ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

বদলে যেতে পারে আমার স্থায়ী ঠিকানার সড়কের নাম

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪০০ ঘণ্টা, জুলাই ২৪, ২০১৭
বদলে যেতে পারে আমার স্থায়ী ঠিকানার সড়কের নাম প্রফেসর আবদুল জলিল

প্রফেসর আবদুল জলিল। আমার নানা। নোয়াখালী সরকারি কলেজে দাপুটের সাথে তিনি সুদীর্ঘ ১২ বছর প্রিন্সিপাল ছিলেন। আর কোনো প্রিন্সিপালের পক্ষে এতো সম্মান নিয়ে দায়িত্ব পালন করা হয়নি। শিক্ষাঙ্গনে এটি ছিলো বিরল। 

১৯৬১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করে যোগদান করেন বহুদূরের উপকূলীয় অঞ্চল নোয়াখালী সরকারি কলেজে। জীবনের বেশিরভাগ সময় তিনি এই কলেজের পেছনে ব্যয় করেছেন।

কলেজটি ছিলো পুরাতন ক্যাম্পাসে, টিনশেডে ঘেরা। ওখান থেকে নতুন ক্যাম্পাসে স্থানান্তর করার ব্যাপারে তাকে অক্লান্ত পরিশ্রম করতে হয়েছে। স্থানান্তরের সময় তার নামে জেলার বিভিন্ন স্থানে চিকা মারা হয়েছিল, ‘জলিল তুই কবে যাবি?’ তাকে প্রথম ও প্রধান আসামি করে মামলা করা হয়েছে। তিনি দমে যাননি। ব্যাপারটি তিনি চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেন। কলেজ থেকে বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে রূপান্তর, বিভিন্ন বিষয়ে সম্মান ও সম্মানত্তোর কোর্স চালুকরণ, কলেজ স্থানান্তর, বিশাল বিশাল ভবন নির্মাণÑ এসব ক্ষেত্রে তার অবদানের কথা নোয়াখালীবাসী জানেন এবং স্বীকার করেন। নোয়াখালীর মতো অবহেলিত একটি জেলার দরিদ্র-নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর সন্তানরা বাড়িতে বসে পান্তাভাত খেয়ে অনার্স ও মাস্টার্স ডিগ্রি লাভ করবে এটা ছিলো কল্পনার অতীত। যার অনুমোদনের জন্য তিনি সপ্তাহে পাঁচদিন পর্যন্ত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিদিন যাতায়াত করতেন। যা আজও একজন প্রিন্সিপালের পক্ষে ভাবা যায় না। শুরুতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন দিতে চায়নি। তিনি অনুমোদন ব্যতিরেকেই ব্যবস্থাপনা, গণিতসহ অর্থনীতিতে মাস্টার্স কোর্স চালু করেন।  

তিনি বলতেন, সততা থাকলে ঠেলে খেললে ফাউল নেই। এটা হচ্ছে তার খেলোয়াড়ী মনোভাব। ওই যে তিনি একসময় খেলোয়াড় ছিলেন। পরবর্তীতে তার দৃঢ়তা ও ব্যক্তিত্বের কারণে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অনুমোদন দিতে বাধ্য হয়।

আমার প্রিয় সম্মানিত নোয়াখালীবাসী তার নামে নোয়াখালী সরকারি কলেজে একটি অডিটরিয়ামের নামকরণ করে তাকে সম্মানিত করেছেন, আরও অনেক দিন আগে, সেই অডিটরিয়াম উদ্বোধন করতে গিয়ে ২০০৩ সালের ১৩ অক্টোবর তৎকালীন আইন-বিচার ও সংসদ মন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ বলেন, বৃহত্তর নোয়াখালীর স্বনামধন্য, আমার প্রিয় শিক্ষাবিদ প্রফেসর আবদুল জলিলের নামে অডিটোরিয়াম উদ্বোধন করতে পেরে আমি গর্বিত। এছাড়া অ্যাডভোকেট শামসুল ফারুক সম্পাদিত সাপ্তাহিক সমকাল বার্তা প্রথম তার সম্মানে স্মারক সংখ্যা প্রকাশ করে।  

সম্প্রতি আমাদেরকে নোয়াখালীবাসী আরেকবার কৃতজ্ঞতায় ঋণী করেছেন। জেলা শহর মাইজদী মাস্টার পাড়ার একতা ক্রীড়া সংসদ নামে একটি ক্রীড়া সংগঠন প্রফেসর আবদুল জলিলের স্মৃতির প্রতি সম্মান জানিয়েছেন। কমিউনিটি পুলিশিং কার্যক্রমে প্রায় পাঁচ বছরে ‘একতা’ সারাদেশে একটি আদর্শ দৃষ্টান্ত স্থাপন করে যাচ্ছে। যারা খেলাধুলা-সাংস্কৃতিকসহ নানামাত্রিক সৃজনশীল কার্যক্রমে ধারাবাহিকতা রেখেছে। এই একতা কমিউনিটি পুলিশিং ও সামাজিক উন্নয়ন সংগঠনে এলাকার সুশীল ব্যক্তিরা সম্পৃক্ত রয়েছেন, যারা সমাজে ক্রমবিকাশ গুণগতমানের পরিবর্তনে বিশাল ভূমিকা রাখছেন। তারা আন্তরিকতা ও পরিশ্রমের সঙ্গে প্রায় পক্ষকাল ধরে এ বছর তার স্মরণে একটি দাবা টুর্নামেন্ট আয়োজন করেছেন। ২০ জুলাই টুর্নামেন্টের সমাপনী ও পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানে নোয়াখালীর পৌরসভার সম্মানিত মেয়র, প্রফেসর আবদুল জলিলের সুযোগ্য ছাত্র শহিদ উল্যাহ খাঁন সোহেল প্রধান অতিথি, বিশেষ অতিথি হিসেবে আমার শ্রদ্ধাভাজন স্যার সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজের উপাধ্যক্ষ প্রফেসর প্রসুন মজুমদার, একতা কমিউনিটি পুলিশিং ও সামাজিক উন্নয়ন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট গোলাম আকবর এবং লেখক-কলামিস্ট হাবীব ইমন। এর আগে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে নোয়াখালী জেলা ক্রীড়া সংস্থার সম্মানিত সাধারণ সম্পাদক আবদুল ওয়াদুদ পিন্টু বলেছেন, জেলা পর্যায়ে তার নামে দাবা টুর্নামেন্ট করা হবে। এটা আমাদের জন্য ভীষণ সম্মানের।  

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ধীরাজ কুমার নাথ তার পাঠানো শুভেচ্ছা বার্তায় বলেছেন, অধ্যক্ষ আবদুল জলিল আজও তার এক অনন্য উদাহরণ। সব প্রকার বিভাজন, হিংসা ও বিদ্বেষ এবং দলাদলির ঊর্ধ্বে উঠে তিনি নোয়াখালী কলেজে এক আর্দশ স্থাপন করেছেন, যা স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অনন্য দৃষ্টান্ত হিসাবে চিরকাল প্রোজ্জ্বল হয়ে থাকবে। তার জীবনের শুরু থেকে এই খেলাধুলায় পূর্ণ করে আছে। খেলোয়াড়ী মনোবাসনা তিনি অব্যাহত রেখেছেন। এবং জয়ী হয়ে উঠেছেন।  

সেই অনুষ্ঠানে বক্তারা শিক্ষা, ক্রীড়াসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রফেসর জলিলের অবদান স্মরণ করেন। তারা মাস্টার পাড়া-নতুন কলেজ রোডের নাম ‘প্রফেসর আবদুল জলিল সড়ক' রাখার দাবি উত্থাপন করেন। তার পরিবারের সদস্য হিসেবে কৃতজ্ঞতা জানাই। সম্মানিত মেয়র অত্যন্ত বিনয়ী এবং সজ্জন মানুষ। কৃতীমান ব্যক্তিকে সম্মান জানাতে দ্বিধা করেন না। ছাত্ররাজনীতি থেকে তার গুণ অব্যাহত রেখেছেন। তার স্যারের প্রতি তিনি অকুণ্ঠ সম্মান ও শ্রদ্ধা রেখে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বলেছেন, প্রফেসর জলিল স্যারের ছাত্র হিসেবে তিনি এই রাস্তার নাম ‘প্রফেসর আবদুল জলিল সড়ক’ করতে পারলে গর্বিত বোধ করবো। এ কাজটি করতে পারলে একজন ছাত্র হিসেবে এটা আমার সার্থকতা। শীঘ্রই পৌর পরিষদের মাসিক সভায় প্রস্তাবটি অনুমোদন করা হবে বলে আশ্বস্ত করেছেন তিনি।

ব্যাপারটি যদি সত্যিই ঘটে তাহলে বদলে যাবে আমার স্থায়ী ঠিকানা নতুন সড়ক নামকরণে, মাস্টার পাড়া-নতুন কলেজ রোডের জায়গায় জ্বলজ্বল করবে ‘প্রফেসর আবদুল জলিল সড়ক’।

সড়ক ও সেতু মন্ত্রী এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের নভেম্বর ২০১৩ সালে প্রকাশিত অধ্যক্ষ আবদুল জলিল: স্মৃতিজল সুধায় আজন্ম স্মারকগ্রন্থে লিখেছেনÑ ‘এই বহুমাত্রিক সৎ, নিভৃতচারী মানুষটি সারাজীবন নিভৃতেই রয়ে গেলেন। শুধু তাঁর চোখে ছিল একটি স্বপ্ন। তাঁর প্রিয় নোয়াখালীর ছেলে-মেয়ে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে দেশ গড়ায় বিশেষ অবদান রাখবে। তাঁরই একক প্রচেষ্টায় নোয়াখালী কলেজকে টিনের ঘর থেকে সুরম্য অট্টালিকায় স্থানান্তর করেন, নোয়াখালী কলেজকে রূপান্তর করেন নোয়াখালী বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে। চেয়েছিলেন এ কলেজটিকে বিশ্ববিদ্যালয় করতে। তাঁর অনেক ছাত্র, বন্ধু, সহকর্মী, আত্মীয়Ñস্বজন সরকারের উচ্চ পর্যায়ে আসীন ছিলেন। কিন্তু তিনি কখনও নিজের জন্য কোন ধরনের সাহায্য গ্রহণ করেননি’। তার ওই লেখায় তিনি আরও লিখেছেনÑ‘জলিল স্যার আমাকে অত্যধিক আদর করতেন, স্নেহ করতেন। তখন থেকেই জলিল স্যারের সাথে আমার পরিচয়। অত্যন্ত মেধাবী ও প্রখর ব্যক্তিত্বস¤পন্ন ছিলেন। বিভিন্ন কারণেÑঅকারণে স্যারের সান্নিধ্য পেয়েছি। তিনি ছিলেন সংবেদনশীল ব্যক্তিত্ব। ভালো শিক্ষক ছিলেন। সৎ ও নির্ভীক ছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে তিনি খুব শ্রদ্ধা করতেন। মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে তিনি ছিলেন এক নীরব যোদ্ধা। ৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের সময় জলিল স্যার সরকারি চাকুরির কারণে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ না করলেও বিভিন্নভাবে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের তিনি অনেক সাহায্য-সহযোগিতা করেছিলেন। স্থানীয় বুদ্ধিজীবী ও শিক্ষক হত্যা তালিকায় স্যারের নাম ছিলো’। প্রয়াত স্বনামধন্য নাট্যকার ও লেখক প্রণব ভট্ট ওই গ্রন্থে মুক্তিযুদ্ধকালে তার ছোট ভাই সমীর ভট্টকে ছাড়িয়ে আনার জন্য প্রফেসর জলিলের প্রয়াসকে স্মরণ করতে গিয়ে লিখেছেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেলো। আমি যুদ্ধে গে’লাম। যুদ্ধে শেষে নোয়াখালীর মাইজদী বাজারে এসেই জলিল স্যারের বাসায় গেলাম। স্যারের পা ছুঁয়ে প্রণাম করলাম প্রথমে। অন্যরকম এক অনুভূতি ছিলো সেদিন। জলিল স্যার যদি এ উদ্যোগ না নিতেন তবে আমরা হয়তো হারাতাম আমাদের ছোট ভাই সমীরকে। একাত্তরের এ স্মৃতি আমাকে জানিয়ে দেয় সবসময়’। এছাড়া মহান ভাষা আন্দোলনে তার অংশগ্রহণ রয়েছে।

নোয়াখালীবাসী আমাদের জন্য সবসময় করেছেন, তারা আমাদের সম্মানিত করেছেন। আমরা যেনো সেই সম্মান রাখা, তার আদর্শকে সামনে রেখে নোয়াখালীর জনগণের জন্য কিছু করার সমর্থ রাখতে পারি সেই প্রার্থনা সবার কাছে রইল।

আশিক রহমান
চিকিৎসক ও লেখক

বাংলাদেশ সময়: ১৯৫৭ ঘণ্টা, জুলাই ২৪, ২০১৭
এসএনএস
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।