ঢাকা, শুক্রবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

ব্যাংক ডাকাত মোকাবেলায় প্রটোকল, বাংলাদেশে

অতিথি লেখক, সৈকত রুশদী | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৬৪৪ ঘণ্টা, এপ্রিল ২২, ২০১৫
ব্যাংক ডাকাত মোকাবেলায় প্রটোকল, বাংলাদেশে ছবি: প্রতীকী

ব্যাংক 'ডাকাতি' বাংলাদেশে নতুন নয়। বেপরোয়া ধরণের লোভী অর্বাচীনরা, যারা সাধারণত: শিক্ষা-দীক্ষায় পিছিয়ে পড়া সমাজের অংশ, অস্ত্র ও বোমা নিয়ে প্রকাশ্যে ডাকাতি করে।

কখনও ধরা পড়ে, কখনও পড়ে না। ধরা পড়লে বিচারের নামে মাত্র শাস্তি হয়। আবার হয়ও না।

আর বেপরোয়া ধরণের লোভী বুদ্ধিমানরা, যারা সাধারণত: সবধরণের শিক্ষা-দীক্ষায় এগিয়ে থাকা সমাজের অংশ, উপরমহলের ছত্রছায়ায়  শিল্প ও ব্যবসায় ঋণের নামে গোপনে 'ডাকাতি' করে। তারা কখনই ধরা পড়ে না। ঋণের নামে 'ডাকাতি' করা অর্থের অংক বড় হলে কখনও কখনও জানাজানি হয় বেরসিক গণমাধ্যমের কল্যাণে। জানাজানি হলে তাদের কোন বিচার হয়না। বরং খেলাপী হয়ে যাওয়া ঋণ পরিশোধে তাদের যারপরনাই কষ্টের কথা ভেবে 'ডাকাতি' করা অর্থের উপর বড় অংকের সুদ মওকুফ করা হয়। ঋণ পরিশোধের সময় বাড়িয়ে দেওয়া হয়। নতুন নলকূপে পানি উঠানোর জন্য পানি ঢালার মত করে, ঋণ পরিশোধে সক্ষমতা বাড়াতে তাদেরকে আরও অর্থ ঋণ পাওয়ার ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়।

অর্বাচীন ব্যাংক ডাকাতরা বুদ্ধিমান ব্যাংক 'ডাকাত'দের ঋণের নামে নেওয়া কোটি টাকার সমপরিমান তো দূরের কথা, অর্বাচীনদের লুন্ঠন করা অর্থের পরিমান কখনও বুদ্ধিমান 'ডাকাত'দের লুন্ঠন করা অর্থের উপর মওকুফ করা সুদের অংক অথবা নতুন করে সঞ্জীবনী অর্থের কাছাকাছিও হয়না। তারপরও ঐ অর্বাচীন ব্যাংক ডাকাতদের 'সামান্য' অর্থ লুটের অভিযানে বাধা দিতে গিয়ে ব্যংকের কর্মকর্তা, গ্রাহক ও প্রতিবেশীদের প্রাণহানি এবং আহত
হওয়ার মত ঘটনা ঘটছে।

যেমনটি ঘটেছে মঙ্গলবার (২১ এপ্রিল) বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের আশুলিয়া শাখায়। সেখানে প্রাণ হারিয়েছেন ব্যাংকের  শাখা ব্যবস্থাপক, নিরাপত্তা কর্মী ও গ্রাহকসহ আট ব্যক্তি। এর মধ্যে সন্দেহভাজন একজন অর্বাচীন ডাকাতও রয়েছেন। আহত হয়েছেন আরও ১৬ ব্যক্তি।

ঐ অর্বাচীন ডাকাতদের লুট করা অর্থের পরিমান বাংলাদেশে প্রতিবছর বুদ্ধিমান ডাকাতদের লুট করা হাজার হাজার কোটি টাকার তুলনায় অতি সামান্য। মাত্র সাত লাখ টাকা। তার মধ্যে প্রায় ছয় লাখ টাকাই নাকি ডাকাতি প্রতিরোধকারী জনতা উদ্ধার করতে সমর্থ হয়েছে। কিন্তু বুদ্ধিমান ব্যাংক 'ডাকাত'রা অর্বাচীন ডাকাতদের চেয়ে কয়েকশ' কিংবা হাজার গুণ অর্থ লুটে নিতে পারছে বিনা বাধায়। বুদ্ধিমান  'ডাকাত'দের 'অসামান্য' অর্থ লুটের অভিযানে বাধা দিতে গিয়ে কোন ব্যাংকের কোন কর্মকর্তা, গ্রাহক ও প্রতিবেশী প্রাণ হারিয়েছেন, এমনকী আহত হয়েছেন, এমনটি কস্মিনকালেও শোনা যায়নি।

বুদ্ধিমান 'ডাকাত'দের অবাধ লুটে বাধা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করার দায়ে কোনো কোনো ব্যাংক কর্মকর্তা পদ থেকে বদলী হয়েছেন, পদে অবনমন ঘটেছে, কিংবা চাকুরি থেকে সাময়িক বা স্থায়ীভাবে বরখাস্ত হয়েছেন। মর্মে মর্মে বেদনায় জর্জরিত হয়েছেন আমৃত্যু। কিন্তু বেঘোরে প্রাণ হারানোর মত ঘটনা ঘটেনি।

অবশ্য বর্তমান অর্থ মন্ত্রী আবুল মা'ল আবদুল মুহিত বুদ্ধিমান ডাকাতদের লুট করা হাজার হাজার কোটি টাকার পরিমানকেও অতি নগন্য ও তাৎপর্যহীন বলে অভিহিত করেছেন। ব্যাংক থেকে ঋণের নামে হলমার্ক নামে একটি ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা লুটের পর এই বিষয়ে তাঁর এই মন্তব্য ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে  লিপিবদ্ধ হয়ে আছে।

আজই দৈনিক যুগান্তরে প্রকাশিত এক সংবাদে জানা যায়, বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও সাবেক ব্যাংকার ইব্রাহীম খালেদ বলেছেন বিভিন্ন ব্যাংক থেকে (গত সাত বছরে) লুট হয়ে যাওয়া নয় হাজার কোটি টাকা উদ্ধারের সম্ভাবনা ক্ষীণ। বলাবাহুল্য, এই অর্থের পুরোটাই লুট করেছেন বুদ্ধিমান ডাকাতরা।   অস্ত্র নয়, রাজনৈতিক প্রভাব দেখিয়ে।  

কাগজপত্র সই করে। এই লুট প্রতিরোধ করতে যেয়ে কেউ প্রাণ হারাননি। কেউ আহত হননি।   কোন রক্ত ঝরেনি।

বিষয়টি আমার কাছে ভারসাম্যহীন মনে হয়েছে। ব্যাংক থেকে অল্প অর্থ লুট প্রতিরোধে জীবনহানি, অথচ বিপুল পরিমান অর্থ লুট প্রতিরোধে কেউ শারীরিকভাবে আহতও হচ্ছেনা।

অর্থাৎ ঋণের নামে বেশি পরিমান অর্থ ডাকাতি বা লুট প্রতিরোধে এবং অস্ত্রের মুখে কম পরিমান অর্থ ডাকাতি বা লুট প্রতিরোধে বাংলাদেশে  ব্যাংকিং ব্যবস্থায় প্রচলিত প্রটোকলে বড় ধরনের ফাঁক রয়ে গেছে বলে মনে হচ্ছে। দুই ধরনের ডাকাতি প্রতিরোধে হয় এক অভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করা উচিত। অথবা লুটের ঝুঁকি প্রতিরোধে অর্থের পরিমানের উপর আনুপাতিক হারে প্রতিরোধের মাত্রা নির্ধারণ করে দেওয়া উচিত।

বর্তমান প্রটোকলে কী আছে আমি জানিনা।   তবে দেখে শুনে মনে হচ্ছে, অর্থ লুটের পরিমান যত বেশি হবে, লুট প্রতিরোধে আনুপাতিক হারে তত কম ঝুঁকি নিতে বলা হয়েছে ব্যাংক কর্মকর্তাদের।

তবে প্রটোকলের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত অর্থ লুট প্রতিরোধের চেয়ে ব্যাংকে কর্মরত কর্মকর্তা ও কর্মচারী এবং সেবা গ্রহণকারী গ্রাহক সহ মানুষের জীবন রক্ষাকে অগ্রাধিকার দেওয়া। পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশেই সম্পদের চেয়ে মানুষের জীবন রক্ষাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হয়ে থাকে। সম্ভবত: বাংলাদেশ তার ব্যতিক্রম।

শিল্পোন্নত দেশগুলোতে ব্যাংক ডাকাত অস্ত্র বা সহিংসতার ভয় দেখিয়ে অর্থ চাইলে, তাৎক্ষণিকভাবে যতটুকু সম্ভব নগদ অর্থ দিয়ে ডাকাতকে সন্তুষ্ট রেখে নিজেদের ও গ্রাহকের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার নির্দেশ রয়েছে বলে সংবাদপত্র থেকে জানা যায়।

আমার ব্যক্তিগত পরামর্শ হচ্ছে, অর্বাচীন ও বুদ্ধিমান সব ধরনের ব্যাংক ডাকাতি রোধে প্রটোকল পর্যালোচনা করে ঢেলে সাজানো উচিত। দেশের সকল ব্যাংকের জন্য বাধ্যতামূলকভাবে অনুসরণীয় একটি সমন্বিত

প্রটোকলে ব্যাংক কর্মকর্তা, কর্মচারী, গ্রাহক ও প্রতিবেশী সকল মানুষের জীবন রক্ষাকে সর্বোচ্চ

অগ্রাধিকার দিয়ে নিয়ম কানুন তৈরী এবং তা' বাস্তবায়নের জন্য নিয়মিত প্রশিক্ষণের  ব্যবস্থা  করা  প্রয়োজন।

বুদ্ধিমান 'ডাকাত'দের 'নগন্য' অর্থ লুট প্রতিরোধে ঝুঁকি না নেওয়ার মতোই, অর্বাচীন ডাকাতদের 'সামান্য' অর্থ লুটে ঝুঁকি এড়ানোর ব্যবস্থাকেই বোধ করি গুরুত্ব দেওয়া উচিত। আর ঝুঁকি যদি নিতেই হয়, তাহলে বুদ্ধিমান 'ডাকাত'দের ঋণের নামে বড় অংকের অর্থ লুট বন্ধে অগ্রাধিকার দেওয়াটাই যুক্তিযুক্ত।

সৈকত রুশদী, কানাডায় বসবাসকারী রাজনৈতিক ও গণমাধ্যম ভাষ্যকার, সাংবাদিক, ব্রডকাস্টার, কবি ও লেখক। সাবেক যুগ্ম-সম্পাদক জাতীয় প্রেস ক্লাব, ঢাকা।

বাংলাদেশ সময়: ১৮৪৫ ঘণ্টা, এপ্রিল ২২, ২০১৫
বিএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।