পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্রের দেশ ভারত ১৩৫ কোটি মানুষের দেশ। সেই দেশের লোকসভার সদস্যসংখ্যা ৫৪৩।
সংসদীয় কমিটিগুলোর চেয়ারম্যান, যিনি একজন সংসদ সদস্য; কিন্তু মন্ত্রিসভার সঙ্গে যুক্ত নন, এমনকি বেশ কিছু স্ট্যান্ডিং কমিটির প্রধান হন শাসকদলের পক্ষ থেকে। আর বেশ কিছু আছে বিরোধী দলের পক্ষ থেকে।
সংসদীয় কমিটির কাজ হচ্ছে, স্ট্যান্ডিং কমিটির পক্ষ থেকে সরকারের কাছে বিভিন্ন বিষয়ে প্রস্তাব পেশ করা, সুপারিশ করা। এমনকি বিভিন্ন বিল, যেগুলো সংসদে পেশ হয়, সেগুলোও বাধ্যতামূলকভাবেই আজকাল স্ট্যান্ডিং কমিটিতে আসে এবং বিচার-বিবেচনা হয়ে আবার সংসদে ফিরে যায়।
তারপর সংসদ থেকে সেটা ক্যাবিনেটে যায়। ক্যাবিনেট একতরফা কোনো বিল এখন আর সংসদে পাস করতে বা অনুমোদন দিতে পারে না।
তিস্তা চুক্তি বাস্তবায়ন আবার আলোচনায় এই সংসদীয় কমিটি ছাড়া আর একটা বিশেষ কমিটি আছে, যেগুলোকে বলা হয় ‘পরামর্শদাতা কমিটি’। প্রতিটি মন্ত্রণালয়ের একটি করে পরামর্শদাতা কমিটি হয়।
সেই পরামর্শদাতা কমিটিগুলোর চেয়ারম্যান হন সেই মন্ত্রী। অর্থাৎ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যে পরামর্শদাতা কমিটি, তার প্রধান হবেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং সেই পরামর্শদাতা কমিটিতে বিভিন্ন দলের সদস্য থাকবেন।
স্ট্যান্ডিং কমিটির গুরুত্ব সব সময় বেশি এই কারণে যে এটি সংসদের মন্ত্রিসভার সঙ্গে যুক্ত নয়, কিন্তু সংসদীয় ক্ষমতাসম্পন্ন। তারা যে সুপারিশ করে, সেটা সংসদে পেশ করা হয়। সংসদে পেশ করা সেই রিপোর্টের ভিত্তিতে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি হয় এবং সরকার নানাভাবে কাজ করে।
অনেক সময় সরকারের পক্ষ থেকেও স্ট্যান্ডিং কমিটির কাছে অনেক বিষয় পেশ করা হয় বিবেচনার জন্য।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের স্ট্যান্ডিং কমিটির প্রধান হচ্ছেন প্রেমপ্রকাশ চৌধুরী। তিনি শাসকদল বিজেপির একজন ৬০ বছর বয়সী সংসদ সদস্য। সুপ্রিম কোর্টের বিশিষ্ট আইনজীবী এবং সাবেক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী। নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর করপোরেট বা আইন বিষয়ে তিনি রাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবেও কাজ করেছেন। তিনি এখন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের স্ট্যান্ডিং কমিটির প্রধান। ফলে যে রিপোর্টটি সংসদীয় কমিটি পেশ করেছে, সেটি সর্বদলীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতেই পেশ করা হয়েছে।
শাসকদল বিজেপি এবং চেয়ারম্যানের পদটিও বিরোধীদের হাতে নয়, শাসকদলের হাতে রয়েছে। সুতরাং স্বভাবতই এই রিপোর্ট যদি শাসকদলের সম্পূর্ণ অনিচ্ছায় বিরোধী দলের চাপে পড়ে তৈরি করা হয়, তবে সে ক্ষেত্রে সংসদীয় কমিটির চেয়ারম্যানের কিন্তু ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দেওয়ার অধিকার থাকে। আর চেয়ারম্যান হিসেবে সেই কমিটিকে চূড়ান্ত করতে নানাভাবে বাধাপ্রাপ্ত হয়। ভারতের বিভিন্ন বিষয়ে তার অনেক দৃষ্টান্ত রয়েছে।
এই সংসদীয় স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্য কারা এখানে বিভিন্ন দলের সদস্য আছেন। আরো তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা হচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেসের সর্বদলীয় সাধারণ সম্পাদক মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাইপো এবং তৃণমূলের ‘নাম্বার টু’ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় এই কমিটির সদস্য। কংগ্রেস এবং বিজেপি ছাড়াও অন্য দলেরও বেশ কিছু সদস্য এই কমিটিতে রয়েছেন।
কয়েক দিন আগে এই কমিটির বৈঠক হয়ে গেল। এই কমিটি সরকারের কাছে সুপারিশ করেছে, যাতে অবিলম্বে তিস্তার মতো চুক্তি, যেটা নানা কারণে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর একটা বিরোধ ও অচলাবস্থার জন্য ভারতের অভ্যন্তরীণ সমস্যায়, যেটা ভারত বাংলাদেশের কাছে চুক্তিবদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও করতে পারেনি, সেটা অবিলম্বে করা হোক। এই রিপোর্ট সংসদের কাছে পৌঁছেছে এবং সরকারের কাছেও এই রিপোর্ট যথেষ্ট চাপ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে।
সংসদের এই যৌথ স্ট্যান্ডিং কমিটি অবশ্য শুধু তিস্তা নয়, আর একটা বিষয় নিয়েও খুব বিশেষভাবে নজর দিয়েছে। সেটা হলো মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের যে বিষয় এবং যে সমস্যাগুলো উদ্ভূত হয়েছে, তাতে আমাদের এই উপমহাদেশে যে সংকট সৃষ্টি হচ্ছে সে ব্যাপারেও মিয়ানমার সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করা উচিত, সেই বিষয়টিও যথেষ্ট গুরুত্ব পেয়েছে এই স্ট্যান্ডিং কমিটির সুপারিশে।
আসলে প্রতিবেশীই প্রথম—এটা হলো ভারতের পররাষ্ট্রনীতির একটি প্রধান অগ্রাধিকার। সেটা মাথায় রেখে এই পররাষ্ট্রনীতিকে কার্যকর করার জন্য সুপারিশগুলো করা প্রয়োজন বলে কমিটির সব সদস্য একমত হয়েছেন।
এখন কথা হলো, যেখানে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে এই কমিটিতে আছেন এবং কোনো ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দেওয়া তো দূরের কথা, তিনিও মনে করেন এই বিষয়ে একটা নিষ্পত্তি হওয়ার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। কেননা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ সরকার কখনোই ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্কের অবনতি চায় না। কিন্তু এমনভাবে সেটা করা প্রয়োজন, যাতে পশ্চিমবঙ্গে জল বা পানি নিয়ে কোনো সমস্যা না হয়।
সুতরাং কেন্দ্র ও রাজ্যের মধ্যে একটা আলাপ-আলোচনা হওয়া উচিত বলে মনে করেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়, যে আলোচনা কেন্দ্রের পক্ষ থেকেও বহুদিন ধরে রাজ্য সরকারের সঙ্গে করা হয়নি।
লোকসভা ও রাজ্যসভা পৃথক কক্ষ। এই সংসদীয় স্ট্যান্ডিং কমিটিতে লোকসভা ও রাজ্যসভা—দুই কক্ষেরই সদস্যরা সম্মিলিতভাবে কমিটির পক্ষ থেকে সরকারের কাছে রিপোর্ট দিয়েছেন। কংগ্রেসের পক্ষ থেকে সাবেক কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদাম্বরম এই কমিটিতে আছেন। তিনি একজন সিনিয়র মন্ত্রী—স্বরাষ্ট্র ও অর্থ মন্ত্রণালয়ে তিনি ছিলেন। তিস্তা চুক্তির বিষয়টি যখন ক্যাবিনেট চূড়ান্ত করেছিল, প্রণব মুখোপাধ্যায় সেই ক্যাবিনেটে ছিলেন, তখন চিদাম্বরমও সেই ক্যাবিনেটের সদস্য ছিলেন। তিনিও চেয়েছিলেন, এটাকে বাস্তবে রূপ দিতে। সেই সময় তিনি সেই মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন। তখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরোধিতায় এবং কিছুটা ভারত সরকার ও পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কমিউনিকেশন বিভ্রাটে এটা বাস্তবায়িত হয়নি। এ ছাড়া নানা কারণে এই জটিলতা আরো বেড়েছে বৈ কমেনি। চিদাম্বরম নিজেও চাইছেন, এবার এটা মেটানো হোক।
এ ছাড়া আছেন স্বপন দাশগুপ্ত। তিনি আগে রাজ্যসভার সদস্য ছিলেন। এখন অবশ্য তিনি রাজ্যসভার সদস্য নন। ফলে তিনি এখন আর এ কমিটির সদস্য হতে পারেন না। কিন্তু তিনি যখন রাজ্যসভার সদস্য ছিলেন তখনই তিস্তা নিয়ে আলাপ-আলোচনাটা শুরু হয়েছিল। মধ্যে রিপোর্ট তৈরি হয়। এর ফলে তাঁর সমর্থন এই কমিটি আগেই পেয়েছে।
স্বভাবতই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও এটা চাইছেন। এই কমিটির চেয়ারম্যান প্রেমপ্রকাশ চৌধুরী রাজস্থানের বিশিষ্ট নেতা। রাজস্থানের পালি নামক নির্বাচন কেন্দ্র থেকে জয়ী সংসদ সদস্য। তিনি বিষয়টা বোঝেন।
অনেকে মনে করছেন, স্ট্যান্ডিং কমিটির মাধ্যমে বিষয়টি উত্থাপন করে সরকারের কাছে চাপ সৃষ্টি করার পেছনেও সরকারের একটা রণকৌশল আছে। ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচন এবং বাংলাদেশের নির্বাচনের আগে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে তিস্তাকে বাস্তবায়ন করার ব্যাপারে একটা নতুন উদ্যোগ নেওয়ার সম্ভাবনা বাড়ছে।
এমন একটা সময় বিষয়টি উত্থাপিত হলো, যখন জি২০ সম্মেলন হচ্ছে সেপ্টেম্বর মাসে। সেখানে বাংলাদেশ আমন্ত্রিত সদস্য। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে আসছেন। সেখানে নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে তাঁর একান্তে আলোচনা করার কথাও রয়েছে। সুতরাং আশা করা যাচ্ছে, ভারতের পক্ষ থেকে তিস্তা নিয়ে আবার নতুন করে একটা উদ্যোগ নেওয়া শুরু হতে পারে।
সৌজন্যে: কালের কণ্ঠ
বাংলাদেশ সময়: ১২২২ ঘণ্টা, জুলাই ৩১, ২০২৩
এসআইএস