আর হুড়কাতে শেষ। এখন যে খামো তার বুদ্ধি নাই। ফির যে বান আসিবার নাগছে তখন কি খামো। এগুলো চিন্তায় এবার ঈদ হামার এত্তি নাই বাহে। সরকারিভাবেও কোন খোঁজ-খবর নেয় না কেউ। কোন সহায়তাও হামরা পাই নাই।

তার কথার সঙ্গে যুক্ত হয়ে মফিজ উদ্দিন বলেন, উঁচু জমির আবাদের চেয়ে চরাঞ্চলের জমির ফলন ভালো হয়। দ্বিগুণ উৎপাদন হয়। একবারের আবাদ দিয়ে সারা বছর চলি। এই আবাদে বিয়াও বাদি (বিয়ে সাদি), ঈদ, রোজা সউগ চলে বাহে। সেই আবাদ এবার বানের পানিতে ডুবি গেইছে। তখনে হামার ঈদও মাটি (নষ্ট) হইছে বাহে।  শুক্রবার (২৯ এপ্রিল) রাতে লালমনিরহাট জেলায় আঘাত হানে কালবৈশাখী ঝড়। এতে ৫টি উপজেলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ৪টি উপজেলায় তালিকা অনুযায়ী ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে সরকারিভাবে ত্রাণ বিতরণ করেন জেলা প্রশাসক আবু জাফর। শুধু আদিতমারী উপজেলায় জনপ্রতিনিধিরা তালিকা না দেওয়ায় ক্ষতিগ্রস্তদের সরকারিভাবে সহায়তা দিতে পারেনি উপজেলা প্রশাসন।

আদিতমারীর সারপুকুর ইউনিয়নের পাঠানটারী গ্রামের আবুল হোসেনের ছেলে রিকশাচালক রেয়াজুলের একমাত্র ঘরটি ভেঙে গেলে খোলা আকাশের নিচেই মানবেতর জীবনযাপন করছেন। একই গ্রামের মনিরের ছেলে হাকিমের দুই ঘর লণ্ডভণ্ড হয়েছে কালবৈশাখীর ছোবলে। তারাও তিন দিন ধরে খোলা আকাশের নিচে। সহায়তা তো দূরের কথা কেউ দেখতেও আসেনি তাদের। ক্ষতিগ্রস্ত আব্দুল হাকিম বলেন, হামার আরও ঈদ আছে ভাই। থাকার দুইটা ঘর। দুইটাই ভাঙ্গি গেছে। তিন দিন ধরে এভাবে পড়ে আছি। সাহায্য তো দূরের কথা কেউ দেখতেও আসলো না ভাই।

আদিতমারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জি আর সারোয়ার বাংলানিউজকে বলেন, ক্ষতিগ্রস্তদের ছবিসহ তালিকা করতে চেয়ারম্যানদেরকে বলা হয়েছে। কিন্তু তারা তালিকা না দেওয়ায় ঈদের আগে সহায়তা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।

জেলার বাকি উপজেলাগুলোতে বিগত দিনের তালিকা ও বরাদ্দ থেকে সহায়তা দেওয়া হচ্ছে বলেও জানান তিনি।

বাংলাদেশ সময়: ২১১৪ ঘণ্টা, মে ০২, ২০২২
এএটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।