ঢাকা, শনিবার, ২১ বৈশাখ ১৪৩১, ০৪ মে ২০২৪, ২৪ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

থানচির জীবননগর সড়ক যেন মৃত্যুফাঁদ 

কৌশিক দাশ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭০৭ ঘণ্টা, মে ৩০, ২০২২
থানচির জীবননগর সড়ক যেন মৃত্যুফাঁদ 

বান্দরবান: পর্যটন জেলা হিসেবে বান্দরবানের নাম সারাবিশ্বে পরিচিত। প্রতিদিনই বান্দরবানের প্রাকৃতিক দৃশ্য আর বিভিন্ন পর্যটনকেন্দ্র ভ্রমণে আসে অসংখ্য পর্যটক।

তবে সরু আর পাহাড়ি আকাঁবাকা সড়ক পথে চলতেই প্রতিনিয়ত ঘটছে অসংখ্য দুর্ঘটনা আর এতে প্রাণ হারাচ্ছে অসংখ্য নিরীহ জনসাধারণ আর আহত ও পঙ্গু হয়ে অনেকেই হয়ে পড়ছে পরিবারের বোঝা।

বান্দরবানের উল্লেখযোগ্য উপজেলাগুলোর মধ্যে অন্যতম ও সৌন্দর্যময় উপজেলা হলো থানচি উপজেলা। থানচি উপজেলার আয়তন ১০২০.৮২ বর্গ কিলোমিটার, আয়তনের দিক থেকে বান্দরবান জেলার সবচেয়ে বড় উপজেলা থানচি।  

এ উপজেলায় রয়েছে অনন্য সুন্দর তমাতুঙ্গি পর্যটনকেন্দ্র, নাফাখুম জলপ্রপাত, আমিয়াখুম জলপ্রপাত, বড় পাথর, বাকলাই জলপ্রপাত, ছোট পাথরসহ (তিন্দু) অসংখ্য সুন্দর জলপ্রপাত, ঝর্ণা এবং পর্যটনকেন্দ্র। আর এসব কারণেই দেশি-বিদেশি অসংখ্য পর্যটক ভ্রমণে ছুটে যায় এই উপজেলাতে। আর এই উপজেলার সঙ্গে কানেকটিং হয়ে আলীকদম উপজেলা দিয়ে সড়ক পথে কক্সবাজার এবং চট্টগ্রাম যাওয়ার পথ সহজ হওয়ায় পর্যটকরা বান্দরবানে ভ্রমণে প্রথমেই থানচিকে বাচাই করে নেয়। জেলা সদর থেকে প্রায় ৮৫ কিলোমিটার দূরত্বে সড়ক পথে থানচি উপজেলা যেতে রিজার্ভ গাড়িতে প্রায় ২ থেকে আড়াই ঘণ্টার মতো সময় লেগে যায়।

এদিকে বান্দরবান সদর থেকে শুরু করে থানচির পথে সড়কে গাড়ি চালাতে শুরু করলেই দেখা মেলে অসংখ্য ঝুঁকিপূর্ণ ব্রিজ এবং সংকীর্ণ সড়কের। কোথাও কোথাও পাশাপাশি দুইটি যানবাহন একে অন্যকে অতিক্রম করতে বাঁধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। সড়কের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ পয়েন্ট হচ্ছে নীল দিগন্ত পর্যটন কেন্দ্র পার হয়ে জীবন নগরের দীর্ঘ ৮ কিলোমিটার উঁচু থেকে পাহাড়ের নিচে নামা। বৃত্তের মতো গাড়িকে উপর থেকে ৮ কিলোমিটার একটানা চালিয়ে নিচে নামানো কতটা কষ্টকর তা একমাত্র চালকেরা ভালো জানে।

গত ২৬ মে বান্দরবানের থানচির জীবননগরে পর্যটকবাহী একটি মাইক্রোবাস নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে রাস্তার পাশে খাদে পড়ে ৩ পর্যটকের মৃত্যু হয়। এদের মধ্যে ঘটনাস্থলে মারা যান মঞ্জুরুল ইসলাম (৩৮)। গুরুতর আহত অবস্থায় উদ্ধার করে বান্দরবান সদর হাসপাতালে নেওয়ার পথে প্রথমে মারা যান হামিদুল ইসলাম (৩৫) এবং পরে জয়নাল (৩০) নামে আরেক পর্যটক। দুর্ঘটনায় ৬ জন আহত হন। হতাহতরা সবাই ছিল বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) নিরাপত্তা শাখার কর্মচারী।

এদিকে দুর্ঘটনার পর আহতদের বান্দরবান সদর হাসপাতালের জরুরি বিভাগে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে বান্দরবান জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় অ্যাম্বুলেন্সে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে হস্তান্তর করা হয়।

এদিকে দুর্ঘটনার রেশ কাটকে না কাটতেই রোববার (২৯ মে) দুপুর সাড়ে ১২টার সময় থানচি সড়কের জীবননগর নামক স্থানে আবার মালবোঝাই একটি ট্রাক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাদে পড়ে একজন নিহত হয়, আর ঘটনায় ট্রাক চালকসহ আহত হয় আরও ৩ জন। ঢালুপথে নামতে গিয়ে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে প্রায় ৩০০ ফুট নিচে গভীর জঙ্গলে পড়ে যায় ট্রাকটি। পরে ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ, বিজিবি ও স্থানীয়রা হতাহতদের উদ্ধার করতে পারলে ও ট্রাকটি গভীর জঙ্গলে পড়ে থাকে।

থানচি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সুদীপ রায় বাংলানিউজকে বলেন, জীবননগর পয়েন্টটি একটি দুর্ঘটনা প্রবল এলাকা। এই এলাকায় গত কয়েকদিনের দুর্ঘটনায় কয়েকজনের মৃত্যু হয়েছে।

বান্দরবান মাইক্রোকার জিপ মালিক সমবায় সমিতির লাইন পরিচালক মো. কামাল হোসেন বাংলানিউজকে জানান, বান্দরবানের বেশিরভাগ সড়কই পাহাড়ি এলাকায়। এই সড়কগুলোর বেশিরভাগ ঝুঁকিপূর্ণ এবং সংকীর্ণ। পাহাড়ের চালকরা প্রতিদিন এই সড়কে যানবাহন চালায় তাই তারা সড়কের মাপ বুঝে চলাচল করে। তবে বাইরের অনেক চালক বান্দরবান এসে পাহাড়ের সড়কের অবস্থা না বুঝেই অটো গিয়ারের গাড়ি নিয়ে থানচি, রুমাসহ বিভিন্ন দুর্গম পাহাড়ে ছুটে যায় আর সড়কের ম্যাপ আয়ত্ত না থাকায় গাড়ি ও যাত্রী উভয়ই দুর্ঘটনার শিকার হয়।

থানচি উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রাহুল চন্দ্র বাংলানিউজকে জানান, বান্দরবান থানচি সড়কটি দেখতে সুন্দর, আকর্ষণীয় তেমন ঝুঁকিপূর্ণ। দীর্ঘ ৮৫ কিলোমিটার পাহাড়ি উচুঁ নিচু পথে গাড়ি চালাতে চালাতে অনেক চালক ক্লান্ত হয়ে পড়ে। অনেক চালক বিভিন্ন মোড়ে মোড়ে হর্ন বাজায় না, অনেকে যানবাহনের ব্রেক চেক না করেই চালাতে থাকে। জেলার বাইরের অনেক অটো গিয়ারের গাড়ি কিছু না জেনেই থানচি ছুটে যায় আর বিভিন্ন কারণেই দুর্ঘটনা বাড়ছে।  

তিনি বাংলানিউজকে আরো বলেন, সড়কের নিরাপত্তা বৃদ্ধি ও পর্যটক এবং যাত্রীদের সুন্দর ও আরামদায়ক ভ্রমণের জন্য আমরা উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট ও ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ে সচেতনতামুলক সাইবোর্ড স্থাপন করেছি। আমরা চাই চালকরা সচেতন হবে আর এতে দুর্ঘটনা অনেকটাই কম হবে।

এদিকে বান্দরবানের জেলা প্রশাসক ইয়াছমিন পারভীন তিবরীজি বাংলানিউজকে বলেন, বান্দরবানের থানচির জীবননগর এলাকায় কয়েক দফায় সড়ক দুর্ঘটনার পরপরই আমরা জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রতিটি চেকপোস্টে চিঠি পাঠানোর কাজ শুরু করেছি যাতে বান্দরবান জেলার বাইরের কোনো চালক এবং যানবাহন যাতে পাহাড়ের বিভিন্ন পয়েন্টে যেতে না পারে।  

জেলা প্রশাসক বাংলানিউজকে আরো বলেন, যারা ভ্রমণে এবং প্রয়োজনে বান্দরবান আসবে তারা যেন অবশ্যই স্থানীয় চালক এবং স্থানীয় যানবাহন করে ভ্রমণ করে সে বিষয়টি কঠোরভাবে মনিটরিং করা হবে।

তিনি বাংলানিউজকে আরো বলেন, জেলার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সড়ক এবং ঝুঁকিপূর্ণ পয়েন্টে আমরা জেলা প্রশাসন থেকে সচেতনতামূলক বিভিন্ন সাইনবোর্ড স্থাপন করেছি এবং আগামীতে ও এই কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে।

বাংলাদেশ সময়: ১৭০০ ঘণ্টা, মে ৩০, ২০২২
এনটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।