ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

সুচি কি হিটলারের পথে যাচ্ছেন?

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩০৪ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৯, ২০১৭
সুচি কি হিটলারের পথে যাচ্ছেন? সুচি ও হিটলার।

ভোটে নির্বাচিত হয়ে জার্মানির হিটলার যেভাবে মানব হন্তারকে রূপান্তরিত হয়েছিলেন, মিয়ানমারের সুচি সেই কলঙ্কিত পথেই কি যাচ্ছেন? ২৫ আগস্ট আরাকানে গণহত্যা ও জাতিগত নিধনের ২৬ দিনে আড়াইশ’ গ্রাম পুড়িয়ে শত শত মানুষকে হত্যা ও ধর্ষণের সঙ্গে সঙ্গে পাঁচ লাখ রোহিঙ্গাকে দেশছাড়া করা হয়েছে। তখন সুচি মুখ খোলেন। তাও হত্যাকারী সেনাবাহিনীর পক্ষে। তার নীরবতা ও বক্তব্য গণহত্যার সমর্থক। তিনি যেন নিজেকে হিটলারের দোসরে পরিণত করেছেন।

নাফ নদীর তীরে পুঞ্জিভূত মৃতদেহগুলো এবং বিশ্বের শান্তিকামী মানুষ প্রত্যাখ্যান করেছে সামরিক হত্যাকারীদের পক্ষ হয়ে বলা সুচি'র ভাষণ। রোহিঙ্গাদের কাটা-পোড়া-ডোবা লাশগুলোর প্রতিনিধি হয়ে বিশ্ব বিবেক বরং সাক্ষ্য দেবে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে।

নিন্দা জানাবে গণহত্যা ও জাতিগত নিধনের।

নোবেল শান্তি পুরস্কারের মৃত্যু

আক্রমণকারী মিয়ানমার রাষ্ট্রের মাইনপোঁতা সীমান্তে ছিন্নবিচ্ছিন্ন নারী, শিশু, উদ্বাস্তুরা স্বদেশে ফেলে আসা স্বজনের লাশগুলোর দগদগে স্মৃতি নিয়ে বিস্মিত হয়ে দেখছিল বক্তৃতার ডায়াসে রাখা ফুলগুলো, আর শুনছিল সুচি'র নির্মম মিথ্যাচার। নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়া কণ্ঠ থেকে তখন উচ্চারিত হচ্ছিল, "রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী কোনো ‘ক্লিয়ারেন্স’ অভিযান চালাচ্ছে না। তারা ‘কঠিন আচরণবিধি মেনে নিরাপত্তা অভিযান চালাচ্ছে’ এবং ‘নিরীহ বেসামরিক লোকজনের ক্ষতি না করার’ নীতি তারা নিপুণভাবে পালন করছে। " রোহিঙ্গাদের হত্যাকে তিনি আগের মতোই সমর্থন করলেন।

গত ২৫ আগস্ট ঘটনার শুরু। এতদিন পর তিনি ব্যাখ্যা দিলেন। যেন এতদিন তিনি ঘুমিয়ে ছিলেন। পৃথিবীর মানুষ আশা করছিল, তিনি প্রতিবাদ করবেন। নিন্দা জানাবেন হত্যার। তিনি যে হত্যাকারীদের অপরাধ ঘটতে দেওয়ার জন্য নীরব ছিলেন, বিলম্বিত বক্তৃতায় সেটা স্পষ্ট হলো। রাখঢাক না রেখে অবশেষে হন্তারকদের সাফাইকারী হলেন। টের পেলেন না যে তিনি ততক্ষণে গণতন্ত্রের নেত্রী থেকে ফ্যাসিস্ট হিটলারের প্রেতাত্মা হয়ে গেছেন। পুরনো গণআন্দোলনের পথ ছেড়ে চলেছেন হিটলারের রক্তাক্ত পদচিহ্ন ধরে।

এক পক্ষে নিপীড়িত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিপক্ষে যখন মিয়ানমারের কুখ্যাত সামরিক বাহিনী, তখন সুচি এবং তাঁর সরকার নিরপেক্ষতার  ভান ছেড়ে হত্যাকারী আর্মির পক্ষ নিলেন। পরিণত হলের জনগণের শত্রু পক্ষের একজনে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক প্রধান জেমস গোমেজের ভাষায়, ‘তিনি সেনাবাহিনীর ঢাল হয়েছেন’। গোমেজ বলেন, ‘৫ সেপ্টেম্বরের পর রাখাইন রাজ্যে কোনো (রোহিঙ্গাদের ওপর) আক্রমণ হয়নি বলছেন তিনি, তাহলে সেনাবাহিনীর ভূমিকা কী, কেন সেখানে এখনো আগুন জ্বলছে?’

যে আরাকান জ্বলছে গণহত্যার আগুনে, সেই আরাকানের মুসলমানরা ছিল সুচি এবং তার পিতার স্বজন-সমর্থক। তাদেরকেই শত্রু ও সন্ত্রাসী বললেন তিনি। বুকে জড়িয়ে নিলেন চিরশত্রু নির্দয় সেনাবাহিনীকে। ক্ষমতার মোহ তাকে চরমভাবে বিচ্যুৎ ও বিপথগামী করেছে। বিশ্ববাসী ও দেশছাড়া রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর কাছে তিনি খলনায়িকা। হিটলারও ক্ষমতায় মদমত্ত হয়ে জনপ্রিয়তাকে ব্যবহার করেছিলেন মানব নিধন ও স্বৈরতান্ত্রিকতা প্রতিষ্ঠার কাজে। সুচি সেই কাজটিই করছেন। তিনি স্পষ্টওই হাঁটছেন হিটলারের দেখিয়ে দেওয়া পথ ধরে।

একবিংশ শতকের সবচেয়ে আলোচিত রাজনৈতিক পতনের ঘটনাটি ঘটলো মিয়ানমারের আরাকানে রোহিঙ্গা গণহত্যা ও জাতিগত নিধনের সময়। একদার গণতন্ত্রের নেত্রী সুচি রোহিঙ্গাদের ট্র্যাজেডিকে ‘সিকিউরিটি’ সমস্যা হিসেবে চিত্রায়নের মাধ্যমে উগ্র জাতীয়তাবাদের ধ্বজা তুলে ধরলেন। ক্ষুদ্র জাতিসত্তা ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিধনযজ্ঞেও শরিক হলেন তিনি।   সুচি নামক চরিত্রে এখন আর শান্তিকামী রাষ্ট্রনেতার পরিচয় পাওয়া যায় না, পাওয়া যায় তাঁর বর্তমান ও সত্যিকার পরিচয়। স্টেট কাউন্সেলরের পদাধিকারী হলেও তিনি মিয়ানমারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তাঁর কণ্ঠ দিয়ে কথা বলেছে মিয়ানমারের হন্তারকরা। তিনি শুধু নিজের রাজনৈতিক অতীত ও ঐতিহ্যকেই হত্যা করেন নি, নোবেল শান্তি পুরস্কারকেও কলংকিত করেছেন। নিজেকে রূপান্তরিত করেছেন মানবধ্বংসী হিটলারের অনুগত অনুসারীতে।

মিয়ানমারের আরাকানের গণহত্যা সুচি নামক একদার নায়িকাকে ভিলেন হিসাবে হিমালয় থেকে নর্দমায় ফেলেছে। গণতান্ত্রিক নেত্রীকে বানিয়েছে একালের হিটলার। হত্যার বেদনার চেয়ে এই বিশাল পতনও কম বেদনার নয়।

ড. মাহফুজ পারভেজ: কবি-গবেষক-শিক্ষাবিদ। অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

বাংলাদেশ সময়: সেপ্টেম্বর ১৯, ২০১৭
জেডএম/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।