ঢাকা, বুধবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, একজন নিবেদিতপ্রাণ দেশপ্রেমিক

মো.সহীদুর রহমান, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৩৯ ঘণ্টা, নভেম্বর ২, ২০১৫
শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, একজন নিবেদিতপ্রাণ দেশপ্রেমিক শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত

শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ছিলেন যথার্থই একজন নিবেদিত প্রাণ রাজনীতিবিদ ও জনদরদী জনপ্রতিনিধি। দেশের সাথে তার ছিল নাড়ির সম্পর্ক এবং তাঁর দেশপ্রেম ছিল কিংবদন্তিতুল্য।

নিজের জীবনের মায়া তুচ্ছ জ্ঞান করে সন্তান, পরিবার পরিজনের সুখ স্বাচ্ছন্দ্য পাশ কাটিয়ে শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত সত্যিকার অর্থেই ছিলেন মহৎ ভাবনায় খাঁটি দেশপ্রেমিক। তার এই আদর্শ চিরকালই মানুষকে আপ্লুত করে দেশপ্রেমে করবে উজ্জ্বীবিত।

মধ্যযুগের কবি চণ্ডীদাসের ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই’ -এই বাণীর মতো শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ যথার্থই একজন মানুষ ছিলেন। নাম পরিচয়ে তার গায়ে হিন্দুত্বের গন্ধ থাকলেও তিনি সবকিছু ছাড়িয়ে সত্যিকার অর্থে মানুষ হয়ে উঠতে পেরেছিলেন- মহৎ মানবিকতাকে ধ্যান-জ্ঞান করেই। তাই দেখা যায়,  মওলানা আকরাম খাঁ যখন ‘GOD’ এর পরিবর্তে ‘আল্লাহ’ শব্দ প্রতিস্থাপন করতে চাইলেন তখন কংগ্রেস সদস্যরা সাধারণভাবে আপত্তি জানালেও ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত তা করেননি, বরং তিনি বললেন, Let us not quarrel about these expressions. ...We are accustomed to believe that whether you call Him Allah or Ishwar or God , He is the same.

প্রসন্ন এ মানুষটি তাই আমৃত্যু ইস্পাতদৃঢ় ব্যক্তিত্বে ভাষা আন্দোলনের সূচনা থেকে এর পরিণতি মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত তার উপযুক্ত ভুমিকা পালন করতে সমর্থ হয়েছিলেন। নিজের ধর্ম পালনের সঙ্গে তিনি পবিত্র কোরানের সূরা ফাতেহাকে তার পাথেয় বিবেচনা করেছেন।

সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্পেপূর্ণ দ্বিজাতিতত্বের উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রের শাসকগোষ্ঠী ধর্মান্ধতার মোহে শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের ধর্মাচারণের এই মানবিক রূপটি দেখতে পায়নি এবং তাকে মানুষ হিসেবে পর্যন্ত চিন্তা করতে পারেনি। পাকিস্তানি শাসকদল তাকে দেখেছে- একজন হিন্দু  হিসেবে- এর বেশি নয়। ওই সময়ের তথাকথিত পাকিস্তানি সেন্টিমেন্ট ছিল- ‘হিন্দু মানেই পাকিস্তান শত্রু’। অবশ্য শাসকগোষ্ঠীর এই সংকীর্ণতা ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে স্পর্শ করতে পারেনি। যদিও ধীরেন্দ্রনাথ দত্তসহ বাংলাদেশের জনগণকে এজন্য চরম মূল্য দিতে হয়েছে। ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত সেই মূল্য দিয়েছেন তার ছোট ছেলেসহ নিজে শহীদ হয়ে। সত্যানুসন্ধানী এই মানুষটি কিন্তু আগেই জেনেছিলেন তার এমন করুণ পরিণতির কথা। তবু তিনি মৃত্যুভয়ে ভীত ছিলেন না। আর এমন পরিস্থিতি আঁচ করতে পেরেই তিনি তার ছোট মেয়েকে বলেছিলেন, হয়তো দেখবি আমাকে গুলি করে মেরে রাস্তায় ফেলে রেখেছে, শকুন হয়তো খাবে। একটা সান্তনা আমার থাকে যে, একটা প্রাণী আমাকে খেয়ে বাঁচবে।

আত্মিকভাবে ঋদ্ধ এই বড়মাপের মানুষটির নিজের সম্পর্কে করা তাঁর ভবিষ্যৎবাণী সত্যে পরিণত হয়েছিল।

এখানেই তাঁর গভীর জীবন-দর্শন ও দেশপ্রেম একীভূত হয়েছিল। জেনে শুনে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছেন, তবু সত্য ছাড়েননি।

ভারত-সীমান্তের অত্যন্ত নিকটে অবস্থান করে এবং শুভানুধ্যায়ীদের সাহায্যে খুব সহজে নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়া ও থাকার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও সব বিপদ ও বৈরিতার মধ্যো তিনি স্বদেশে থাকার এবং যে কোন নিষ্ঠুর পরিণতির জন্য প্রস্তুত ছিলেন।

প্রকৃত অর্থে তিনি নিজে যা বুঝেছেন তাই করেছেন, কখনো ন্যায়ের সঙ্গে অন্যায়ের, সত্যের সঙ্গে মিথ্যার আপোষ করেননি। সত্যকে মূল ভিত্তি ধরে দেশপ্রেমকে সবার উর্ধ্বে স্থান দিয়েছেন। এখানেই শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের সঙ্গে মহান গ্রীক দার্শনিক সক্রেটিসের সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়‍া যায়। সত্য ও ন্যায়ের প্রতীক হয়ে দার্শনিক সক্রেটিসও নিজ হাতে হেমলক পান করেছেন। মৃত্যুকে বরণ করেছেন, তবু মিথ্যার কাছে, মৃত্যুর কাছে পরাস্ত হননি।

শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত আজ নেই। কিন্তু তার আদর্শ, চিন্তা-ভাবনা এ দেশের মাটি ও মানুষের মন থেকে এখনা নি:শেষ হয়ে যায়নি। জনপ্রতিনিধি ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের এদেশের মাটি ও মানুষের প্রতি একটা দায়বোধ ছিল বলেই নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও দেশ ত্যাগ করেননি। দেশের ও দেশের মানুষের ভালবাসার ঋণ শোধ করেছেন। এ যেন প্রখ্যাত নাট্যকার মুনীর চৌধুরীর ‘রক্তাক্ত প্রান্তর’ নাটকের নায়ক চরিত্র ইব্রাহিম কার্দির মৃত্যুর মধ্য দিয়ে অনিবার্য দায় শোধ করে সংশপ্তক হয়ে উঠার মহৎ ট্র্যাজেডি।

শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ ‘Be honest yourself’ ছিলেন। মেধা- মননে তার এই দায়বোধ মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে আরো পরিপূর্ণতা পেয়েছিল। কেননা, তিনি উপলব্ধি করেছিলেন তিনি যে মানুষের জনপ্রতিনিধি, সেই মানুষকে পাকিবাহিনীর বর্বরতার মধ্যে ফেলে চলে যাওয়া হবে আত্মপ্রবঞ্চনার শামিল। কিন্তু তিনি কোন প্রবঞ্চক নন, তিনি জনদরদি জনপ্রতিনিধি ও নিবেদিতপ্রাণ দেশ প্রেমিক। আর এখানেই শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত আমাদের রাজনৈতিক নেতাদের কাছে হয়ে উঠতে পারেন, স্বর্ণালী রক্তিম সকালের মতো প্রেরণার উৎস। বর্তমান বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের জন্য এখানে অবশ্য শিক্ষণীয় রয়েছে এবং দেশের মানুষের জন্য শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের এই আত্মোৎসর্গের উপলব্ধিগত চেতনা তাদের জন্যে এখন খুবই জরুরি। কেননা, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে আজ শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের মতো নিবেদিতপ্রাণ, জনদরদী -দেশপ্রেমিক রাজনীতিবিদের অভাব বড্ড বেশি। তাই আজ রাজনীতিবিদ, শিক্ষক- ছাত্র, কর্মকর্তা -কর্মচারী, বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবী, দলমত নির্বিশেষে সকলের কাছে দেশ চায় সৎ, ন্যায়বোধ ও কর্তব্যনিষ্ঠা সম্পন্ন পরিপূর্ণ মানুষ। আর এই কীর্তিমান মানুষের বাগান এদেশে প্রতিষ্ঠা করতে পারলে আমাদের অনেক দূর এগিয়ে যাওয়া  সময়ের ব্যাপার মাত্র। মহান ভাষা আন্দোলনের চেতনাকে ধারণ করে মুক্তিযুদ্ধের গৌরবোজ্জ্বল আত্মত্যাগের অর্জনে বলীয়ান এই শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তরাই আজো আমাদের পথচলার প্রেরণা, জীবন প্রবাহে নতুন নতুন প্রাণ সঞ্চারের কেন্দ্রবিন্দু।

ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ১৮৮৬ সালের ২ নভেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার রামরাইল গ্রামে (তৎকালিন বাংলা প্রদেশের ত্রিপুরা জেলায়) জন্মগ্রহণ করেন। তিনি একজন বাঙালি আইনজীবী, সমাজকর্মী, ভাষা সৈনিক ও রাজনীতিবিদ। তিনি করেছেন নবীনগর হাই স্কুল, কুমিল্লা কলেজ, এবং কলকাতার সুরেন্দ্রনাথ কলেজে।

১৯৭১ সালের ২৯ মার্চ রাতে কুমিল্লার কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী অ্যাডভোকেট আবদুল করিমের তত্ত্বাবধানে ছোট ছেলে দিলীপকুমার দত্তসহ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে গ্রেফতার করা হয় এবং তাদেরকে ময়নামতি সেনানিবাসে নিয়ে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়।

মো.সহীদুর রহমান, সহকারি অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, আঠারবাড়ি ডিগ্রী কলেজ, আঠারবাড়ি, ঈশ্বরগঞ্জ, ময়মনসিংহ।

বাংলাদেশ সময়: ১৩৩৮ ঘণ্টা, নভেম্বর ২, ২০১৫
জেডএম/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।