১২.
দুই বন্ধু ও ভালুকের গল্পটি মনে পড়ল। ভালুককে আসতে দেখে এক বন্ধু উঠে গেল গাছে।
ডা. ফাহমিদের কেস স্টাডিগুলো পড়তে পড়তে বন্ধুত্বের রকম ফের নিয়ে নানা কথা মাথায় আসছে। ফেসবুকের সুবাদে কত কী ঘটছে! সত্যি বন্ধু, মিথ্যা বন্ধু, সত্যি-মিথ্যা ঘটনা এসে জড়ো হচ্ছে। মানসিকভাবে আক্রান্তও হচ্ছে কেউ কেউ। ডা. ফাহমিদ একটি ঘটনা লাল কালিতে চিহ্নিত করে রেখেছেন। ... ফেসবুকে পরিচয় বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া অনিক ও তাহমিদার। আলাদা আলাদাভাবে তাদের দুজনের কাছেই প্রশ্ন করা হলো, ‘ফেসবুকে কী করে আসল বন্ধুর পরিচয় পাবেন? অন্তত দুটি করে বুদ্ধি বাতলান। ’ উত্তর এলো, ‘নাহ! তেমন কোনও বুদ্ধি তো পাচ্ছি না!’ উত্তর পাওয়া আসলেই কষ্টকর।
ফেসবুকে যে এত শত বন্ধু, যাদের সঙ্গে দিনের অনেকটা সময় কাটছে, তারা কেমন বন্ধু? তাদের বর্ণিত পরিচয় আর আসল পরিচয়ের মধ্যে সম্পর্ক কী? ফেসবুকের বন্ধুটি যদি বাস্তবের বন্ধুও হন, তাহলে কোনও সমস্যাই নেই। তাকে ভালোভাবে চেনা-জানা যায়। কিন্তু কেবল ফেসবুক-বন্ধুর বেলায় সত্যিকারের বন্ধু চেনা খুব কঠিন। এমনকি ফেসবুকের প্রোফাইলটি আসল না ফেক, এটা বের করাও বেশ মুশকিল। ‘মানুষ নিজে কী ভাবে, কী চায়, সেটা প্রকাশ করার জন্য মুখিয়ে থাকে’, কথাটা বলেছেন ফেসবুকের সহপ্রতিষ্ঠাতা মার্ক জাকারবার্গ। কথাটি নিশ্চয় সত্যি। সত্য না হলে লাখ লাখ মানুষ ফেসবুকে কী করে! কিন্তু নিজেকে প্রকাশ করার জন্য প্রয়োজন প্রকৃত বন্ধু, সঠিক মানুষ। মানুষ যখন বাস্তবের বন্ধুসঙ্গ থেকে দূরে থাকে, তখন বিকল্প কিছু তো খুঁজবেই। সমস্যাটি বেশ ভালো ধরতে পেরেছেন জাকারবার্গ। ফলে ফেসবুকের এমন রমরমা অবস্থা।
ডা. ফাহমিদের কাছে জানতে চেয়েছিলাম:
-বাস্তবে যথেষ্ট বন্ধু এবং বন্ধুসঙ্গ থাকার পরও ফেসবুকের বন্ধুত্বের পেছনে ছুটছে কেন সবাই?
তিনি জানালেন:
-আমিও বিষয়টি নিয়ে ভেবেছি। কয়েক জনের সঙ্গে আলাপও করেছি। একজন আমাকে বলেছে, ‘বাস্তবে বন্ধুদের আড্ডায় এক ধরনের একঘেয়েমি কাজ করছিল। তাছাড়া অনেকেই আমাকে বুঝত না। ফলে ফেসবুকের অজানা-অচেনা একজন মানুষের সঙ্গে কথা বলার সময় সব কিছু নতুন ও রোমাঞ্চকর মনে হতো। অত দায়বদ্ধতা ও দায়িত্ববোধও কাজ করত না। কথা বলছি, ভাব বিনিময় করছি, ভালোই তো। ’ আসলে এটাও একটা নেশার মতো। কিন্তু অনেকেই জানে না, মার্কিন লেখক হেনরি অ্যাডামস-এর বিখ্যাত উক্তি, ‘বন্ধুরা জন্মায়, তৈরি হয় না। ’
আমার মনে পড়লো, একটি গান আজকাল খুব কানে ভাসে। কৃষ্ণকলি নামে একজন নতুন গায়িকার গান। গায়কীর বৈচিত্রের জন্য মেয়েটির গান অন্যদের চেয়ে যথেষ্ট আলাদা। মেয়েটি গভীর দরদ নিয়ে গাইছে: ‘বন্ধু আমার বন্ধু তুমি/বন্ধু মোরা কজন/তবুও বন্ধু মন হলো না আপন...’ হায়! এখন চলছে কঠিন বন্ধু, বায়বীয় বন্ধুর যুগ। বন্ধুত্বের নানা জটিলতার আমল!
সামাজিক ও ব্যক্তিগত বন্ধুত্বহীনতার শূন্যতাবোধের এই দিকটির প্রতি ইঙ্গিত করতেই ডা. ফাহমিদ বলেন:
-জীবনের ধরনও তো সম্পূর্ণ বদলে গেছে। জীবনের চাহিদা, সামগ্রী, চাওয়া, পাওয়ার আকৃতি ও বৈশিষ্ট্য আর আগের মতো নেই। বাইরের এই পরিবর্তন মনে পরিবর্তন আনবেই। সে পরিবর্তন সবাই যোগ্যতার সঙ্গে সামাল দিতেও পারছে না। আমাদের নিত্য ব্যবহার্য হাতের আইফোনটির অ্যাপস আইকনগুলোর দিকে কি মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে দেখেছি কখনও? ক্যালেন্ডার, ক্যালকুলেটর, বুকশেলফ ইত্যাদি বহু অ্যাপ্লিকেশনে সমৃদ্ধ আমাদের স্মার্টফোন। কিন্তু ফোনের ওই ক্যালেন্ডার কিংবা ঘড়ি অথবা ক্যালকুলেটরগুলোর জন্য যে আইকন ব্যবহার করা হয়েছে, সেগুলো কি দেখতে বাস্তব জীবনের ক্যালেন্ডার কিংবা টেবিল ঘড়ি কিংবা ক্যালকুলেটরের মতো? একদমই না। এই দুস্তর পার্থক্যের বিষয়টি চোখ এড়ায় নি বিশ্বখ্যাত ‘টাইম’ ম্যাগাজিনের।
দেখা গেছে, বর্তমান ডিজিটাল দুনিয়ার সঙ্গে বাস্তব জগতের বিরাট পার্থক্য। মানুষের জীবনও ভাগ হয়ে গেছে ভার্চুয়াল লাইফ আর রিয়েল লাইফে। এই দুইয়ের তাল সামলাতে সবাই ব্যস্ত। কেউ ভারসাম্য রাখতে পারছে, অনেকেই পারছে না। এই প্রসঙ্গে শোনা যাচ্ছে ‘স্কিউমরফ’ নামের একটি নতুন শব্দ। মাউস, কী-বোর্ড, পোক ইত্যাদি বহু সাইবার শব্দের মতো এটিও একটি। তবে স্কিউমরফ শব্দটি অনেকের কাছে নতুন, অচেনা ও কাঠখোট্টা ঠেকলেও ডিজিটাল দুনিয়ায় এই স্কিউমরফ প্রসঙ্গে চলছে নানা আলোচনা, বিতর্ক, গবেষণা। ১৮৫০ সালে হেনরি কোলি মার্চ নামের একজন প্রত্নতত্ত্ববিদ একটি প্রবন্ধে প্রথম শব্দটি ব্যবহার করেন। শব্দটির মানে হচ্ছে, কোনও বস্তুর চেহারা বা নকশায় এমন কিছুর উপস্থিতি, যার বাস্তব জীবনের কোনও ব্যবহার নেই। অথচ নকশায় জিনিসটির উপস্থিতি আলঙ্কারিক। হেনরি কোলি মার্চের ওই স্কিউমরফ শব্দ যে একুশ শতকে ডিজিটাল দুনিয়াকে টালমাটাল করে দেবে, সেটা কি ১৮৫০ সালে বসে তিনি ভেবেছিলেন?
ডা. ফাহমিদ জানালেন:
-ভার্চুয়াল জগত এত দিন দাঁড়িয়ে ছিল মার্চের স্কিউমরফের ধারণার ওপর ভিত্তি করে। ১৯৮৪ সালে অ্যাপল কোম্পানির ম্যাকিনটোশ কম্পিউটার যখন প্রথম বাজারে এলো, তখন গ্রাফিক্যাল ইউজারস ইন্টারফেসের অনেক কিছুর মধ্যেই এই স্কিউমরফের উপস্থিতি ছিল লক্ষণীয়। ম্যাকিনটোশে যে ডেক্সটপ আইকনগুলো ব্যবহার করা হয়েছিল, সেগুলো মানুষের বাস্তব জীবনের বেশ কাছাকাছি নিয়ে আসা হয়েছিল। কিন্তু সেটা এসেছিল অবাস্তব চেহারা নিয়ে। ডিজিটাল দুনিয়ায় স্কিউমরফিজমের শুরু সেই থেকে। এরপর সেই অ্যাপল কোম্পানিই বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ডিজিটাল পণ্য মানুষের নাকের ডগায় এনে দাঁড় করিয়েছে কিছুটা অবাস্তব চেহারায়। বাস্তবের সঙ্গে অ্যাপলের অনেক কিছুর মিল না থাকলেও সেগুলো দিয়েই মানুষ ডিজিটাল দুনিয়ায় চিনে নিয়েছে বাস্তব জগতকে। হয়তো ডিজিটাল বিপ্লবের প্রাথমিক সময়ে ওই রকম কিছুর প্রয়োজন ছিল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ডিজিটাল ব্যবহারকারীদের মধ্যে দাবি জোরালো হচ্ছে, ডিজিটাল জগতের সঙ্গে বাস্তব জগতের বন্ধনকে আরও জোরালো করতে। কিন্তু সেটা কি সম্ভব? ভার্চুয়াল বনাম বাস্তব জীবন কি এক সূত্রে এসে মিশবে কোনও দিন? মেক্সিকো থেকে পাঠানো একটি চুম্বন কি বাংলাদেশে বাস্তবে গ্রহণ করা যাচ্ছে?
আসলেই তো, এখানেই তৈরি হচ্ছে ভয়ঙ্কর সমস্যা। ভার্চুয়ালি প্রেম, সেক্স, এমন কি বহু অন্তরঙ্গ বিষয় উপভোগ করার পর বাস্তবে এসে সেটার অতৃপ্তি ও হতাশার দিকটি হাজির হচ্ছে। ভার্চুয়ালি যা সত্য, বাস্তবে তা নয়। মন ও মগজ সেটা সব সময় মানতে নারাজ। প্রতিদিন সাইবারের ভার্চুয়াল জগতে একজনের সঙ্গে প্রেম বা বিরহ বা যৌন জীবন-যাপন করার পর মনে সেটা এক ধরনের সত্য প্রতিরূপ পায়। সেটা ভেঙে গেলে মনে প্রচণ্ড নেতিবাচক আলোড়ন হয়। অনেকে ভার্চুয়াল বিষয়কে বাস্তবে পেতে চায়। কেউ কেউ পায়। যারা পায় না, তারা হতাশ হয়। বিকৃতভাবে সেটার সন্ধান করে। না পেলে নেশা বা স্বপ্নের আরেক জগতে অবাস্তবকেই বাস্তব ঠাউরে ধরে রাখে। এক অবাস্তব থেকে তখন তৈরি হয় একের পর এক জটিলতাময় অবাস্তবের জগতসমূহ। নেশা সেই কাল্পনিকতাগুলোকে টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করে। একজন মানুষ এভাবেই বাস্তব থেকে একটি অলীক জগতে চলে যায়। নিঃসঙ্গ, হতাশ, বিষণ্ন, মাদকাসক্ত হয়।
এনামুলের ফোনে ভাবনায় ছেদ পড়ল:
-বাসাতেই আছিস দেখছি?
আমি উত্তরে বলি:
-হ্যাঁ। তুই কী করে জানলি?
এনামুল রহস্যভরা হাসিতে বললো:
-জানতে হয় রে, জানতে হয়। আমরা যারা ব্যবসা করি, তাদের অনেক কিছুই জানতে হয়।
এনামুল হয়তো ঠিকই বলেছে। আমি ব্যবসার কিছুই বুঝি না। জীবনে ব্যবসার ধারে-কাছেও যাই নি। পড়াশোনা, লেখালেখিই আমার জীবনের চৌহদ্দী।
এনামুল দরদ মাখা কণ্ঠে এবার বলল:
-কোথাও গেলে বলে যাস। সাবধানে যাস। দিনকাল কেমন হয়েছে, দেখতেই পাচ্ছিস। তুই আবার বিপজ্জনক বিষয়ে কাজ করছিস। অতএব হুশিয়ার।
আমি তাকে আশ্বস্ত করি:
-ঠিক আছে। আমি সাবধানে থাকবো। প্রয়োজনে তোকে জানাবো। আমাকে নিয়ে চিন্তা করিস না।
এনামুল ফোন কেটে দিল। ওকে সব কিছু জানানোই ভালো। কিন্তু জানাবো কি? আগে-ভাগে সে-ই তো মনে হচ্ছে সব জেনে যাচ্ছে।
আবার নিজের বিষয়ে মনোযোগী হলাম। প্রচুর হোম ওয়ার্ক ইত্যাদিও করা হলো। ঘরে বসে ভাবনা-চিন্তা, পড়াশোনা ও তথ্য নাড়াচাড়া কম হয় নি। এবার বাস্তবের মাঠ থেকে নিখাদ তথ্য টেনে আনতে হবে। আগামী কয়েকটি দিন বাইরেই কাটাতে হবে। মনে মনে সেই প্রস্তুতি নিচ্ছি। আর ভাবছি, কেমন যেন একটি শূন্যবৃত্তে চক্কর খাচ্ছি। কিছুই যেন কূল-কিনারা করতে পারছি না। দেখা যাক, বাইরের বাস্তব জগতে কী অপেক্ষা করছে!
বাংলাদেশ সময়: ১৫৪০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৪, ২০১৭
জেডএম/