ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

নারী! কে বাঁচাবে তোমাকে?

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯৩৭ ঘণ্টা, আগস্ট ৪, ২০১৭
নারী! কে বাঁচাবে তোমাকে? প্রতিকী ছবি

ঢাকা: গবেষণা ও মিডিয়া রিপোর্ট জানাচ্ছে, খুন, ধর্ষণসহ বিভিন্ন ধরনের পাশবিক অত্যাচার, নির্যাতন ও সহিংসতা ভয়াবহ আকারে বাড়ছে। ২০১৩ সাল থেকে গত  মে মাস পর্যন্ত ধর্ষিত ও যৌনলাঞ্ছিত শিশুর সংখ্যা ৩ হাজার ৮৪৮ জন! কিশোরী, তরুণী ও পূর্ণ বয়স্ক নারীসহ অপরাধের শিকারের সংখ্যা কয়েক গুণ।

নির্যাতনের ১ লাখ ৫৯ হাজার মামলা বিচারাধীন থাকায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমনে আরো ৪৬টি নতুন ট্রাইব্যুনাল গঠন করতে হচ্ছে। তারপরও প্রতিদিনই নারী ও শিশু নির্যাতনের চাঞ্চল্যকর ও রোমহর্ষক নতুন নতুন ঘটনার খবর আসছে।

নারীর বিরুদ্ধে অপরাধের সংখ্যাগত পরিমাণও দিনে দিনে মহামারীর মতো বাড়ছেই।

এ প্রশ্নের উত্তর জানা আজ জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, প্রতিনিয়ত লাঞ্ছিত ও নিগৃহীত নারীকে কে বাঁচাবে? আইন-শৃঙ্খলা ব্যবস্থা কি নারীকে রক্ষা করতে পারছে? সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ কি এগিয়ে এসেছেন? খোদ নারী সমাজ কি দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার এমন অবস্থায় ঐক্যবদ্ধভাবে রুখে দাঁড়াতে পেরেছেন? কেবলমাত্র একটি কি দু’টি মানববন্ধন, মৃদু প্রতিবাদ ইত্যাদি দিয়ে কি নারী ও শিশু নির্যাতনের তাণ্ডবকে রোধ করা সম্ভব হবে? বিশ্বায়ন, তথ্যপ্রযুক্তি ও সামাজিক যোগাযোগের এই নিবিড় পরিবেশে একতরফাভাবে নির্যাতনের বীভৎস চিত্র দেখে দেখে সহ্য করা ছাড়া কার্যকরী কি পদক্ষেপ নিয়েছেন সমাজের মানুষ ও নারী সদস্যরা? আমরা ধর্ষণ-সহিংসতা, নারী ও শিশু নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধমূলক কি কি কার্যক্রম বাস্তব ক্ষেত্রে নিয়েছি?

বিভিন্ন সংস্থার পরিসংখ্যান মতে, গত ছয় বছরে গড়ে প্রতি বছরে যতোগুলো করে ধর্ষণ ও নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে, এ বছরের (২০১৭) গত ছয় মাসেই সে সংখ্যা ছাড়িয়ে গেছে। নারী ও শিশুর বিরুদ্ধে ধর্ষণ ও সহিংসতা দ্বিগুণ হারে বেড়ে লাগামছাড়া পর্যায়ে পৌঁছেছে।

এসব তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে, এখন ধর্ষণ করেই নিবৃত্ত হচ্ছে না অপরাধীচক্র। ধর্ষিতাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হচ্ছে। গলা টিপে বা ছুরিকাঘাতে মেরে ফেলা হচ্ছে ধর্ষণ-নির্যাতনের শিকার নারী বা শিশুকে।

একের পর একটি চাঞ্চল্যকর, রোমহর্ষক, পাশবিক ও নারকীয় অপরাধ মানবতার অন্তরাত্মাকে পর্যন্ত কাঁপিয়ে দিচ্ছে। মাত্র ৩ বছর ছয় মাস বয়সী শিশু তানহাকে ধর্ষণের পর খুন করেন পাষণ্ড-কুলাঙ্গার শিপন। বগুড়ায় ছাত্রীকে কলেজে ভর্তির নামে ধর্ষণ করেন রাজনৈতিক সন্ত্রাসী তুফান। বিচার চাওয়ায় ওই সন্ত্রাসীর পরিবার ধর্ষিতা ও তার মায়ের মাথা ন্যাড়া করে দেওয়ার মতো বীভৎস অপকর্মও করেন। রাজশাহীতে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রীকে গণধর্ষণ করা হয়েছে। নারায়ণগঞ্জে চলন্ত ট্রাকে কিশোরীকে পালাক্রমে ধর্ষণ করেছেন চালক ও হেলপার।

নারী ও শিশু নির্যাতন-ধর্ষণ এখন সর্বত্রই বেপরোয়াভাবে চলছে। কোথাও কোথাও দলবদ্ধভাবে ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনও করা হয়েছে। গ্রামে-গঞ্জ, স্কুল-কলেজ, মাদ্রাসা, বিশ্ববিদ্যালয়, পথ-ঘাট, পার্ক, শহরের বস্তি ও অভিজাত এলাকা, হোটেল, বসতবাড়ি, কারখানা এমনকি চলন্ত গাড়িতেও নারী ও শিশুরা নিরাপদ থাকতে পারছে না।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় স্বামীকে বেধে রেখে স্ত্রীকে পালাক্রমে গণধর্ষণ করা হয়েছে। ঢাকার জুরাইনের আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ে তরুণীকে আটকে গণধর্ষণ করা হয়। ময়মনসিংহের গৌরীপুরে ইউপি মেম্বারের বিরুদ্ধে ধর্ষণ ও গর্ভপাতের অভিযোগ এসেছে। চট্টগ্রামে বাসায় ঢুকে ১২ জন বখাটে মিলে ২ জন পোশাক কর্মীর ওপর গণধর্ষণ ও নির্যাতন চালিয়েছেন। কুমিল্লা শহরে হত্যার বদলা নিতে গিয়ে স্কুলছাত্রীকে গণধর্ষণ করা হয়েছে।

ধামরাইয়ে নারী ও রাজবাড়ীতে ছাত্রীকে অপহরণের পর ধর্ষণ এবং মৌলভীবাজারের কলেজছাত্রীকে গণধর্ষণ ও হত্যার খবরও প্রকাশিত হয়েছে।

এমনকি প্রধান শিক্ষকের নির্যাতন ও লাঞ্ছনার কবল থেকে বাঁচতে ছাত্রীর স্কুলে যাওয়া ছেড়ে দেওয়ারও ঘটনাও ঘটেছে! একইভাবে ময়মনসিংহের ভালুকায় ৬ বছরের শিশুকে ধর্ষণের পর হত্যা এবং ঢাকায় বিদেশে পাঠানোর কথা বলে হোটেলে ডেকে এনে ধর্ষণ করা হয়েছে।

অবস্থার এতোটাই অবনতি হয়েছে যে, একজন মুক্তিযোদ্ধার কন্যাকে প্রকাশ্যে প্রতিবাদ জানিয়ে গণধর্ষণের বিচার চাইতে হচ্ছে। মুক্তিযোদ্ধা ওই অসহায় বাবা আক্ষেপে বলছেন, ‘আমি দেশের জন্য যুদ্ধ করেছি। আজ দেশ আমাকে এই মহৎ পুরস্কার দিল’। অভিযোগ, ৮ জন দুর্বৃত্ত দলবদ্ধ হয়ে এ অপকর্ম করেছেন। অপরাধীরা ধরা তো পড়েইনি, বরং নির্যাতিত-মুক্তিযোদ্ধা পরিবারটিই এখন গৃহহারা!

চট্টগ্রামের খুলশী থানার এক নারী কনস্টেবলের অভিযোগ হলো, তিনি তার সাবেক স্বামীর হাতে ধর্ষিত হয়েছেন। ঢাকার তুরাগ থানার একজন নারী কনস্টেবলের ক্ষেত্রেও একই ধরনের ঘটনার খবর পাওয়া গেছে। তাকে তার সাব-ইন্সপেক্টর সাবেক স্বামী একা নয়, বন্ধু-বান্ধবসহ মিলে গণধর্ষণ করেছেন।

গুলশানের অভিজাত হোটেলে জন্মদিনের মিথ্যা প্রলোভনে দুই তরুণীকে ধর্ষণের চাঞ্চল্যকর ঘটনাটিও সাম্প্রতিক সময়ের।

নারীকে কে বাঁচাবে, এ প্রশ্নের উত্তর রাজনীতিবিদ, নাগরিক, একজন বাবা, একজন মা, একজন ভাই বা বোনকে দিতে হবে। দায়িত্ব এড়িয়ে নারী-শিশু ধর্ষণ-নির্যাতনের প্লাবন ঠেকানো যাবে না।

খোদ নারী সমাজকেও সংঘবদ্ধভাবে নিজেদের নিরাপত্তার জন্য সোচ্চার হতে হবে। প্রবল ও সম্মিলিত সামাজিক-রাজনৈতিক প্রতিরোধ-প্রতিবাদ ছাড়া বাংলাদেশের বিপণ্ন নারী ও শিশুদের বাঁচানো যাবে না। আইনের কঠোর, সর্বোচ্চ ও দৃষ্টান্তমূলক প্রয়োগ ছাড়া এ মানবিক বিপর্যয় রোধ করা সম্ভব হবে না।

ড. মাহফুজ পারভেজ: কবি, গল্পকার, গবেষকঅধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় mahfuzparvez@gmail.com

বাংলাদেশ সময়: ০১৩৫ ঘণ্টা, আগস্ট ০৫, ২০১৭
এএসআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।