১০.
ভালোবাসায়, আশায়,
সুর আসে, কেটে যায়।
………………………………………………………………
কতটা জোরে চিৎকার করে বলা যায়, ‘ভালোবাসি’?
বাবার বান্ধবী এসেছে কোলকাতায়।
নিঃসন্তান মহিলা। বিয়ের কিছুদিন পরেই স্বামী সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়। দোষ তার পড়েছে। উচ্চশিক্ষিত বলে বদনামের পরিমাণটা কিছু বেশি হয়েছে। সমাজ এখনও হয়তো নারী স্বাধীনতা, নারী শিক্ষা এসব বিষয় নিয়ে কিছুটা বিব্রত এবং বিভ্রান্ত। ওপর ওপর বোঝা যায় না, কেউ স্বীকার করতে নারাজ কিন্তু ভেতরে অবস্থা এমনই।
মহিলা বাবার ভালো বন্ধু একসাথে পড়াশোনা করেছে। পড়াশোনা শেষে অনেকদিন যোগাযোগ ছিলো না। হুট করেই বাবার অফিসে দেখা। কোনো একটা কাজের জন্য এসেছিলেন। পড়াশোনা শেষে শিক্ষকতা করছেন তিনি। সফল বলা চলে।
মায়ের সন্দেহপ্রবণ মন। মা সামনাসামনি ভালো ব্যবহার করলেও পেছনে গেলেই নিন্দা শুরু করে। তার আমাদের আদর করাটা সহ্য হয় না, আমাদের জন্য টুকিটাকি গিফট্ নিয়ে আসাটা পছন্দ হয় না।
মৃত্যুশয্যায় থেকেও মা মহিলাকে নিয়ে খারাপ কিছু বলার সুযোগ ছাড়ে না। মেয়েরা তাদের স্বামী, সংসার নিয়ে এতটা স্বার্থপর হয় যে অবাক লাগে। কিংবা এটা হয়তো অন্য কিছু। ভালোবাসার অন্ধকার দিক কোনো।
‘কিছু খাবে?’ বাবার বান্ধবী বলে। আমি ওনার সাথে বের হয়েছি। দারুণ সময় কাটে। কোলকাতা শহরটা ঢু মারার ইচ্ছা ওনার। মায়ের কঠোর নিষেধ সত্ত্বেও বের হবার লোভ সামলাতে পারিনি। তিনি বলেছিলেন যেন একশত হাত দূরে থাকি আর রুবির দেখা যেন না পায়। মায়ের কথা সবসময় শুনতে হয় না। আমি তাই শুনিনি।
‘পানিপুরি খাওয়া যায়। ’ আমি বলি। ওনার কাছে কিছু চাইতে কেন জানি লজ্জা লাগে না। সহজ হওয়া যায় অল্প সময়ের ভেতরেই। কিছু চাইলে, প্রয়োজন হলে বলা যায়। মনে হয় উনি সব পারেন, ওনাকে সব বলা যায়।
‘শুধু পানিপুরি? তরতাজা একটা তরুণ এত কম খেলে হবে?’ উনি মুচকি হেসে বলেন। কি সুন্দর পরিমিত হাসি!
‘পানিপুরিতেই চলবে। ’ আমি বলি।
‘আজ পুরো শহরটা ঘুরে শহরটাকে পুরনো করে ফেলব বুঝলে? ট্রামে চড়বো। কোলকাতার সব খাবার টেস্ট করবো। ফূর্তি। ’
‘মায়ের কাছে যেতে হবে যে। টেনশন হয়। ’
‘চলে যাবে যে তাকে কি আটকে রাখতে পারবে? কী দরকার তাকে নিয়ে ভেবে নিজের সময় নষ্ট করবার। ’
‘জ্বি। ’ আমার মন খারাপ হয়ে যায়। মাথা নিচু করে কথাটা বলি। এই বইয়ের মতন গোছানো কথা ভালো লাগে না। আমার মাকে, জীবনকে কোন যুক্তি দিয়ে বাঁধতে চাই না। আমার জীবনের সবচেয়ে জরুরি মা। মাকে নিয়ে কোনো হেলাফেলা, কোনো পরীক্ষা, সূত্রে আমি যেতে রাজি নই।
এরপর আমার আর ঘুরে বেড়ানোতে মন বসে না। খাওয়ার দোকানে যাওয়া হয়। কোলকাতার সেরা বিরিয়ানিও বিষাদ লাগে। বাবার বান্ধবীর চোখে আমার বিষাদ ধরা পড়ে না। সে আনন্দ নিয়ে ঘোরে। ট্যাক্সি নিয়ে ঘোরা হয় শহরের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। লেকের পানিতে বোটে ভাসা হয়। পাখির ভিড় চোখে পড়ে। মহিলা আমাকে নানা পাখি চেনায়। হালতি, রাজহংস, খোঁপাডুবুরি দেখি। সে বলে, ‘জানো জানো এটা খোঁপাডুবুরি পাখি। কি সুন্দর না? কাছাকাছি যেতেই ডুবসাঁতারে হারালো আবার দূরে গিয়ে মাথা ভাসালো। মাথা কালো মাথা আর কালচে কানঝুঁটিটা পাগল করে দেয়। আই লাভ ন্যাচার। প্রকৃতি আমাদের বড় করে...। ’
তিনি বলেই যান। কথা এক প্রসঙ্গ থেকে ঘুরে ঘুরে অন্য প্রসঙ্গে যেতে দেরি হয় না। তার এই জ্ঞানের কথাগুলো আজ আর ভালো লাগে না। মাকে নিয়ে তার কথাটা নিতে পারছি না।
আমি সূত্র মেলাই। মায়ের মতন এই মহিলাকে সর্বনাশী কিভাবে, কেন বলা যায় সে চেষ্টা করতে থাকি। তার এখানে আসার কারণ কী? পিএইচডি? মাকে একবারও দেখতে গেল না কেন উনি? দোষ ত্রুটি বের করার কঠিন চেষ্টা।
এরপর বিকেল শেষে সন্ধ্যের দোরগোড়ায় আসে যখন সময় তখন তিনি আমাকে নামিয়ে দেন হাসপাতালের কাছে। নিজে ওপরে যান না। বিদায় নিয়ে চলে যান যে হোটেলে উঠেছেন সেখানে। বলেন, কাল আবার বের হবেন। আমার মাথা ধরেছে। চোখ জ্বলছে।
আমি কথার জবাবে মুচকি হাসি। তিনি সম্মতি মনে করে আনন্দ নিয়ে চলে যান। আমি রাস্তায় কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে হাসপাতালের ভেতর ঢুকি। মাথা ঘোরায়। প্রেশারের সমস্যা হয়তো। এত অল্প বয়সে এ রোগ তো হবার কথা না!
হাসপাতালের ভেতরে এসিতে শীত লাগে। এসির ফ্রেয়নে আমার এলার্জি। বুনোর সাথে দেখা হয়। সে অফিস শুরু করেছে। পড়াশোনাও হচ্ছে। বাজে সব কিছু ভুলে থাকার চেষ্টা করছে। কাজে থাকলেই এটা সম্ভব। বুনোর হাসি মুখ দেখে বোঝা যায় সে সামলে নিয়েছে নিজেকে অনেকটাই।
‘আমি সন্দীপ মুখার্জির সাথে কথা বলেছি। ’ আমাকে দেখে ডেস্ক থেকে উঠে এসে বলে বুনো।
‘কি বললো?’ এই এতক্ষণে যেন আমার একটু ভালো লাগে। দম নিতে পারি।
‘বললো বিষয়টা আপাতত থামানো গেল কিন্তু ঝামেলা হবে পরে। লোকটা ভালোই। কয়েক জায়গায় ফোন দিয়ে ভাগালো পুলিশ। পাসপোর্ট আটকে ফেলার আগেই একটা কিছু করতে হবে নইলে সবাইকে পড়তে হবে বিপদে। উনি যেতে বলেছে একদিন। এই সপ্তাহেই। ’ বলে বুনো।
‘যাবোতো। আচ্ছা, মা কেমন আছে?’ বলি আমি। আমার খুব ভালো লাগে এই মুহূর্তে বুনোর সাথে কথা বলতে। নিশ্চিন্ত লাগে।
‘আমি দেখে এসেছি একটু আগে। দেখে আসো। আর শোন, তোমার দেশ থেকে ফোন এসেছিল। হাসপাতালের নম্বরে কেন দিলো বুঝলাম না। তখন ছিলাম না আমি। কলিগ বললো। আবার কল দেবে নাকি। দেখা করে এদিকেই এসো। ’
‘আচ্ছা। ’ কথাটা বলে আমি মায়ের কেবিনের দিকে হাটা দেই।
কে কল দেবে? বাবা মনে হয়। আবার কোনো খারাপ সংবাদ। এ নিয়েই তো আছি। সমস্যা নেই। সমস্যা মনে হয় না আর।
তবে হ্যা বাবার হাসপাতালের নম্বরে কল দেবার কথা না। অন্য কেউ হবে হয়তো। কিন্তু দেশ থেকে আমাকে আর কে’ই বা ফোন দেবে!
চাইলেই দুশ্চিন্তা করা যায়। কিন্তু করি না। দুশ্চিন্তায় ঘেন্না ধরে গেছে। কি হয়? কিছু হয় না চিন্তা করে। বরং থেমে থাকাই ভালো।
মায়ের কেবিনে ঢুকে দেখি ঘুমাচ্ছে। ইদানীং খুব ঘুমায় আমার মা। ধকল যায় খুব তাই বিশ্রাম। সারাদিন কত শত ওষুধ গেলা, শরীর চিড়ে সুচ ঢোকানো! বেঁচে থাকার চেষ্টা সহজ না। এর চাইতে মৃত্যু অনেক সহজ মনে হয়!
মায়ের সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করে। অনেকক্ষণ ধরে গল্প। মা-ছেলের আড্ডা দেওয়া। মায়ের বকা খেতে ইচ্ছে করে। আজ এখনই খুব করে ইচ্ছে করে। এইসব ইচ্ছেরা লাগামছাড়া। কেন আসে, যায় ঠাওর করা যায় না।
আমি কারণ খোঁজার চেষ্টা করি। বাবার বান্ধবী কী? মাকে হারানোর ভয়? মায়ের জায়গায় আমি কাউকে যে কল্পনাও করতে পারি না। জীর্ণ, শীর্ণ, রোগা মা’ই ভালো আমার।
মায়ের ঘুম ভাঙাই না। মা ঘুমায়। তাকে ভালো করে দেখি। চোখের নিচে যে কালি পড়ে তারই একটা প্রলেপ যেন এখন সারা মুখে। গায়ের রং মলিন, মৃত। কিন্তু একটা মায়া আছে। পবিত্রতা আছে। প্রার্থনার মতন। ধর্মের মতন। দেখলেই শান্তি হয়। মনে হয় এটাই পৃথিবী। যে পৃথিবী টিকে থাকার জন্য লড়াই করছে প্রতিদিন।
মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকি। তার নিঃশ্বাস নেওয়া দেখি। বেঁচে আছে এটা জেনে আশ্বস্ত হওয়া। মায়ের হাতটা ধরতে ইচ্ছে করে। ঘুম ভেঙে যেতে পারে এই ভয়ে সাহস হয়না। পাঁচ-দশ-পনের মিনিট পর বের হতে হয়। রোগীর কাছে বেশিক্ষণ থাকায় নিষেধ আছে। যাই আবার বুনোর কাছে। বুনো কাজ করে আর আমি পাশে বসে থাকি। কাজ করা দেখি। মানুষের আসা যাওয়া দেখি। সব চিন্তা বাদ দিয়ে এভাবে মানুষ দেখতে ভালো লাগে। তাদের ব্যস্ততা, ছোটাছুটি ভালো লাগে।
‘ফোন। বাংলাদেশ থেকে। ’ বুনোর এক কলিগ ফোন ধরে চিৎকার করে জানায়।
আমি বিরক্ত হই। মানুষ দেখায় ডুবে গিয়েছিলাম। এর মাঝে এই ছেদ ভালো লাগে না। বাবার সাথে পরেও তো কথা বলা যাবে। কী এমন কথা আছে আর এই পৃথিবীতে। অন্তত আমারতো আর বলার কিছু নেই।
ফোন ধরি। ‘হ্যালো হ্যালো’ বলি অনেকবার। কেউ কিছু বলে না। বিরক্ত হয়ে ফোন কেটে দেবার ঠিক আগ আগেই শুনি বলছে একজন ‘হ্যালো। ’
বুঝি। বুঝে যাই আমি কে। বিশ্বাস করতে পারি না। বিশ্বাস হয় না। কিভাবে সম্ভব! আমি কি এর জন্যেই অপেক্ষায় ছিলাম আজ, এতগুলো দিন।
‘আসসালামু আলাইকুম। আপনি কি ভালো আছেন?’ মাহবুবা বলে। কি বিনীত, নম্র, শান্ত জলের মতন বয়ে যাওয়া কন্ঠ।
‘ওয়ালাইকুমুস আসসালাম। এইতো চলছে। সবাই কেমন আছে? হোমওয়ার্ক? ঠিকঠাক?’ বলি। নিজের অবাকপনা লুকোতে ইচ্ছে করে। পারি না।
‘দেশে আসেন। ’
‘আসবো তো। ’ আমার ভালো লাগে। এই কথা বলতে ভালো লাগে।
‘তাড়াতাড়ি। ’
‘আচ্ছা তাড়াতাড়ি। ’ বলি আমি। এরপর আর কথা হয় না। কিংবা কথা হয়। কথা বলি আমরা। চুপচাপ থেকেই বলে দেওয়া যায় অনেক কিছু। বোঝানো যায় অনেক কথা। এভাবে দু-প্রান্তে দুজন। চুপচাপ কত কথা। আমাকে কি কেউ দেখছে এভাবে? বুনো? দেখুক। কি আসে যায়!
লাইন কেটে যায়। টাকা শেষ হয়তো। আমি তাও ফোন কানে দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। ওই প্রান্তে মাহবুবা এখনও দাঁড়িয়ে নিশ্চিত। আমার চলে যাওয়া ঠিক হবে না। মাহবুবাকে ছেড়ে চলে যাওয়া ঠিক হবে।
আমি কি পাগলামি করছি? এসব কী? কেন? কী বলা যায় একে? আমি এর নাম দেবো কী?
চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করে ‘ভালোবাসা’। নাম দিলাম ভালোবাসা।
ঠিক আছে?
(চলবে)
বাংলাদেশ সময়: ১৯০৩ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০২, ২০১৬
এমজেএফ/
আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন-
**মধ্যবিত্ত | কিঙ্কর আহ্সান (পর্ব- ১)
** মধ্যবিত্ত | কিঙ্কর আহ্সান (পর্ব- ২)
** মধ্যবিত্ত | কিঙ্কর আহ্সান (পর্ব- ৩)
** মধ্যবিত্ত | কিঙ্কর আহ্সান (পর্ব- ৪)
** মধ্যবিত্ত | কিঙ্কর আহ্সান (পর্ব- ৫)
** মধ্যবিত্ত | কিঙ্কর আহ্সান (পর্ব- ৬)
** মধ্যবিত্ত | কিঙ্কর আহ্সান (পর্ব- ৭)
** মধ্যবিত্ত | কিঙ্কর আহ্সান (পর্ব-৮)
** মধ্যবিত্ত | কিঙ্কর আহ্সান (পর্ব-৯)