নেত্রকোনা : নেত্রকোনা জেলার সুসঙ্গ দুর্গাপুরের কৃতি সন্তান ছিলেন শহীদ বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক আরজ আলী। তিনি মহান মুক্তিযুদ্ধের অগ্নিঝরা দিনগুলোতে বর্তমান নেত্রকোনা সরকারি মহাবিদ্যালয়ের দর্শন শাস্ত্রের অধ্যাপক ছিলেন।
শিক্ষক হিসেবে প্রভূত জনপ্রিয়তা অর্জনকারী এ অধ্যাপককে মুক্তিযুদ্ধে সাংগঠনিক কাজ ও মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা দানের অভিযোগে বর্বর পাকিবাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসররা ১৯৭১ সালের ১২ আগস্ট নেত্রকোনা মহাবিদ্যালয় থেকে গ্রেফতার করে। দু’দিন পর তাকে তার নিজ এলাকা বিরিশিরির সেনা ঘাঁটিতে স্থানান্তরিত করা হয়। বন্দি অবস্থায় পাকিস্তানের প্রতি বশ্যতা স্বীকারের জন্য তার ওপর চালানো হয় অকথ্য নির্যাতন। কিন্তু সব চেষ্টা ব্যর্থ হলে ১৬ আগস্ট তাকে সোমেশ্বরী নদীর তীরে গুলি করে হত্যা করা হয়।
উল্লেখ্য, স্বাধীনতা যুদ্ধের সেই দিনগুলোতে অধ্যাপক আরজ আলী তার সদ্য প্রসূত ভ্রাতুষ্পুত্রের নাম রেখেছিলেন ‘মুজিব’ এবং প্রতিবেশী বন্ধুকণ্যার নাম রেখেছিলেন ‘রাষ্ট্রন্নেসা’। নেত্রকোনা জেলার বহু মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন তার প্রত্যক্ষ ছাত্র। স্বাধীনতা অর্জিত হওয়ার পর ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত গেজেটে তিনি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত।
বাংলা একাডেমী কর্তৃক প্রকাশিত শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ গ্রন্থ “স্মৃতি ৭১” – দ্বিতীয় খণ্ডে তার আত্মত্যাগের কাহিনী বর্ণিত রয়েছে। বাংলাদেশ ডাক বিভাগ কর্তৃক ১৯৯৪ সালে প্রকাশিত হয় তার ছবি সম্বলিত স্মারক ডাক টিকিট।
ট্রান্সক্রিপশন্স সার্ভিস বাংলাদেশ বেতার কর্তৃক, ২০০১ সালের ১৬ই ফেব্রুয়ারি তার আত্মত্যাগের কাহিনীর উপর ভিত্তি করে সুসঙ্গ মহাবিদ্যালয় মাঠে মঞ্চস্থ হয় নাটক ‘বিজয়গাথা আরজ আলী, সব বাউলের একতারাতে’।
তার স্মৃতিতে রচিত গান ‘কই গেলা ভাই আরজ আলী, তোমার জন্য কাঁদিতেছে শত শত বাঙালি’-গানটি এখনো স্বাধীনতা যুদ্ধের স্মৃতি বহন করে চলেছে।
জাতীয় পর্যায়ে সরকার কর্তৃক যথেষ্ট মূল্যায়িত ও জনমহলে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পাওয়া সত্বেও, তার নিজ এলাকা দুর্গাপুর এবং শিক্ষা ও কর্মস্থল সরকারি নেত্রকোনা মহাবিদ্যালয়ে অদ্যাবধি প্রযোজ্য কোনো স্থাপনা তার নামে নামকরণ করা হয়নি। যদিও বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক বিশিষ্ট শহীদদের নামে স্ব স্ব এলাকায় ও কর্মস্থলে স্থাপনার নামকরণের সিদ্ধান্ত ও নির্দেশনা রয়েছে।
১৯৭২ সালে তার কর্মস্থল নেত্রকোনা মহাবিদ্যালয়ে তার স্মরণে আয়োজিত প্রথম শোকসভায় কলেজে তার নামকরণে লাইব্রেরি স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
অপরদিকে দুর্গাপুরে সুসঙ্গ মহাবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় তার অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৭৩ সালে মহাবিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও স্থানীয় সূধী সমাজ কলেজের সামনের সড়কটি তার নামে নামকরণ করে।
তবে ১৯৭৫ সালে জাতিরজনক বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কে বা কারা তার নামফলকটি সরিয়ে ফেললে অদ্যাবধি তা আর প্রতিস্থাপিত হয়নি।
এদিকে সুসঙ্গ মহাবিদ্যালয়ের সামনের সড়কটির নামফলক প্রতিস্থাপনের জন্য এবং স্বাধীনতার ৪৫ বছরেও তার নামে কোনো স্থাপনার নামকরণ না হওয়ায় ২০১৪ সালের ৭ সেপ্টেম্বর এলাকাবাসী স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের স্বাক্ষরিত একটি স্মারকলিপি স্থানীয় সংসদ সদস্য ছবি বিশ্বাসের (শহীদ অধ্যাপক আরজ আলীর ছাত্র) কাছে পেশ করেন।
ছবি বিশ্বাস এ বিষয়ে গুরুত্ব সহকারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
এমতাবস্থায়, দুর্গাপুরে এবং সরকারি নেত্রকোনা মহাবিদ্যালয়ে শহীদ অধ্যাপক আরজ আলীর নামে প্রযোজ্য স্থাপনার নামকরণের জন্য শহীদ পরিবার ও এলাকাবাসী মহান বিজয় দিবসকে সামনে রেখে সংসদ সদস্য ছবি বিশ্বাস ও সরকারি নেত্রকোনা মহাবিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এবং সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।
লেখক: মো. রফিকুল ইসলাম (শহীদ অধ্যাপক আরজ আলীর ভ্রাতুষ্পুত্র), সহকারী অধ্যাপক, অর্থনীতি, সুসঙ্গ মহাবিদ্যালয়, দুর্গাপুর
বাংলাদেশ সময়: ১৭৪২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৪, ২০১৫
আরএ