ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

নিউইয়র্ক

যুক্তরাষ্ট্রে কাগজপত্রহীন অভিবাসীরা চরম বিপাকে!

শিহাবউদ্দীন কিসলু, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৫৪ ঘণ্টা, মার্চ ১, ২০১৪
যুক্তরাষ্ট্রে কাগজপত্রহীন অভিবাসীরা চরম বিপাকে!

নিউইয়র্ক : যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রায় ৪লাখ কাগজপত্রহীন অভিবাসীকে বহিষ্কার করা হয়েছে ২০১৩ সালে। অভিবাসীদের বন্ধু বলে পরিচিত ডেমোক্রেট দলের ওবামা প্রশাসনের এই পদক্ষেপ অতীতের বুশ প্রশাসনকেও হার মানিয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন সংশ্লিষ্ট অনেকে।

কাগজপত্রহীন ও অবৈধ অভিবাসীদের বিরুদ্ধে  আইন শৃংখলা বাহিনীসহ সংশ্লিষ্ট কর্তপক্ষের বিভিন্ন আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে কঠোরতাকেই সমর্থন দিয়েছে ওবামা প্রশাসন। তারা কাগজপত্রহীন অভিবাসীদের যুক্তরাষ্ট্র থেকে তাড়াতে গিয়ে ব্যয় করছে বিপুল অর্থ। গত ২০১২ সালে কেবল কাগজপত্রহীন অভিবাসীদের বহিষ্কারে  ব্যয় হয়েছে ১৭ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার। অথচ ফেডারেল সরকার বিভিন্ন অপরাধ দমনে ২০১২ সালে অর্থ বরাদ্দ করেছিল ১৪ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার। কাগজপত্রহীন অভিবাসীদের  বহিষ্কারে  ‘ইমিগ্রেশন অ্যান্ড কাস্টমস এনফোর্সমেন্ট’ (আইসিই) দায়িত্ব পালন করছে।

সংশ্লিষ্ট বিষয়ে এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী কেবল ২০১৩ সালেই ওবামা সরকার তিন লাখ ৬৯ হাজার আনডকুমেন্টেড ইমিগ্রান্টকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বহিষ্কার করেছে। আর প্রেসিডেন্ট ওবামার দুই মেয়াদের এই সময় পর্যন্ত,  মব মিলিয়ে প্রায় ২০ লাখেরও বেশি কাগজপত্রহীন অভিবাসীকে বহিষ্কার করা হয়েছে ।  

অভিযোগ উঠেছে, যে প্রক্রিয়ায় কাগজপত্রহীন অভিবাসীদের তাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে, তা অমানবিক ও অবমাননাকর। কারণ, এসব অভিবাসীকে তাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে টাকাপয়সা ছাড়া একেবারে খালি হাতে, পরিবার ও বন্ধুদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে। এদেরে মধ্যে এমনসব ব্যক্তিও রয়েছেন, যাঁরা ২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে যুক্তরাষ্ট্রে কাজ করছিলেন। তাঁরা ইংরেজি ছাড়া বাকি ভাষাও ভুলে বসে আছেন।

নাইন ইলেভেনে (২০০১ সাল) যুক্তরাষ্ট্রে সন্ত্রাসী হামলা হওয়ার পরই কার্যত কাগজপত্রহীন অভিবাসীদের তাড়াতে নতুন উদ্যোগ শুরু হয়। সংশ্লিষ্ট কর্তপক্ষের হিসাব  অনুযায়ী, ২০১২ সালে বিচারাধীন কাগজপত্রহীন অভিবাসীদের আটক রাখার জন্য সাকল্যে খরচ হয়েছে ২ হাজার কোটি ডলার এবং  জনপ্রতি পাঁচ হাজার ডলার। আর আটক এই বিপুল সংখ্যক কাগজপত্রহীন অভিবাসীদের বিচারের জন্য আদালতের উপরে তৈরি হয়েছে  বিশাল চাপ। গড়ে প্রত্যেক বিচারকের আদালতে পাঁচ হাজার মামলা ঝুলে আছে বলে ও জানা গেছে।  

উল্লেখ্য, প্রশাসনের বহিষ্কারের নীতি কঠোরতর করা হয়েছে পর্যায়ক্রমমে। শুরুতে অবৈধ উপায়ে থেকে যাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে যাঁরা অপরাধী, কেবল তাঁদেরই বহিষ্কার করা হতো। পরবর্তী সময়ে, যাতে অনেক বেশি আনডকুমেন্টেড ইমিগ্রান্টকে বিভিন্ন অজুহাতে অপরাধী দেখানো যায় তেমন করে নতুন আইনের সংস্কার করা হয়েছে।  

ওবামার ডেমোক্রেটিক দলীয় সরকার আইনের সংস্কার এমনভাবে করেছে, যাতে অপরাধ করার বহু বছর পরও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে দোষী দেখানো সম্ভব হয়। এ প্রসঙ্গে মাইগ্রেশন পলিসি ইনস্টিটিউটের কর্মকর্তা ডরিস মিজ্‌নার সাংবাদিকদেরকে জানিয়েছেন, বর্তমানে ৪০ বা ৫০ বছর বয়সী কেউ ২০ বছর বয়সে গাঁজা সেবনের দায়ে শাস্তি পেয়েছিলেন। নতুন আইনে ঐ অপরাধ দেখিয়ে এত বছর পরও তাকে তাড়িয়ে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে এখন। ‘ফ্যামিলিজ ফর ফ্রিডম’ নামক সংস্থা বলেছে, জোর করে বহিষ্কার না করে সরকারকে এমন উদ্যোগ নিতে হবে, যাতে কাগজপত্রহীন অভিবাসীদের জন্মভূমির সরকার তাঁদের ফেরত নিতে ও পুনর্বাসিত করতে রাজি হয়। আনডকুমেন্টেড ইমিগ্রান্টদের তাড়িয়ে দিলে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের কাজের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে এটা যেমন সত্য, তেমনি বিতাড়ণ যে সঠিক উপায়ে হচ্ছে না, সে ব্যাপারেও সবাই একমত।

প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের আমলে  ‘টেম্পোরারি ওয়ার্কার্স প্রোগ্রাম’ নামে একটি ইমিগ্রেশন সংস্কার নীতিমালা তৈরি করা হয়েছিল। এই কর্মসূচিতে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য অস্থায়ীভাবে অবৈধদের কাজের অনুমতির প্রস্তাব ছিল। একই সাথে নির্দিষ্ট সময় অভিবাসীদের নিজেদের দেশে ফিরে যেতে এবং ফিরে গিয়ে ভাগ্যোন্নয়নে ব্যবসায় উদ্যোগ নিতে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের পক্ষ থেকে এককালীন আর্থিক ‘উৎসাহ অনুদান’রও প্রস্তাব করা হয়েছিল।   কিন্তু দু’দলের মধ্যে রাজনৈতিক টানাপোড়ন এবং কাগজপত্রহীনদেরকে একবারে বৈধতা দেয়ার পক্ষে বিভিন্ন মহলের জোর দাবির কারণে বেশি দূর এগুতে পারেনি এই ‘টেম্পোরারী ওয়ার্কাস প্রোগ্রাম। ’

উল্লেখ্য, ‘স্বপ্ন সুখের আমেরিকা’য় প্রায় ১০০ বছর ধরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে বহু মানুষ বৈধ-অবৈধ পথে পাড়ি জমাচ্ছে। ভিসার মেয়াদ ফুরিয়ে যাওয়ার পরও অনেকেই বেশি আয়ের আশায় থেকে যেতে চান।  

এদিকে সম্প্রতি ‘দ্য ইকোনমিস্ট’ এক প্রতিবেদনে বলেছে, যুক্তরাষ্ট্রে কাগজপত্রহীন অভিবাসীদের সংখ্যা এখন প্রায় এক কোটি ১৭ লাখ। এসব কাগজপত্রহীন অভিবাসীদের বেশির ভাগই যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন খামার, কারখানা ও পরিচ্ছন্নতা প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। বাকিরা বিভিন্ন ধরনের ছোট কাজ করে দিনাতিপাত করেন। এঁদের সস্তাশ্রম ব্যয় হয় যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক উন্নয়নেই। তবুও বড় দুই রাজনৈতিক দলের চাপে এ বহিষ্কার প্রক্রিয়া  দিন দিনই জোরদার করা হচ্ছে। রিপাবলিকান পাটির নেতাদের উদ্যোগে ১৯৯৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রে কঠোর ইমিগ্রেশন আইন প্রণীত হয়।    

এদিকে, হুট করে বিতাড়িত হয়ে কাগজপত্রহীন অভিবাসীরা যেসব সমস্যার কবলে পড়ছেন, সেগুলো যত না অর্থনৈতিক, তার চেয়ে ঢের বেশি সামাজিক। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব মানুষ ও তাঁদের পরিবার কাজকর্ম হারিয়ে হঠাৎ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাচ্ছে। বহুদিন পর মাতৃভূমিতে ফিরে বেশির ভাগের কপালেই কাজ জুটছে না। পরিবার হারিয়ে বিতাড়িত অভিবাসীরা মানসিক ও সামাজিক যন্ত্রণায় ভুগছেন।

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

নিউইয়র্ক এর সর্বশেষ