পৃথিবীর সব জায়গার আকাশ নীল। তবে মরক্কোর শেফশেওয়েন শহরটি নীল আকাশের নিচে নীলে নীলময়।
উত্তর মরক্কোর রিফ পর্বতমালার মধ্যযুগীয় এ শহরে পর্যটকদের ঢল নামে এ নীল রঙের কারণেই। শহরটির পরিচিতিও বাইরের বিশ্বের কাছে ‘নীল মুক্তা’ নামে।
শহরের পুরনো অংশেই নীল রঙের চল বেশি। নীলের চাদরে মোড়া এ অংশটি পরিচিত মেদিনা নামে।
রঙের সঙ্গে মিলিয়ে শেফশেওয়েনের ৪০ হাজার বাসিন্দার বেশিরভাগই নীল রঙের কাপড় পরে ঘুরে বেড়ান। তাদের আচার-ব্যবহার ও খাবারেরও রয়েছে দারুণ সুনাম।
পুরো শহর নীল রঙে রাঙানোর পেছনে রয়েছে ঐতিহ্য ও ইতিহাস। শেফশেওয়েন এক সময় একটি নারীপ্রধান গ্রাম ছিল, যেখানে নানা ধর্মের মানুষ একসঙ্গে বাস করতেন। তারা খুব একটা শিক্ষিত ছিলেন না, তবে কিছু উজ্জ্বল ধারণায় তাদের গ্রামকে সাজাতেন।
এভাবে ১৪৭১ সালে শহরে রূপান্তরিত হয় শেফশেওয়েন। এরপর নানা যুদ্ধ-বিগ্রহ লেগেই ছিল। ১৯৩০-এর দশকে হিটলারের ভয়ে ইহুদিরা জার্মানিরা পালিয়ে আশ্রয় নেন মরক্কোর এ শহরে। সে সময়ই ইহুদি শরণার্থীরা নিজেদের ঘর-বাড়ি থেকে শুরু করে পুরো শহরটি নীল রঙে ঢেকে ফেলেন।
তাদের কাছে নীল রংটি ছিল আকাশ আর স্বর্গের প্রতীক। তাই আকাশের নীলটুকু মর্ত্যে নামিয়ে আনতে শহরজুড়ে নীলে রাঙিয়ে দেন তারা।
শহরের সব কিছু নীল রং হওয়ার পেছনে আরেকটি খুব মজার কারণও দেখিয়েছেন অনেক বাসিন্দা। তারা বলেন, মশারা টলটলে নীল জল একটুও পছন্দ করে না। আর তাই মশার হাত থেকে নিস্তার পাওয়ার চেষ্টা এটি।
নীল রং দেওয়ায় ঘরের ভেতরে সব সময়ই পানির মতো এক ঠাণ্ডা আমেজ বয়ে যায়- এমনটাও দাবি করেন মেদিনার লোকজন।
১৯৪৮ সালে বেশিরভাগ ইহুদি ইসরায়েলে চলে গেলেও মেদিনার নীল রংটি রয়েই যায়। স্থানীয় মুসলিমদের কাছেও নীল একটি আধ্যাত্মিক রঙ হওয়ায় ধারাটি অব্যাহত থাকে। প্রতি বছর বসন্তের সময় পুরনো মেদিনা শহরের বাসিন্দারা তিনবার নীল রঙে রাঙিয়ে দেন। পুরো শেফশেওয়েন শহরে নীলের প্রলেপ পড়ে অন্তত: একবার করে। স্থানীয় সরকারও শহরটির পুরনো ঐতিহ্য ধরে রাখতে সব ধরনের সহায়তা দেয়।
তবে মেদিনার ঐতিহাসিক দুর্গের মূল পাথুরে লালচে-কমলা রঙ অপরিবর্তিত রয়েছে, মসজিদের পাশের অংশটিও ঐতিহ্যগতভাবে সাদা। ‘কিন্তু শুধুমাত্র প্রথার কারণেই তা অক্ষুণ্ন রয়েছে। নীলের সঙ্গে খানিকটা গোলাপি, হলুদ আর সবুজ রঙের দেখা মিললেও নীলের রাজত্বে ওগুলো বড্ড ফিকে’- বলেন শহরের বাসিন্দা ও গাইড অ্যাডবেসলাম মৌডেন।
‘প্রথাগতভাবে শহরের একাংশ পুরনো ইহুদি এলাকা মেদিনা নীলে আঁকা ছিল। বাকি বেশিরভাগ অংশে ছিল সাদার প্রাধান্য। এখনো পুরো পুরনো শহরটিকে বছরে তিনবার নীলে রাঙানো হয়। আর পুরো শেফশেওয়েন শহরটির নীলের ঐতিহ্য মাত্র বিশ বছরের’- বলেন তিনি।
নীল মেদিনা শহরে ঢুকে রাস্তা ধরে হাঁটলে সব মানুষেরই নীল সমুদ্রে হারিয়ে যাওয়ার অনুভূতি হয়। তবে নীলে ঢাকা সরু অলি-গলি ঘুরতে গেলে গোলকধাঁধায় পড়তে হয়। আবার সংকীর্ণ পার্শ্ব রাস্তাগুলোর সড়কবাতির ছায়াকে নীলকান্ত মণির মতো দেখায়।
সূর্য যখন আকাশজুড়ে চলে, তখন শেফশেওয়েনের একপাশ আলোকোজ্জ্বল হয়, অন্যপাশের ছায়া এপাশে পড়ে আরও অনাবিল সৌন্দর্যের সৃষ্টি করে। আবার সরাসরি সূর্যালোকিত নীল রঙ যেন সুমেরু অঞ্চলের নীল ঝুমকো ফুলে রূপান্তরিত হয়।
সমগ্র শহরটিকে নীলায়িত করার পেছনে নারী বাসিন্দাদের অবদান বেশি বলে মনে করা হয়। তাদের হাতে মলিন একটি গ্রাম নীল আধুনিক রুপান্তরিত হওয়াকে অনেকে অসম্ভব স্বপ্নকে বাস্তবে পরিণত করা এবং বন্ধুর যাত্রাপথে একটি সৃষ্টিছাড়া বাঁশির হুইসেল বলে বর্ণনা করেন। মরক্কোর শেফশেওয়েন শহরের গন্তব্যে গিয়ে সফল হয়েছে সে যাত্রা।
তবে শুধু নারীদের হাতেই এ ঐতিহ্য শুরু হয়নি। কিন্তু তারা রাতের বেলায় দুই বা তিনটি পেইন্টিংকে সহায়তা করেছেন দলগুলোর সঙ্গে, যখন বাকি শেফশেওয়েন ঘুমাচ্ছেন। আজও তা অব্যাহত রয়েছে। পরের দিন শোষক নীল রঙ তাদের কাজের সামান্য নিদর্শন রেখেও দেয় একপাশে।
বাংলাদেশ সময়: ০০৫৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ০৩, ২০১৬
এএসআর/এসআর