ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

মোদির দেশের মুক্তমত

মোদির বাংলাদেশ সফর: কিছু ভাবনা | পরিচয় পাত্র

মুক্তবিশ্লেষণ/মুক্তমত | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮৪৩ ঘণ্টা, মে ৩০, ২০১৫
মোদির বাংলাদেশ সফর: কিছু ভাবনা | পরিচয় পাত্র

আগামী ৬ জুন বাংলাদেশ সফরে আসছেন প্রতিবেশী ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। দু’দিনের এ সফর দুই বন্ধুদেশের মধ্যকার যোগাযোগ, বাণিজ্যসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সম্পর্ক জোরদারে তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে থাকবে বলে আশা করা হচ্ছে।

সফর নিয়ে কী ভাবছেন মোদির দেশের বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ। বাংলানিউজের বিশেষ আয়োজনে থাকছে তাদের মতামত।  

 ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আসন্ন বাংলাদেশ সফর উপলক্ষে এই মুহূর্তে প্রায় সব বাংলাদেশি গণমাধ্যম বিশেষভাবে উৎসুক। পশ্চিমবঙ্গের গণমাধ্যমেও মোদির সফর ও মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তাকে সঙ্গদানের সিদ্ধান্ত নিয়ে চলছে কথাবার্তা।

মনমোহন সিং প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন তার বাংলাদেশ সফর কার্যত ব্যর্থ হয়। মমতার বাধাদানে তিস্তা ও স্থলসীমান্ত চুক্তি- আটকে যায় দু’টিই। এমনিতে ভারত-বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের রয়েছে প্রচুর আলো-ছায়া। ফারাক্কা, টিপাইমুখ, তিস্তা, প্রস্তাবিত নদী সংযোগ প্রকল্প, বেরুবাড়ী তিনবিঘা করিডোর, বাণিজ্য ঘাটতি, সীমান্ত হত্যা, ভিসার সমস্যা, আমলাতান্ত্রিকতা, সুন্দরবনের রামপালে প্রস্তাবিত তাপবিদ্যুৎ প্রকল্প, ফেনসিডিল স্মাগলিং, স্থল ও সমুদ্র সীমান্তসহ নানা বিষয়ে বাংলাদেশের ক্ষোভ রয়েছে। তেমনি ভারতে অনুপ্রবেশ, জঙ্গি সমস্যা, উত্তর-পূর্বের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মদতদান প্রভৃতি বিষয়ে রয়েছে সরকারি মাথাব্যথা।

বাংলাদেশের নানা অভ্যন্তরীণ বিষয় যেমন- সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে প্রধানত পশ্চিমবঙ্গে কিছু মানুষের রয়েছে ক্ষোভ। বিএনপি-জামায়াত শাসনামলে আসামের আলফাকে দশট্রাক অস্ত্র সরবরাহ থেকে শুরু করে নানা কিছুতে ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্কে একপ্রকার শৈত্য দেখা দেয়। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে অনেক সমস্যার দ্বিপক্ষীয় সমাধান হয়েছে এবং আরও নানা কিছুর সমাধান হওয়ার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে।

বাংলাদেশের মাটি ভারতীয় জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোকে ব্যবহার না করতে দেওয়ার লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নানা ব্যবস্থা অবলম্বন করেছেন। এর বিনিময়ে দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত নানা বিষয় সমাধান করার দায় ভারত সরকারের উপরে ন্যস্ত হয়েছে। অথচ নানা কারণে আজ পর্যন্ত ইন্দিরা-মুজিব চুক্তির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়- স্থলসীমান্ত, আইনে পরিণত হওয়া থেকে আটকে ছিল।

ভারতের জটিল যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা, আঞ্চলিক স্বার্থগোষ্ঠীগুলোর প্রভাব, আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রিতা, সংবিধান সংশোধন প্রক্রিয়ার জটিলতা এবং ১৯৭৫ পরবর্তী বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের নানা উত্থানপতন এজন্য দায়ী। আশার কথা হলো, বর্তমানে দিল্লিতে শাসক ও বিরোধী দু’পক্ষই পূর্ব সীমান্তের দিকে নজর ফিরিয়েছেন। বাংলাদেশের সঙ্গে নানাবিধ সমস্যা জিইয়ে রেখে যে এ অঞ্চলে শান্তি স্থাপন সম্ভব নয় তা স্বীকার করেছেন এবং স্থল সীমান্ত চুক্তি বিলটি আইনসভার উভয় কক্ষেই সর্বসম্মতিক্রমে পাস করা গিয়েছে। বিজেপি যখন আসামের নির্বাচনের জন্য আসামকে এ থেকে বাদ রাখতে চেয়েছিল তখন কংগ্রেস তাদের বাধ্য করেছে গোটা বিলটাই রাজ্যসভায় পেশ করতে। এটি একটি দৃষ্টান্তমূলক কাজ, বিরোধী ও শাসকের কাছ থেকে এটাই প্রত্যাশিত।

নরেন্দ্র মোদি সরকারের এক বছর পেরিয়েছে এবং যেসব অবিশ্বাস্য আজগুবি প্রতিশ্রুতি তিনি দিয়েছিলেন তার অনেক কিছুই কট্টর সমর্থকদের কাছেও কষ্টকল্পনা বলেই এখন মনে হচ্ছে। এটা হওয়ারই ছিল। বিশেষ করে তার লাগাতার বিদেশ সফর সমালোচিত হচ্ছে। এই সফরগুলো থেকে সত্যিই ভারতের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে কিছু লাভ হচ্ছে কিনা, তা নিয়ে নানা তর্ক চলছে সঙ্গতকারণেই। এমতাবস্থায় বাংলাদেশের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশীর সঙ্গে নানা বিরোধ মিটিয়ে নেওয়ার একটা দায় তার রয়েছে। এতে করে নিজের সরকারের কৃতিত্ব সম্পর্কে তিনি দাবি করতে পারবেন। কাজেই এটি সুসময় ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্কের নানা অসমাধিত দিকের সমাধানের পথে এগোনোর। যদিও তিস্তা প্রসঙ্গে মমতা আবার ঝুলি থেকে কল্যাণ রুদ্র কমিটির রিপোর্ট নামক প্রাচীন বেড়ালটিকে বের করে এনেছেন। যেভাবেই হোক মোদি স্থলসীমান্ত চুক্তির ক্ষেত্রে মমতাকে রাজি করিয়েছেন। তিস্তা চুক্তি ক্ষেত্রেও করাতে পারলে ভালো বই খারাপ হবে না।

অন্যদিকে, কংগ্রেস নেতৃত্ব যেরকম দায়িত্বশীল বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করছেন তাও বেশ আশা জাগানিয়া। বোঝা যাচ্ছে, দুই প্রধান জাতীয় দল, বিজেপি ও কংগ্রেস, বাংলাদেশ সম্পর্কে ভাবনাচিন্তা করছেন। এটাই সবচেয়ে ইতিবাচক দিক।

আর পশ্চিমবঙ্গ? পশ্চিমবঙ্গের মানুষের বাংলাদেশ প্রসঙ্গে একই সঙ্গে আকর্ষণ ও বিকর্ষণ রয়েছে। আহমদ ছফা দেখিয়েছিলেন, ১৯৭১ সালে কীভাবে বেঙ্গলি নেশনের ধারণা পশ্চিমের বাঙালিকে সাহায্যে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ করেছিল এবং পরে সেই ইউটোপীয় ধারণা থেকে কীভাবে মোহভঙ্গ হয়েছিল। এখনও পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি, সে তার অরিজিন যে দিকেই হোক না কেন, বাংলাদেশ সম্পর্কে একটা মিশ্র অনুভূতি নিয়ে চলেন। একদিকে নস্টালজিয়া, অন্যদিকে ‘আদার’ সম্পর্কে ইরর‍্যাশনাল ফিয়ার। যেমন লেখক চন্দ্রিল ভট্টাচার্য বলেছেন, ‘দাগড়া ক্ষত শ্বাসের মত ঘটক দিয়ে সাঁতলা/কেহ কাঁদবে দোহাই আলী, কেহ ফাঁদবে আঁতলা’।

সুনীল গাঙ্গুলিরা নীলপদ্ম এনে দিতে চাওয়া নাদের আলিদের সাহায্যে বাংলাদেশ নামক মিথটিকে পশ্চিমের বাঙালি মননে গেড়ে বসিয়ে দিতে বড় ভূমিকা নিয়েছেন। এমনিতেও পশ্চিমবঙ্গের বাঙালির এই মুহূর্তে নস্টালজিয়া ছাড়া গতি নেই, দিল্লির কাছে তার গুরুত্বও খুব বেশি নয়। নস্টালজিয়া সম্পর্কে সন্দেহপ্রবণ আমার মনে হয়, দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের জায়গাটা দিল্লি-ঢাকার হাতেই ছেড়ে দেওয়া ভালো। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ বোঝেন না, বাংলাদেশ শুধুই নীলপদ্ম আর পদ্মার ইলিশের এক কাল্পনিক ভূভাগ নয়, একটি স্বাধীন প্রতিবেশী রাষ্ট্র, অন্য পাঁচটা রাষ্ট্রের মতোই এক রাষ্ট্র যার নানা স্বার্থ রয়েছে, স্বার্থ হেতু নানা পদক্ষেপ রয়েছে এবং থাকাই স্বাভাবিক ও বাঞ্ছনীয়। মোদি ও হাসিনা নিজেদের দলীয়, দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক স্বার্থেই নানা বিষয়ে মীমাংসায় আসতে বাধ্য হবেন। দিল্লি ও ঢাকার রাজনীতিকে এই বাস্তববোধ নিয়ন্ত্রণ করুক। আর বাংলাভাষা, রবি-নজরুলের আলোচনা এবং ইলিশ মাছ পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর বাঁধা বুলি হিসেবে তোলা থাক। এতে দু’দেশেরই ভালো হবে। কূটনীতির পরিসরে আবেগের জন্যে নো এন্ট্রি বোর্ড ঝুলিয়ে দেওয়াই যথাযথ পদক্ষেপ। তারপর বাকি দিন তো আপনার জন্য রইলই। চন্দ্রিলের কবিতার আর একটা লাইন তাই আপনার বাঙালিয়ানার জন্য, ‘নস্টালজিয়া, আয় সখিয়া, জল খেলি নিঃশর্তে’।

পরিচয় পাত্র: পশ্চিমবঙ্গের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী, বর্তমানে মেলবোর্নের মনাশ বিশ্ববিদ্যালয়ে চলচ্চিত্রচর্চার গবেষক।

বাংলাদেশ সময়: ০৮৪২ ঘণ্টা, মে ৩০, ২০১৫
এসএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।