মূল: অগাস্ট কুবিজেক
অনুবাদ: আদনান সৈয়দ
[লেখক অগাস্ট কুবিজেক ছিলেন কুখ্যাত নাজি বাহিনীর জনক অ্যাডলফ হিটলারের ছেলেবেলার বন্ধু। তার জনপ্রিয় গ্রন্থ ‘দ্য ইয়ং হিটলার আই নিউ’ থেকে জানা যায়, হিটলার তার প্রথম যৌবনে গান গাইতেন, ধ্রুপদী সঙ্গীতের সমঝদার ছিলেন, ছিলেন একজন প্রেমিক ও ছবি আঁকায় তার ছিলো আজন্ম ঝোঁক।
পর্ব ৯
তৃতীয় অধ্যায়
নিজের শহর লিজকে নিয়ে হিটলারের ভাবনার অন্ত ছিলো না। আমিও শহরটিকে বেশ ভালোবাসতাম। বিশেষ করে পেনিংবার্গের উঁচু ঢাল থেকে শহরের সৌন্দর্য দেখার আনন্দই আলাদা। তবে হিটলার যে দৃষ্টিতে লিজ শহরের সৌন্দর্য উপভোগ করতো, লিজবাসীরা সেই সৌন্দর্য দেখতে পেতো না। এ নিয়ে হিটলারের কোনো আক্ষেপ ছিলো না। কারণ, সে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তার স্কেচ খাতা নিয়ে ছবি আঁকাতেই মগ্ন হয়ে থাকতো।
অন্যদিকে, সেন্ট হেলেন জায়গাটি আমার জন্য হয়ে উঠলো এক চিলতে স্বর্গ। বিখ্যাত ধ্রুপদি সঙ্গীতজ্ঞ এনটন ব্রাকনার (১) এখানে তার সঙ্গীত দিয়ে মাতিয়ে রাখতেন এবং আমরা দু’জন যখন এই শহরে পা রাখলাম তখন মনে হলো, আমরা বুঝি স্বয়ং ঈশ্বর মনোনীত একজন শিল্পীর দেখা পেয়েছি। তার বাড়ির সামনে সমাধিতে শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা নিয়ে আমরা নিবিষ্ট মনে দাঁড়িয়ে ছিলাম। সে এক অসাধারণ অনুভূতি। এক অদ্ভুত অনুভূতি আমার বন্ধুটিকেও পেয়ে বসতো। সে আমার থেকেও বেশি সময় ধরে এ মহান শিল্পীর সমাধিতে ওঠার জন্যে সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে থাকতো। আর ছিলো এনটন ব্রাকনারের বাড়ির ভেতরে তার বর্ণময় একটি পাঠাগার। আহা! অনন্ত সময় ধরে পাঠাগারের দিকে তাকিয়ে শুধু বিহ্বল হয়ে চেয়ে থাকা! তবে আমার বন্ধুকে এরচেয়েও বেশি আকর্ষণ করতো ব্রাকনারের ব্যক্তিগত কক্ষ, যেটির দেয়াল ছিলো বিভিন্ন রঙে রাঙানো কারুকাজবেষ্টিত। আমরা যখন কক্ষটিতে প্রবেশ করে তার ব্যবহৃত খুব সাধারণ আসবাবপত্রগুলো দেখতাম তখন সে তার বিশ্বাসে অবিচল হয়ে আমাকে বলতো, জ্ঞানীদের জীবন এমন সুন্দর আর সহজ সাধারণই হয়ে থাকে। দারিদ্র্যতা তাদের জীবনের একটি অংশ।
এমন মহান মানুষদের সমাধি দর্শন করতে পারলে মনটা সত্যি অন্যরকম একটি জায়গায় চলে যায়। অ্যাডলফ স্বভাবগতভাবেই নিজেকে গুটিয়ে রাখা স্বভাবের মানুষ। সে চাইতো না তার ব্যক্তিত্বের কোনো গোপন বিষয় অন্যকেউ জেনে যাক। তার এমন কিছু গোপন চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ছিলো যার খবর সে শুধু নিজেই জানতো। সত্যি বলতে, বন্ধু হিসেবে আমি নিজেও তার অনেক অজানা বিষয় নিয়ে গোলকধাঁধাঁয় পড়ে যেতাম। তবে তার গোপন জগতে প্রবেশ করতে হলে যে একটি মাত্র চাবির প্রয়োজন হতো তা হলো, সুন্দরের প্রতি তার অদম্য ভালোবাসা। আমরা যখন সেন্ট হেলেনের অসাধারণ সেই শিল্পিত জায়গাটায় গিয়েছিলাম তখন আমাদের মধ্যে এই বিষয়টিই সবচেয়ে বেশি কাজ করেছিলো। আমরা দু’জনই সুন্দরের পূজারি। সুন্দরকে দেখার চোখ নিয়ে অ্যাডলফ বিপুল উদ্যমে ঝাঁপিয়ে পড়তো এবং আমি তখন আমাদের বন্ধুত্বটা খুব উপভোগ করতাম।
অ্যাডলফের হাস্যরসের বোধ তেমন একটা ছিলো না। সে রক্তে ছিলো অস্ট্রিয়ান আর সে কারণে তার অস্ট্রিয়ান ধাঁচের কিছু কৌতুক-রস অবশ্যই ছিলো। তবে তার সঙ্গে প্রথম পরিচয়ে তাকে কাঠখোট্টা শক্ত ধরনের কোনো লোক বলেই বেশি মনে হবে। তার এই কঠিনমুখো চেহারার কারণে আশেপাশের সবকিছুকেই যেনো কঠিন করে তুলতো। ছেলেবেলা থেকেই সে এমন আচরণে অভ্যস্ত। তবে সে এমন এক লোক যে তার মুখে কঠিন চেহারা ফুটিয়ে একইসঙ্গে ভালোবাসতে পারে, ঘৃণা করতে পারে ও প্রশংসাও করতে পারে। তবে মুখে কীভাবে কৃত্রিমভাবে হাসি ফুটিয়ে তুলতে হয় এ বিষয়টি সে জানতো না বা পারতো না। এমন কিছু বিষয় আছে যেখানে তার বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিলো না। যেমন খেলাধুলার কথাই ধরা যাক। এ বিষয়েও সে একজন ক্রীড়ামোদী মানুষের মতোই নিখুতভাবে মত দিতে পারতো। সে কখনই তার সমস্যাকে সহজ ও সরলীকরণ করে ফেলতো না। যে বিষয়ে তার অনেক গভীর আগ্রহ সে বিষয়টাকে নিয়ে সে কখনই কোনো সমস্যার অন্তরায় হতে দিতো না। সে তার সমস্যাগুলোর কথা বাড়িতে বসে চুপচাপ ভাবতো, এ নিয়ে পড়াশুনা করতো এবং এ থেকে পরিত্রাণের উপায় বের করতো। এটি ছিলো তার চরিত্রের সবচেয়ে ভালো একটি গুণ। একজন যুবকবয়সী মানুষের চরিত্রে যেসব বিষয় থাকে যেমন- উদাস হয়ে থাকা, কী হবে আর কী হবে না এসব নিয়ে কল্পনার জাল বোনা, সময়ের সঙ্গে গা ভাসিয়ে দেওয়া প্রভৃতি বিষয়গুলো তার চরিত্রে একেবারেই ছিলো না। বলতে খুব অবাক শোনায়, তার ধারণা- এই বৈশিষ্ট্যগুলো যদি কোনো মানুষের থাকে তাহলে সে পরিপূর্ণ মানুষ হয়ে বেড়ে উঠতে পারবে না। সে কারণে সে হাস্যরস থেকে সবসময়ই বঞ্চিত ছিলো। তার হাস্যকৌতুক শুধু তার খুব কাছের মানুষদের সঙ্গেই সীমিত থাকতো। অথবা বলা যায়, তার নিজের সমস্যাগুলো সে এভাবেই তার ঘনিষ্টজনদের সঙ্গে শেয়ার করতো। এ কারণে তার এই ব্যঙ্গাত্মক হাস্যরস অন্যদের কাছে প্রায়সময়ই করুণ হয়ে ফুটে উঠতো। সে যখন প্রথম আমাকে থিয়েটারে আবিষ্কার করেছিলো তখন আমি ট্রামপেট বাজাচ্ছিলাম। সে দৃশ্যটি দেখে সে যেনো আনন্দে আত্মহারা হয়ে আমাকে আবিষ্কার করেছিলো এবং তার মনে হয়েছিলো, আমি যেনো রুবেনের আঁকা অ্যাঞ্জেল’র (২) মতো।
আমি হিটলারের জীবনের একটি গুণাবলির কথা না বলে এ অধ্যায়টি শেষ করতে চাই না। যদিও জানি, বিষয়টি এখন খুবই বিতর্কিত, তারপরও বলবো- মানুষের প্রতি হিটলারের হৃদয় ছিলো খুব সমঝোতাপূর্ণ ও সহানুভূতিশীল। তার এই গুণাবলির অনেক ফল আমি নিজে পেয়েছি। আমার খুব কঠিন সময়ে আমি তার এই গুণের স্পর্শ পেতাম। সে সবসময় জানতো, আমি কী চাই বা কী হতে চাই। তার চরিত্রের ধর্ম অনুযায়ী, সে এমন সব মানুষদের সঙ্গেই মিশতে ভালোবাসতো যাদেরকে সে পছন্দ করতো। সে আমার বাবাকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলো, আমার জীবনে সঙ্গীত অনেক গুরুত্বপূর্ণ এবং এই নিয়ে আমার উচ্চ পড়াশুনা করা উচিৎ। না, আমি এটাকে কোনো কাকতালীয় ঘটনা বলবো না বরং এটাই ছিলো হিটলারের সহজাত চরিত্র। হিটলার আমার বিষয়ে এতো আন্তরিক ছিলো যে, সে নিজেকে আমার জায়গায় বসিয়ে আমার সমস্যাগুলো নিয়ে ভাবতো এবং সেই অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিতো।
যাইহোক, আমার স্মৃতিশক্তির উপর নির্ভর করে আমি হিটলারের তরুণ বয়সের একটি ছবি আঁকার চেষ্টা করেছি। আমাদের বন্ধুত্বের ঊর্ধ্বে উঠে যে প্রশ্নটি সবসময় আমাকে বিদ্ধ করে এবং যার উত্তর আমি এখন পর্যন্ত পাইনি তা হলো, ঈশ্বর এই লোকটার কাছ থেকে কী প্রত্যাশা করেছিলেন?
*১: এনটন একজন অস্ট্রিয়ান সঙ্গীতজ্ঞ ও কম্পোজার। তিনি ১৮২৪ সালের ০৪ সেপ্টেম্বর অস্ট্রিয়াতে জন্ম নিয়ে ১৮৯৬ সালের ১১ অক্টোবর মারা যান। *২: পিটার পল রুবেনের আঁকা চিত্রশিল্প ‘অ্যাঞ্জেল’।
বাংলাদেশ সময়: ১৫৩৪ ঘণ্টা, মে ০২, ২০১৬
এসএনএস
আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন-
** দ্য ইয়ং হিটলার আই নিউ (পর্ব-১)
** দ্য ইয়ং হিটলার আই নিউ (পর্ব-২)
** দ্য ইয়ং হিটলার আই নিউ (পর্ব-৩)
**দ্য ইয়ং হিটলার আই নিউ (পর্ব-৪)
** দ্য ইয়ং হিটলার আই নিউ (পর্ব-৫)
** দ্য ইয়ং হিটলার আই নিউ (পর্ব-৬)
** দ্য ইয়ং হিটলার আই নিউ (পর্ব-৭)
** দ্য ইয়ং হিটলার আই নিউ (পর্ব-৮)