২৮.
বাংলাদেশে সেমিনার মানে এক এলাহি ব্যাপার। যত না কাজ, তার চেয়ে হৈ-হাঙ্গামা বেশি।
এনামুল, রোকসানা, অন্তরা, জেনিফার কয়েক বার করে ফোন করেছে। কয়েকটি ফোন এসেছে অচেনা নম্বর থেকে। ইচ্ছেও করে নি, ব্যস্ততাও ছিল, কারও ফোনই ধরা হয় নি। ওদের কাছ থেকে চিন্তাযুক্ত এসএমএস পেলাম। আমি কোথায় আছি, জানতে চায়। আমার সন্ধান না পেয়ে তারা উদ্বিগ্ন। আমার জন্য অনেকেই উদ্বিগ জেনে ভালোই লাগছে। এনামুলের এসএসএমটি বেশ ইন্টারেস্টিং: ‘তুই কোন এলাকায় আছিস আমি জানি। গুলশানে। চাইলে বাড়িও বের করতে পারবো। ‘ কি বলতে চাচ্ছে সে? আমি ওর হাতের মুঠোর বাইরে নই, এটাই কি জানাতে চাচ্ছে? এনামুলকে একটি উত্তর দেওয়া দরকার। লিখলাম: ‘কষ্ট করে আমাকে খুঁজে বের করতে হবে না। তোর সঙ্গে দেখা না করে আমি দেশ ছেড়ে পালাবো না। ’ এরপর কারও ফোন, এসএমএস নেই। কাজের জন্যে ভালোই হলো। সেমিনারের দিন সকালে মার্গারেট এলো। আমার সেমিনার পেপারও তৈরি। যথাসময়ে আমরা হোটেল রূপসী বাংলায় চলে এলাম। এখানেই অনুষ্ঠিত হবে সেমিনার।
বাংলাদেশের বাইরে থাকায় এখানকার সেমিনার কালচার সম্পর্কে আমার কোনও ধারণাই হয় নি। দেখলাম, হোটেলে ছোট-বড় প্রতিটি রুমেই সেমিনার চলছে। সাবেক আমলা, মোসাহেব আর কিছু সাদা চামড়ার পণ্ডিতে পুরো হোটেল জমজমাট। একটি সেমিনারের বিষয়বস্তু দেখলাম, ‘কৃষি ও কৃষকের সমস্যা’। ভিতরে উঁকি দিয়ে দেখি, সব কোট-প্যান্ট। সরেজমিনে কিছু বলার জন্য লুঙ্গি-গামছার একজন কৃষকও উপস্থিত নেই! তানিয়া জানালো, ‘খুব কষ্ট করে ভেন্যু জোগাড় করতে হয়েছে। সাধারণত মাস খানেকের আগে হল পাওয়া যায় না। আপনি তো বিদেশে থাকেন, জানেন না। ঢাকায় এখন বিয়ের দিন ধার্য করা হয় হল খালি পাওয়ার দিন দেখে। ’
আমাদের সেমিনার হোটেলের হল রুমে। ঢুকতেই দেখি জনারণ্য। সাত সকালে এতো লোক চলে এসেছে! মিডিয়ার লোকজন যেন উপচে পড়ছে। বাংলাদেশে প্রিন্ট আর ইলেকট্রনিক মিডিয়া মিলিয়ে রীতিমত একটি বিপ্লব হয়ে গেছে। কিছু বিদেশি সাংবাদিককেও দেখতে পেলাম। সাংবাদিকদের জন্য নির্দিষ্ট আসনের সামনের সারিতে শামীম বসে আছেন। পাশে আড়ষ্টভাবে বসা তরুণ সাংবাদিক ফরমানউল্লাহ। ফরমানের চোখ বিড়ালের মতো পুরো হল রুম ঘুরে বেড়াচ্ছে। তানিয়াকে বললাম:
-বেশ ভালো আয়োজন হয়েছে দেখছি?
সে হেসে বললো:
-এমনি এমনি হয় নি স্যার। টাকা-পয়সাও খরচ করতে হয়েছে। এসব অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারী সকলের জন্যই মর্যাদানুসারে পকেট মানির ব্যবস্থা রাখতে হয়।
আমি ভাবলাম, হবে হয়তো। নইলে মাদকের মতো একটি নিরস বিষয়ে এতো আগ্রহ কেন।
আমাদেরকে মঞ্চে আসন নেওয়ার জন্য ডাকা হচ্ছে। আমি, মার্গারেট, একজন মন্ত্রী, একজন আমলা, একজন বিশেষজ্ঞ ডায়াসে গিয়ে বসি। পুরো হল রুমটি একবার ভালো করে চোখ বুলিয়ে দেখলাম। বাহ! বেশ কালারফুল ও ওজনদার নারী-পুরুষের মেলা। সেমিনার জমবে, ভালোই মনে হচ্ছে।
একি! আমি আঁতকে উঠি। পেছনের দিকে এনামুল বসে আছে যে। ব্যাটা ঠিকই গন্ধ শুঁকে চলে এসেছে। আমার বিস্ময়কে হিমালয়স্পর্শী করে দেখতে পেলাম ছড়িয়ে ছিটিয়ে রোকসানা, মিসেস খোন্দকার, জেনিফার, মলি, পরীও এসেছে। এক সঙ্গে বসে নি। কেউ কাউকে চেনেই না, এমন ভাব করে আলাদা বসে আসে। আমাকে টলিয়ে দিয়ে শেষ মুর্হূতে অন্তরাও এসে হাজির হলো। ব্যাপার কি! সবাই একযোগে উপস্থিত!
বক্তারা আপ্রাণ বক্তব্য রাখছেন। চোখে-মুখে-কথায় জিহাদের ভঙ্গি। যেনবা বক্তব্য শেষ করে স্টেজ থেকে নেমেই চলে যাবেন মাদকের বিরুদ্ধে জঙ্গ-যুদ্ধের ময়দানে। হাত-পা নাড়িয়ে উচ্চকণ্ঠ বক্তাবর্গ সেমিনারকে জনসভা বানিয়ে ছাড়বে দেখছি? আমি মনে মনে প্রমাদ গুণলাম। আমার কাঠখোট্টা কথা লোকে শুনবে তো?
বেশ ভালো করেই শুনলো শ্রোতারা আমার বক্তব্য। পাওয়ার পয়েন্টে একটি একটি স্লাইড দেখিয়ে আমি পুরো বিষয়টি তুলে ধরছি। মাদক কেন মানুষ সেবন করে, এর কারণ বিস্তারিত ব্যাখ্যা করি। মাদক সেবনের ফলে শারীরিক-মানসিক প্রতিক্রিয়ার ব্যাপারটিও স্পষ্ট করি। তারপর চলে আসি প্রবন্ধের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়বস্তুতে: মাদক কিভাবে ছড়িয়ে পড়ছে সমাজে, বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে। আমি বিভিন্ন সীমান্ত, এয়ারপোর্ট থেকে রাজধানীর কেন্দ্র পর্যন্ত বিস্তৃত সিন্ডেকেটের কথা তুলে বলি:
-এটি একটি শৃঙ্গের মতো। পুরো দেশ থেকে চালান আসে কেন্দ্রে এবং সেখান থেকে আবার দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। ক্ষমতার শীর্ষ থেকে ক্ষুদ্র পাচারকারী পর্যন্ত এতে জড়িত। খুচরা ব্যবসায়ী থেকে পাইকারি মজুতদার পর্যন্ত এতে কাজ করছে। ড্রাগসের এই ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িয়ে আছে সেক্স, ক্রাইম, ভায়োলেন্স, মানি। আর পুরো প্রক্রিয়াটিকে পাহারা দিচ্ছে রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতাবানরা।
আমার বক্তব্যে হল রুমে পিন পতনের নিরবতা নেমে এলো। মন্ত্রী, আমলারা শুকনো মুখে একজন আরেকজনকে দেখছে। এনামুল মনে হলো কার সঙ্গে আকারে-ইঙ্গিতে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলো। ভাব বিনিময় করে সে আর বসলো না। আস্তে করে উঠে চলে গেলো। একটি দুর্ধর্ষ চেহারার লোকও তার পিছন পিছন চলল। অন্যদিকে তাকিয়ে দেখি, মার্গারেট। গেস্টদের সঙ্গে হাসছে। মার্গারেটের মুখে দেখা গেলো খুশির ঝলক।
সেমিনার শেষ হলো। আমি নিস্তার পেলাম না। বাংলাদেশের মিডিয়া কালচারে আজকাল এক অদ্ভুত উৎপাত শুরু হয়েছে। সভা-সমাবেশ শেষে মূল বক্তাকে রিপোর্টাররা ছেঁকে ধরে। তাদের হাতে ডান্ডার মতো মাইক্রোফোন। তানিয়া পাশে এসে কানে কানে বললো:
-স্যার মিডিয়া অপেক্ষা করছে। আসুন।
আমি বিরক্ত হয়ে বলি:
-যা বলার আমি তো আমার বক্তব্যেই বলেছি। তারপরেও আবার কথা কেন?
তানিয়া আমাকে ব্যাপারটি বুঝিয়ে বলে:
-এটাই নিয়ম স্যার। এসব স্পেশাল বক্তব্যের জন্যে কতজন কত টাকা খরচ করে। আপনি এমনিই সুযোগ পাচ্ছেন। আসুন স্যার।
জনা বিশেষ সাংবাদিক মাইক বাড়িয়ে দিল আমার দিকে। আলো জ্বলছে ক্যামেরার। এক তরুণী সাংবাদিক প্রশ্ন করলো:
-সিন্ডিকেট সম্পর্কে আমাদেরকে আরও বিস্তারিত বলুন?
তার মুখের কথা শেষ হওয়ার আগেই আরেক যুবক ক্ষেপাটে গলায় জানতে চাইলো:
-আপনি কি সিন্ডিকেট শনাক্ত করতে পেরেছেন?
বেশ একটা সোরগোল শোনা গেল:
-সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িতদের নাম বলুন?
দেখলাম ভিড়ের পাশে তরুণ সাংবাদিক ফরমানউল্লাহ উপস্থিত। সঙ্গে তার বিড়াল চোখ। ছোক ছোক করছে দৃষ্টি।
আমি ধীরে ধীরে বলি:
-সিন্ডিকেট একটি অবৈধ ও অপ্রকাশ্য বিজনেস গ্রুপ। মাদক ব্যবসা প্রসারে এমন বেশ কিছু সিন্ডিকেটের সন্ধান আমি পেয়েছি। যারা শিকড় থেকে শীর্ষ পর্যন্ত মাদক সংগ্রহ ও বিপণন করে। তবে গবেষণার স্বার্থে আমি এখনই তাদের নাম প্রকাশ করছি না।
মৌমাছির ঝাঁকের মতো সাংবাদিকরা আমার উপর আছড়ে পড়ল:
-নাম জানলে আপনাকে বলতে হবে। বলুন কারা কারা জড়িত?
সাংবাদিকদের কারও কারও মধ্যে দেশপ্রেম ও জাতিস্বার্থ টগবগ করতে দেখলাম। আর কথা বাড়ালে তারা চরম উত্তেজিত হয়ে পড়বে। আমি আবারও ঠাণ্ডা মাথায় বললাম:
-দেখুন, আমাকে কথা বলতে হবে আমার কাজের দিকে লক্ষ রেখে। আপাতত আমি এ পর্যন্তই বলছি। ভবিষ্যতে আমি পুরো তথ্যচিত্র আপনাদের সামনে তুলে ধরবো।
ধন্যবাদ জানিয়ে আমি সরে এলাম। কাউকে কাউকে ক্যামেরা নিয়ে আমার পিছন পিছন ছুটে আসতে দেখা গেলো। মার্গারেটের ফ্লাইট আজ রাতেই। ওর সঙ্গে সময় কাটানো হয় নি। আরও কিছু আলাপ আছে, সেরে নিতে হবে। মার্গারেট আমাকেই খুঁজছিল। কাছে এসে বললো:
-তাড়াতাড়ি চলো। সেমিনারের পর তোমার নিরাপত্তার সমস্যা আরও তীব্র হবে। বলবে না বলবে না করেও তুমি অনেক কথা বলে দিয়েছো। তোমার প্রতিপক্ষ বিষয়টি সহজভাবে নেবে না। আমি ঢাকা ছেড়ে যাওয়ার আগেই তোমার ব্যাপারে একটি ব্যবস্থা করে যেতে চাই।
কথা বলতে বলতে আমরা হোটেলের গাড়ি বারান্দায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছি। পাশে তানিয়া। সে ড্রাইভারকে গাড়ি নিয়ে আসার জন্য ফোন করলো। পেছনে এখনও সাংবাদিক লেগে আছে। চলে যাওয়ার আগে আমি কোনও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বলি কি না, সেটাই তারা ফলো করছে। অকস্মাৎ কিছু বুঝে উঠার আগেই আমি টলে উঠলাম। ‘টাস’ করে একটি শব্দ হলো শুনতে পেয়েছি। গুলি। মাথায় হাত দিয়ে দেখি কপাল ভিজে যাচ্ছে রক্তে। আতঙ্কে সবাই ছুটাছুটি শুরু করেছে। কোনও কোনও সাংবাদিক আমার দিকে ক্যামেরা তাক করে আছে। মার্গারেট আর তানিয়া আমাকে জাপটে ধরে ভূপতিত হওয়া থেকে রক্ষা করলো। জ্ঞান হারানোর আগে আমি টের পেলাম, আমাকে গাড়িতে তোলা হচ্ছে।
একটি থামের আড়ালে দাঁড়িয়ে অন্তরা সব কিছু ঠান্ডা মাথায় লক্ষ্য করলো। কেউ তাকে দেখতে পেলো না। গাড়িতে রক্তে ভেজা শরীরে আমি মার্গারেটের কাঁধে পুরো শরীর এলিয়ে দিয়ে জ্ঞানশূন্যভাবে পড়ে আছি। অন্তরা সাপের মতো শীতল চোখে মার্গারেটকে দেখলো। ওর নাক দিয়ে হিস্ হিস্ শব্দ বের হচ্ছে।
হোটেল চত্বরের বাগানটির আড়ালে থেকে নিজেকে লুকিয়ে তরুণ সাংবাদিক ফরমানউল্লাহ উত্তেজিত ও কাঁপা কণ্ঠে পুরো ঘটনাই গুরুত্বপূর্ণ কাউকে ফোনে জানাচ্ছে। তার এখন বিড়ালের চোখ নেই। সাপের শীতল চোখ। (চলবে)
বাংলাদেশ সময়: ১১০০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৪, ২০১৭
জেডএম/