ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

আবদুল হামিদ এক কিংবদন্তি

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭৫৩ ঘণ্টা, আগস্ট ৩, ২০১৭
আবদুল হামিদ এক কিংবদন্তি

ঢাকা: বাংলাদেশে বাংলা ক্রীড়া ধারা বর্ণনার জনক ও অগ্রপথিক হিসেবে আবদুল হামিদ আমাদের সবার স্মৃতিতেই চির জাগরুক। তিনি তাঁর জীবদ্দশায় ক্রীড়া সংশ্লিষ্ট সব মাধ্যমেই সাফল্যের সাথে পথ চলেছেন। তিনি ছিলেন জাতীয় ক্রীড়াবিদ, ক্রীড়া সংগঠক, ক্রীড়া লেখক/সাংবাদিক ও ক্রীড়া ভাষ্যকার।

তিনি সেই বিরল কৃতিত্বের অধিকারী যিনি এদেশের ক্রীড়াঙ্গনকে বহুমাত্রিক দৃষ্টিতে দেখার সুযোগ পেয়েছিলেন। এজাতীয় অভিজ্ঞতা অর্জন খুব কম মানুষের পক্ষেই সম্ভব হয়েছে।

মাঠের খেলা ও মাঠের বাইরের খেলায় যারা সুন্দর সমন্বয় ঘটাতে পারেন তাঁরাই পান অধরা সাফল্য। এরই ধারাবাহিকতায় আমাদের গুরু হামিদ ভাই, ‘ক্রীড়াঙ্গনের হামিদ ভাই’ হয়ে এক বিশাল সাফল্য অর্জন করেছিলেন যা সত্যিই অতুলনীয়। ক্রীড়াঙ্গনের হামিদ ভাইয়ের অবাধ বিচরণ ছিল সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও। তিনি একাধারে ছিলেন সংবাদপাঠক, নাট্যশিল্পী ও উপস্থাপক। এসব সংশ্লিষ্টতা তাঁর ক্যারিয়ারে বহুমাত্রিকতার পরিস্ফুটন ঘটিয়ে এনে দিয়েছিল এক অনন্য সাধারণ সাফল্য।

সদা হাস্যোজ্জ্বল, বন্ধুবৎসল ও অজাতশত্রু হামিদ ভাই ১৯৩৫ সালের ২১ সেপ্টেম্বর ভারতের নদীয়া জেলার নবদ্বীপে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন আবদুর রব ও বেলেজান বিবি দম্পতির ৫ম সন্তান। প্রাতিষ্ঠানিক উচ্চশিক্ষা ছিল না ঠিকই, কিন্তু স্বল্প শিক্ষা, লব্ধ অভিজ্ঞতা ও ব্যবহারিক শিক্ষাকে সম্বল করে তিনি যে সাফল্য ও খ্যাতি অর্জন করেছিলেন তা সত্যিই ঈর্ষনীয়। ভাল কাজের স্বীকৃতি হিসেবে ১৯৭৯ সালে জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার এবং ২০০৩ সালে পেয়েছেন একুশে পদক।

বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের এই উত্তম পুরুষ ২০১২ সালের ৪ আগস্ট আমাদের সবাইকে কাঁদিয়ে চলে গেছেন না-ফেরার-দেশে। নিশ্চিতভাবেই তিনি আর আমাদের মাঝে ফিরবেন না; কিন্তু তাঁর সরব উপস্থিতি আমরা সবসময়ই টের পাই এবং পেতেই থাকবো। ইথারে ভেসে আসা সেই পরিচিত কন্ঠস্বর: “ শ্রোতা ভাই-বোনেরা আস-সালামুআলাইকুম! ঢাকার বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম থেকে আবদুল হামিদ আপনাদের সবাইকে স্বাগত জানাচ্ছি। ’’ আজও সেই সুমধুর শব্দগুচ্ছ আমাদের অনুরণিত করে। অধুনা তাঁর মতো করে অনেক তরুণ ক্রীড়া ভাষ্যকারও দর্শক-শ্রোতাদের বিভিন্ন মাঠ থেকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন এবং জানাবেন- এটা একটা চলমান প্রক্রিয়া, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে এভাবেই চলে আসছে, চলবে। বাংলাদেশে বাংলা ক্রীড়া-ধারাভাষ্য যেটি হামিদ ভাই শুরু করে দিয়েছিলেন, সেটা আজও স্ব-রবে চলছে এবং চলবে অনন্তকাল।

আবদুল হামিদের মতো সব্যসাচী গুণীজনকে নিয়ে অনেক মানুষ ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে স্মৃতিচারণ করেছেন এবং করবেন। কিন্তু আমি তাঁকে দেখেছি একজন নবীন ক্রীড়াভাষ্যকার হিসেবে, তাঁর জীবনের শেষ পাঁচটি বছর। ঢাকার বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে ২০০৭ সালের কোনো এক বিকেলে ফেডারেশন কাপ ফুটবলের সেমিফাইনাল ম্যাচের ধারাবর্ণনা করতে গিয়ে হামিদ ভাইয়ের সাথে আমার প্রথম দেখা। সেদিন বেতারের ধারাভাষ্য প্যানেলে আমার সাথে ছিলেন আবদুল হামিদ, খোদা বক্শ মৃধা এবং মোঃ মুসা। হামিদ ভাইয়ের সাথে আমাকে প্রথম পরিচয় করিয়ে দিলেন আমার সরাসরি গুরু খোদা বক্শ মৃধা। পরিচিত হতেই স্বভাবসুলভ হাসিমুখে বরণ করে নিলেন আমাকে। শুরুতেই আমাকে কিছু সাহস জাগানিয়া কথা শোনালেন, তাতে আত্মবিশ্বাসী হলাম। মানসিকভাবে বেশ উত্তেজিত ছিলাম কারণ জীবনে প্রথমবারের মতো হামিদ ভাইয়ের সাথে ধারাবর্ণনা করবো। এর আগে মনজুর হাসান মিন্টু, খোদা বক্শ মৃধা, মোঃ মুসা এবং আলফাজ উদ্দিন আহমেদের মতো বড় বড় ক্রীড়া ভাষ্যকারের সাথে কাজ করলেও হামিদ ভাইকে সহ-ভাষ্যকার হিসেবে পাচ্ছিলাম না। এনিয়ে আমার মনে একটা বড় রকমের খচখচানি ছিল বৈকি! পড়তি বয়স এবং অসুস্থতার জন্য ঐসময় হামিদ ভাই ধারাভাষ্যে অনিয়মিত ছিলেন। কিন্তু হঠাৎই সেদিন হামিদ ভাইকে সহ-ভাষ্যকার হিসেবে পেয়ে খুব রোমঞ্চিত ছিলাম। চতুর্থ ভাষ্যকার হিসেবে আমার পর্ব এলো। ফুটবল ম্যাচের প্রথমার্ধের ৩৫-৪৫ মিনিট পর্যন্ত ধারাবর্ণনা করলাম। আমার একপাশে হামিদ ভাই আর অন্য পাশে মুসা ভাই। এমন দুজন বর্ষীয়ান ও অভিজ্ঞ ভাষ্যকারের মাঝে আমি এক তরুণ-- একথা মনে পড়তেই খেই হারিয়ে ফেলছিলাম। কিন্তু মহূর্তেই মনোসংযোগ ফিরিয়ে এনে ভালভাবেই আমার পর্বটুকু শেষ করলাম। মাঝের ১৫ মিনিটের বিরতিতে আলোচনা চলবে জানতে পেরে সুযোগটা আমিই নিলাম। সেদিনের ম্যাচ এবং দেশের সামগ্রিক ফুটবল নিয়ে আমরা তিনজন প্রাণবন্ত আলোচনা করলাম। ম্যাচ শেষে হামিদ ভাই পিঠ চাপড়ে দিয়ে বললেন: ছোট ভাই, আপনি সুন্দর বলেন। মনোযোগ দিয়ে কাজ করে যান, দোয়া করি অনেকদুর যেতে পারবেন।

এই হলো হামিদ ভাইয়ের সাথে আমার প্রথম সাক্ষাতের অভিজ্ঞতা। এরপর দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে অনেকবার। কখনো আনুষ্ঠানিক আবার কখনোবা অনানুষ্ঠানিক। কিন্তু হামিদ ভাইয়ের ঐ প্রথম সম্বোধন, ছোট-বড় যার সাথেই দেখা বা কথা হোক, তিনি কাউকে সুযোগ না দিয়ে বলে উঠতেন: ভাই, আসসালামুআলাইকুম। অনেক চেষ্টা করেও হামিদ ভাইকে আগে সালাম দেয়া যেতো না। এই ছিলেন আমাদের হামিদ ভাই! বলতে দ্বিধা নেই আজ আমরা তাঁর আদর্শ ও মূল্যবোধ থেকে অনেক দুরে অবস্থান করছি। ক্রীড়া ভাষ্যকার হিসেবে হামিদ ভাইয়ের রেখে যাওয়া আদর্শ আজকের সকল ভাষ্যকারের জন্যই অনুকরণীয়, অনুসরণীয়। হামিদ ভাই আমাদের মাঝেই বেঁচে থাকবেন। তাঁর দেখানো পথ এবং আদর্শ অনুসরণের মাধ্যমে আমরাই তাঁকে বাঁচিয়ে রাখবো অনন্তকাল। হামিদ ভাইয়ের আত্মার মাগফেরাত কামনায় আমরা সকলেই।

বাংলাদেশ সময়: ১৩৪৯ ঘণ্টা, আগস্ট ০৩, ২০১৭
জেএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।