আপনার সঙ্গে কথা বলতে খুব ইচ্ছে করছিলো। তাই গত শনিবার (৩০ মে) আপনাকে ফোন করেছিলাম।
সিরাজ ভাইয়ের সঙ্গে শাহবাগের ঢাকা ক্লাবে বিবিসির পার্টিতে যেদিন প্রথম দেখা সেদিন তিনি আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন তার বুবু শহীদ জননী জাহানারা ইমামের সঙ্গে। তারপর বহুবার নিউ অ্যালিফেন্ট রোডে জাহানারা ইমামের বাসায় গিয়েছি সিরাজ ভাইয়ের সঙ্গে গল্প করতে। পরে শহীদ জননীর ভাগনির (ছোটবোনের মেয়ে) সঙ্গে তার ছেলের বিয়ে দিয়ে সম্পর্ক পাকাপোক্তও করেন। ঢাকা ক্লাবের সেই বিশেষ পার্টিতে উইলিয়াম ক্রলি, আতাউস সামাদ, আতিকুল আলম, গিয়াস কামাল চৌধুরী, মোবারক হোসেন খানসহ আরও অনেকেই ছিলেন।
একেবারে ছোটবেলা থেকে বিবিসি বাংলা শুনে, চিঠি লিখে বরদইন, কুমিল্লা থেকে যে ছেলেটি আপনার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করতো তার জীবনেরও অনেকটা সময় কেটে গেছে। জীবন-জীবিকা ও সময়ের শ্রোতে ভাসতে ভাসতে সেই ছেলেটি তার জীবনের সিংহভাগ সময় প্রবাসে কাটিয়ে দিয়েছে। কিন্তু যেখানেই থাকুক ছেলেটি কখনো আপনাকে ভুলে থাকেনি। আপনি ছিলেন তার কাছে স্বপ্নের মতো। বিবিসি শুনতে শুনতে আপনার কাছ থেকেই যেন ‘বলতে’ শিখেছিলাম সিরাজ ভাই।
জীবনের ওই সময়টায় লেখাপড়ার চেয়ে বেশি করতাম রেডিও ক্লাব, সময় কাটতো বিদেশি বেতার শুনে, চিঠি লিখে। তখন পত্রমিতালি করা, ডিএক্সিং করা ছিল সবচেয়ে আনন্দের কাজ। ঢাকা ক্লাবে আয়োজিত বিবিসির সেই পার্টিতে আমি সঙ্গে করে নিয়ে যাই জার্মান বেতার থেকে উপহার পাওয়া গ্রুনডিগ টেপ রেকর্ডার। কথা বলেছিলাম উইলিয়াম ক্রলির সঙ্গে। সেটা ছিল আমার প্রথম নেওয়া ইন্টারভিউ।
যখন খুব ছোট ছিলাম তখন দেখতাম বাবা তার ফিলিপস রেডিও দিয়ে বিবিসি, ভিওএ, রেডিও পিকিং শুনছেন। মা রান্না করতে করতে শুনতেন আকাশবাণীর নজরুল গীতি, রবীন্দ্র সংগীত ও নাটক। একটু বড় হয়ে আমি আমার ভাইয়ের সনি শর্ট ওয়েভ রেডিওটা হাতে পেয়ে যাই। বিবিসি বাংলা বিভাগে তখন খুব জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ‘প্রীতিভাজনেষু’। উপস্থাপন করতেন সিরাজুর রহমান। প্রথম চিঠি লিখেই বেতারে তার জবাব শুনে কিযে ভালো লেগেছিল, তা এখন আর ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। পাশাপাশি ডাকযোগে সিরাজ ভাইয়ের পাঠানো চিঠি ও অনুষ্ঠানসূচি আমাকে যেন এক নতুন দিগন্তের সন্ধান দিয়েছিল।
আমাদের কুমিল্লার বরদইনের সেই পোস্ট অফিসে পরবর্তীকালে কোনো কোনো দিন বিশ-পঁচিশটি করে বিদেশি বেতারের চিঠি এসেছে আমার কাছে।
বড় হয়ে ঢাকায় চলে আসার পরও বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশুনোর চেয়ে রেডিও ক্লাব, রেডিওতে অনুষ্ঠান ইত্যাদি করা নিয়েই বেশি ব্যস্ত থাকতাম। ৭৯ সালে জাতীয় প্রেসক্লাবের গ্যালারিতে দেশের প্রথম ডিএক্স প্রদর্শনী করি, যাতে বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসের প্রধান মার্ক ডড ও ইত্তেফাকের তৎকালীন সম্পাদক আনোয়ার হোসেন মঞ্জু উপস্থিত ছিলেন। বাতেন, মুকুল, পিঙ্কু, বেলাল, ডায়মন্ড, লাকিসহ সব বন্ধুরা মিলে সারারাত জেগে যে প্রদর্শনী সাজিয়েছে তখন তাতে গিয়াস কামাল ভাইও যোগ দিয়েছিলেন। আমাদের কর্মকাণ্ড দেখে কিছুটা অবাক হলেও খুব পছন্দ করতেন তিনি।
এরপর আমরা ঢাকায় জাতীয় পর্যায়ে বিবিসি শ্রোতা সংঘ গঠন করি। আমাদের এসব কর্মতৎপরতার পেছনে সিরাজ ভাইয়ের প্রত্যক্ষ উৎসাহ ও সহযোগিতা সব সময় অব্যাহত ছিল। তিনি প্রায়ই বিবিসির ঢাকা সংবাদদাতা ও প্রিয় সাংবাদিক আতাউস সামাদ ভাইকে দিয়ে আমাকে খবর পাঠাতেন। সামাদ ভাই খুব গুরুত্বের সঙ্গে তার বার্তা আমাকে পৌঁছে দিতেন। তার নয়া পলটনের বাসায় বহুবার যাবার সুযোগ হয়েছে আমার।
সিরাজ ভাই ঢাকায় এলেই রেডিও অফিসে নিয়ে যেতাম, বিশেষ করে আমাদের রেডিও ক্লাবের অন্যতম উপদেষ্টা ও বিশিষ্ট সঙ্গীতজ্ঞ মোবারক হোসেন খান ভাইয়ের ওখানে। তখন তিনি বহির্বিশ্ব কার্যক্রমের পরিচালক ছিলেন। বিদেশি বেতারের বড় বড় কর্তারা এলেই তাদের নিয়ে মোবারক ভাইয়ের অফিসে যাওয়া বিষয়ে তখনকার রেডিও বাংলাদেশের মহাপরিচালক ম ন মুস্তাফার সঙ্গে আমার বেশ ঝামেলা হয়েছিল। যার ফলে বেশকিছু দিন রেডিওতে আভ্যন্তরীণ কার্যক্রমে অনুষ্ঠান করা থেকেও বিরত থাকতে হয়।
পড়াশুনো শেষ করে জীবনের প্রথম চাকরি নিই নতুন ইংরেজি দৈনিক ডেইলি নিউজে। সে সময় বিবিসিতে নতুন লোক নিয়োগের জন্যে পরীক্ষায় অংশ নিতে বিবিসি থেকে আমাকে বলা হয়েছিল। তখন বিবিসির জন্যে কোনো ভয়েস টেস্ট দিতে গেলে পড়তে দেয়া হতো সাপ্তাহিক বিচিত্রার রিপোর্ট থেকে। আমার সঙ্গে আরও যারা বিবিসির জন্য পরীক্ষা দিয়েছিলেন তাদের মধ্যে ছিলেন শওকত মাহমুদ, মনজুরুল আহসান বুলবুল, শেহাব উদ্দিন নেফাসহ আরও বেশ কয়েকজন। আমার ও বুলবুলের ফলাফল সবচেয়ে ভালো হয়েছে বলে বিবিসি থেকে জানানো হয়েছিল। কিন্তু বিচিত্রা সম্পাদক শাহাদত চৌধুরীর বিশেষ ইচ্ছার কারণে আরও আগে পরীক্ষা দেওয়া কাজী জাওয়াদকে বিবিসি নিয়োগ দিয়েছিল।
৮৭ সালে বিবিসির বাংলা ও সাউথ এশিয়ান ইংরেজি বিভাগের অনুষ্ঠানের একজন স্ট্রিঙ্গার হিসেবে কাজ করার জন্যে আমাকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়েছিল। কিছুদিন পর নতুন দিল্লিতে যেতে হয় বিবিসির হেদার বন্ডের তত্ত্বাবধানে আয়োজিত বিশেষ রেডিও প্রোডাকশন ওয়ার্কশপে যোগ দিতে। ঢাকা থেকে আমি এবং ভারত ও শ্রীলঙ্কা থেকে বেশ কয়েকজন সাংবাদিক এতে যোগ দিয়েছিলেন। কিভাবে রেকর্ডিং সামগ্রী ব্যবহার করতে হয়, এডিটিং করতে হয়, তা হাতেকলমে শেখানো হয়েছিল সেখানে। আমরা বিভিন্ন স্পটে গিয়ে রিপোর্ট করে এনে তার ওপর প্যাকেজ তৈরি করে দেখাই। আমি গিয়েছিলাম রাজধানী দিল্লির এক বিশাল বস্তিতে।
দিল্লি যাবার কিছুদিন আগে ঢাকায় বিশেষ সফরে আসা বিখ্যাত ভারতীয় নৃত্যশিল্পী পদ্মশ্রী লীলা স্যামসনের একটি বিশেষ সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম আনন্দ বিচিত্রার জন্য শাহাদত ভাইয়ের নির্দেশে। লীলা স্যামসন আমাকে দিল্লির একটি অভিজাত রেস্তোরাঁয় নিয়ে আপ্যায়িত করেছিলেন বিবিসির ওই ওয়ার্কশপের সময়।
সিরাজ ভাইয়ের দেয়া অনেক অ্যাসাইনমেন্ট পালন করতে আমাকে বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে যেতে হয়েছে। ইলিশ মাছ নিয়ে স্টোরি করতে গিয়ে নদীতে গিয়ে জেলেদের সঙ্গে কথা বলেছি, জ্যান্ত ইলিশ মাছ দেখেছি। বিবিসির জন্য বাউলদের কণ্ঠে লালনের গান রেকর্ড করতে গভীর রাতে লালনের আখড়ায় গিয়েছি। বাংলাদেশের নাটক নিয়ে ইংরেজি সার্ভিসের জন্য প্যাকেজ করেছিলাম আলী জাকের, নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু ও আতাউর রহমানের সঙ্গে কথা বলে।
ডেইলি নিউজের প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর ৮৭ সাল থেকে আমি জড়িত হয়ে পরি সাপ্তাহিক বিচিত্রার সঙ্গে। বিচিত্রার সম্পাদক শাহাদত চৌধুরী আমাকে কূটনৈতিক কলাম লেখার সুযোগ করে দেন তখন। আমার আগে শুধু দুই জন বিচিত্রায় কূটনৈতিক কলাম লিখেছেন। তারা হলেন সাংবাদিক মতিউর রহমান চৌধুরী ও ফারুখ ফয়সল।
সিরাজ ভাই একবার ঢাকায় আমার শান্তিনগরের বাসায় বিবিসির একটি ধারাবাহিক অনুষ্ঠানের জন্য বেশ কিছু সাক্ষাৎকার নেন। অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে বিচিত্রার অনেকেই ছিলেন। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, ওই সময়টায় বিবিসির জন্য একটি অনুষ্ঠান প্রস্তুত করে পাঠানো এখনকার মতো এতো সহজ ছিলো না। অনলাইন ছিলো না। মাটারবক্স নামে একটা যন্ত্রকে টেলিফোনের সঙ্গে সংযুক্ত করে অনুষ্ঠান পাঠাতে অনেক ঝামেলা হতো। কোনো খেলার খবর থাকলে অবশ্য ফ্যাক্স করে পাঠানো যেতো।
৯৪ সালে আমি যখন প্রথম লন্ডনে যাই তখন বিবিসির বুশ হাউস স্টুডিওতেও প্রথম যাওয়া হয়। সিরাজ ভাইসহ বুশ হাউসের কেন্টিনে বসে কতো আড্ডা হয়েছে। বুশ হাউস ছিল অনেকটা জাতিসংঘের মতো একটা বিশাল ভবন।
২০১২ সালে নিউ ইয়র্কে এবিসি সম্মেলন আয়োজনের তোড়জোড় শুরু হলে সাইদুর রব ভাই আমাকে সিরাজ ভাইয়ের কথা বলেন। আমি তখন ঠিকানার মিজান মামুর সঙ্গে (আমার প্রিয় বন্ধু মিজানুর রহমান) সিরাজ ভাইয়ের ফোনে পরিচয় করিয়ে দিই। এবিসিতে সিরাজুর রহমান ভাইকে পাওয়া ছিল একটা বিরাট ব্যাপার। তাকে পেয়ে ভিওএ’র জিয়াউর রহমান, কাফি খান, সরকার কবির উদ্দিন ও ইকবাল বাহার চৌধুরী কীযে খুশি হয়েছিলেন। আমার জন্য সেটা ছিল এক বিরাট পাওয়া।
গল্প করতে গিয়ে তিনি যখন বহু বছর আগের আমাদের বিভিন্ন ঘটনা উল্লেখ করছিলেন, তখন আমার বিস্ময়ের সীমা ছিলো না। সোফিয়া ভাবিও আমাকে মনে রেখেছিলেন দেখে আনন্দ লাগছিল। ঢাকায় আমাদের কতো স্মৃতিময় সময় কেটেছে। এবিসি সম্মেলন শেষে বিদায়ের আগের দিন সিরাজ ভাই ও ভাবীকে নিয়ে আসি জ্যাকসন হাইটসে। তখন তাকে প্রিমিয়ামে বসিয়ে অনেক যত্ন করে খাওয়ানোর সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। খাবার দোকানের সামনে একটা রিকশা রাখা ছিল, সেখানে দাঁড় করিয়ে দু’জনের ছবি তুলি। হাঁটতে খুব কষ্ট হলেও আমার সঙ্গ ৭৩ ও ৭৪ স্ট্রিট পুরোটা হেঁটেছিলেন। সিরাজ ভাইকে বলেছিলাম, তার কিছুদিন আগেই আমি এভাবে হেঁটেছি প্রিয় লেখক শংকরকে নিয়ে।
হোটেলে ফিরে রুমে বসে সিরাজ ভাইয়ের একটি বিশেষ ভিডিও সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম, যাতে সহযোগিতা করেছিলো প্রিয় ছোট ভাই ও খবর ডটকমের সহকারী সম্পাদক মশিউর রহমান। সেদিন বিদায় বেলায় বুকে জড়িয়ে ধরে ছিলেন অনেকটা সময়।
আমার জীবনের হিরো ছিলেন সিরাজুর রহমান। আমি চাইলেও আর কোনোদিন টেলিফোনের ডায়াল ঘুরিয়ে তার কাছে পৌঁছাতে পারবো না। তিনি আর কোনোদিন নিউইয়র্ক আসবেন না এবিসিতে যোগ দিতে। তিনি এখন আমার আকাশে তারা হয়ে গেছেন। দৃষ্টির সীমানা ছাড়িয়ে আমার হৃদয়কাশে স্থান করে নিয়েছেন।
বাংলাদেশ সময়: ০৫১০ ঘণ্টা, জুন ০৬, ২০১৫
আরএম