বিশ্ববিদ্যালয় কার্যক্রমে ছাত্র প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার জন্য রয়েছে ছাত্র সংসদ বা ‘ডাকসু’। ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তুরের গণঅভ্যুত্থান, স্বাধীনতা আন্দোলন এমনকি স্বাধীনতা উত্তর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনেও এই ছাত্র সংসদ জাতিকে নেতৃত্ব দিয়েছে।
১৯২১ সালে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ৩ বছর পরেই যাত্রা শুরু করে ডাকসু। প্রথমে পরোক্ষ ভোটাভুটি পরে প্রত্যক্ষ ভোটেই প্রতিনিধি নির্বাচন হতো। প্রত্যক্ষ ভোটে প্রথম ডাকসু নির্বাচন হয় ১৯৫৩ সালে। এভাবে ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি আমল পার করলো ডাকসু। ডাকসুর প্রথম ভিপি হন এসএ বারি ও সাধারণ সম্পাদক জুলমত আলী খান।
আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনে ডাকসু, স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ, ছাত্রলীগসহ অন্যান্য ছাত্রসংগঠনের অবদানের কথা আমরা ভুলবো কী করে? তাদের সেই তুখোড়, মেধাবী ও দূরদর্শী নেতৃত্বের ফলেই স্বাধীনতা আন্দোলন বেগবান হয়। স্বাধীন বাংলার পতাকাটি প্রথম উত্তোলন করেন ডাকসুর ভিপি আ স ম আবদুর রব। তখন সাধারণ সম্পাদক ছিলেন আবদুল কুদ্দুস মাখন। এরকম আরো অসংখ্য নেতৃত্ব রয়েছে যাদের নাম বাংলাদেশ সৃষ্টির ইতিহাস ও রাজনীতির সাথে ওতোপ্রতোভাবে মিশে আছে।
স্বাধীনতার পর প্রথম ডাকসুর ভিপি হন মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম ও সাধারণ সম্পাদক মাহবুব জামান। এছাড়া স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে সুলতান-মুশতাক পরিষদের কথা কে না জানে? এভাবে ডাকসুর সব নেতারাই পরবর্তীকালে দেশের কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে ইতিবাচক অবদান রেখেছেন। ডাকসু তথা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই গৌরবগাথা বলে শেষ করা যাবে না। এসবই আমাদের ইতিহাসের একেকটি উল্লেখযোগ্য অধ্যায় যা আমাদের সবারই জানা।
কিন্তু দেশ গণতন্ত্রে উত্তরণে সাথে সাথে ডাকসুর দরজা বন্ধ হয়ে গেল। ১৯৯০ সালের পর আমানউল্লাহ আমান ও খায়রুল কবির খোকনের পর আমরা আর কোনো ডাকসু ভিসি-জিএস পাইনি। এরপর আর কোনো নির্বাচন হয়নি। নেতৃত্ব সৃষ্টির সেই প্রতিষ্ঠানটি গত দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে বন্ধ আছে। হাইকোর্ট আদেশ দিয়েছেন আগামী ছয় মাসের মধ্যে ডাকসুর নির্বাচন করতে হবে। এটি নিষ্প্রাণ ও প্রকৃত ছাত্রনেতৃত্বের জন্য অবশ্যই আশা-জাগানিয়া। ছয় বছর আগের করা একটি রিটে আদালত আদেশ দিয়েছিলেন ডাকসু নির্বাচন করার ব্যর্থতাকে কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না। সেই রুলের নিষ্পত্তি করেই হাইকোর্ট আগামী ৬ মাসের মধ্যে নির্বাচন করার আদেশ দিয়েছেন।
ডাকসু নির্বাচন তথা ছাত্র নেতৃ্ত্ব নিয়ে দেশের না মহলে আলোচনা-টকশো কম হয়নি। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ, কোনো সরকার ও রাজনৈতিক দলগুই এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়নি। ফলে, অচল ডাকসুর অভাবে প্রকৃত ছাত্র প্রতিনিধিত্ব সেখানে গড়ে ওঠেনি। এ প্রসঙ্গে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫০তম সমাবর্তনে বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যাঞ্ছেলর রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের বক্তব্যটি গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেছেন, “ডাকসু ইলেকশন ইজ মাস্ট, তা না হলে ভবিষ্যৎ নেতৃত্বশূন্য হয়ে যাবে। ” আমরা সেই যোগ্য নেতৃত্বহীন বাংলাদেশ চাই না।
রাজনৈতিক দলের সমর্থন ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সদিচ্ছাই ডাকসুর জন্য যথেষ্ট। কারণ, এই একই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের নির্বাচন হয়, কর্মকতা-কর্মচারীদের নির্বাচন হয়, সিনেট-সিন্ডেকেট নির্বাচন হয়, কত কমিটি-উপকমিটি নির্বাচন হয়, হয় না শুধু ডাকসু নির্বাচন।
যে ছাত্ররা দেশে গণতন্ত্র আনলো, ‘৯০ এর পরে সেই ছাত্রদের কাছ থেকেই প্রথম গণতন্ত্র কেড়ে নেয়া হলো? এ কেমন বিচার! ছাত্র-ছাত্রীরা এমনকি ডাকসু ও হল সংসদ বাবদ ফি বছর ফি'ও পরিশোধ করছে, অথচ নির্বাচনের দেখা নেই। বর্তমান ভিসি মহোদয় বলেছেন নির্বাচন দেয়ার ব্যাপারে তার সদিচ্ছা ও আন্তরিকতার অভাব নেই। আমরা সেই আন্তরিকতার বহিঃপ্রকাশ দেখতে চাই। ডাকসু নির্বাচন হবে এ সরকারের অন্যতম রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও শুভ উদ্যোগের বহিঃপ্রকাশ।
নির্বাচন না দিয়ে ২৮ বছর ধরে আইনেরও বরখেলাপ করা হয়েছে। স্বাধীনতার পরে ১৯৬১ সালের বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশটি বাতিল করার জন্য কম আন্দোলন হয়নি। সেই আন্দোলনের ফলে অবশেষে ১৯৭৩ সালের বিশ্ববিদ্যালয় আদেশ জারি হয়। ১৯৭৩ এর আদেশ বলে সিনেটের ১০৪ সদস্যের মধ্যে ৫ জন ছাত্র প্রতিনিধি থাকার কথা। কিন্তু গত ২৮ বছরে সেই ৫ জন ছাত্র আমরা খুঁজে বের করতে পারলাম না।
এই রিটের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেছেন, ’২৭ বছরে শুধু ছাত্ররাই তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়নি, বাংলাদেশও বঞ্চিত হয়েছে অনেক যোগ্য নেতৃত্ব থেকে। ’ ডাকসু নেতৃত্ব সৃষ্টির আঁতুড়ঘর। সেই আঁতুড়ঘরে আলো-বাতাস ঢুকুক, সুস্থ-সবল শিশুই আগামী দিনের বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ সময়: ১০০৬ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৬, ২০১৮
এমজেএফ