গুরুজী আরো বলিয়া গিয়াছেন, ‘সাতকোটি বাঙালিরে হে মুগ্ধ জননী/রেখেছ বাঙালি করে মানুষ করনি’। গুরুজীর সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করিয়া শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ বঙ্গসন্তান জাতির জনক বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার পরে ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে এই বঙ্গভূমিতে পা রাখিয়া বলিয়া গিয়াছেন, ‘কবিগুরুর কথা আ(ই)জ মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে।
আমরা স্বাধীনতা অর্জন করিয়া গুরুজীর কথা মিথ্যা প্রমাণ করিলাম বটে। কিন্তু আমাদের সব সুশীল বাঙালিরা এখনো সুবোধ হইতে পারেন নাই। তাহারা এখনো গাধা হইয়া দিন যাপন করিতেছে। তাই ভাবি, ১২২ বছর আগে গুরুজী এই এতিম বঙ্গসন্তানদের যে অভিশাপ দিয়া গিয়াছেন, এতো বছর পরেও বুঝি আমাদের সেই শাপ মোচন হয় নাই! তাই এদেশের সুশীলরা সুবোধ না হইয়া গাধা হইয়াছে, তাও আবার যে সে গাধা নয়, সার্কাসের গাধা। কিন্তু এই গাধাদের গাধা হইবার ইচ্ছা ছিল না, তাহারা ভাগ্যান্বেষণেই গাধা হইয়াছে।
তবে, এই বঙ্গভূমিতে সুশীলরা সুশীল বা সুবোধ না হইয়া গাধা হইলেও সুবলরা সুবলই রহিয়াছে। বরং তাহারা আরো সুবল হইয়াছে, ও সংখ্যায় তাহারা আরো বাড়িয়াছে। ফলে সুশীলরা এ তল্লাটে সুবলদের তোয়াজ-তমিজ করিয়া চলে, রাজ্যের সর্বত্র সুশীলদের লইয়া ঠাট্টা-তামাশা করা হয়, কৌতুক করা হয়, ইত্যাদি, ইত্যাদি।
কিন্তু সুশীলদের দিন এমন ছিল না। একসময় তাহাদের সুদিন ছিল। তাহাদের হাড়ি অন্নপূর্ণ না থাকিলেও তাহাদের ইজ্জত-সম্মানের কমতি ছিল না। সেকালে সুবলরা সুশীলদের সঙ্গে যোগসাজশ বজায় রাখিতে গর্ববোধ করিতেন। সবচেয়ে বেশি সুবল অর্থাৎ, রাজা-মহারাজারা সুশীলদের তাহাদের রাজদরবারে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিতেন। তাহাদের জ্ঞান রসবোধে সভাসদরা হাসি-ঠাট্টায় মাতিয়া থাকিতেন। তাহাদের বুদ্ধি-পরামর্শ মতো চলিতেন বা চলিবার চেষ্টা করিতেন। কার রাজদরবারে সবচেয়ে বড় সুশীল আছেন তাহা লইয়া এক ধরনের প্রতিযোগিতা চলিতো। নিজ রাজসভার সুশীল হস্তান্তর করিয়া এক সুবল আরেক সুবলের হাত হইতে নিজ রাজ্যকে রক্ষা করিবার ইতিহাসও পাওয়া যায়। আবার সুশীলের পরামর্শে তো রাজ্য জয়ের দৃষ্টান্ত ভুরি ভুরি।
এই সুশীলরা একসময় নবরত্ন, পঞ্চরত্নের একেকটি রত্ন হিসেবে গণ্য হইতেন। তখন সুশীলরা সুবোধ ছিলেন। তাহাদের জ্ঞান ও বিচার-বুদ্ধি জাগতিক কোনো লোভ-লালসা দ্বারা তাড়িত ছিল না। তাহারা শিক্ষার চেয়ে জ্ঞানকে, জ্ঞানের চেয়ে বিচার-বুদ্ধি ও প্রজ্ঞাকে বেশি মূল্য দিতেন। তাহাদের মধ্যে জ্ঞানের কম-বেশি থাকিলেও আদর্শের বিভাজন ছিল না। তাহারা রাজা-মহারাজা, আমির-হোমড়া-চোমড়ার তোয়াক্কা করিতেন না। কিন্তু সবাইকেই সম্মান করিতেন, কাহাকেও অধম জ্ঞান করিতেন না। তাই তাহারা সর্বত্র পুজিত হইতেন। সেই জামানায় সুবলরা সুশীলদের সঙ্গে ছবি তুলিয়া ফেসবুকে শেয়ার করিতে না পারিলেও সুবলরা তাহাদের সাহচর্যে ধন্য হইতেন।
এদিকে গোপাল গিন্নি গোপাল ভাড়ের সঙ্গে সারাক্ষণ খিটিমিটি লেগে থাকতো। তাহার একটিই কারণ, গোপালের আয়-রোজগার বেশি ছিল না। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র যা কয়েকটি মোহর দিতেন তাই দিয়ে কি আর সংসার চলে? তারওপরে কৃষ্ণনগরের প্রজাদের এই সমস্যা সেই সমস্যা- সবকিছুতেই গোপালের সাহায্য ছাড়া চলে না। নগণ্য প্রজাকুলের পক্ষে মহারাজের দরবারের চৌকাঠ মাড়ানো কি চাট্টিখানি কথা? তাই প্রজাদের শেষ ভরসাস্থল ওই গোপাল ভাড়। সেই সঙ্গে গ্রামের একগাদা শিশু সবাই তাকে দাদু দাদু বলে অজ্ঞান। গ্রামসুদ্ধ নাতিদের চকলেট, মালাই খাইয়ে হাতে যা দু’টি পয়সা থাকে তাই দিয়ে চলে গোপাল গিন্নিরি সংসার। তাই সারাক্ষণ তার মুখ ভার। কিন্তু তা নিয়ে গোপালের দুশ্চিন্তা ছিল না, কারণ, কৃষ্ণনগরের সবাই গোপালকে দেবতা জ্ঞান করিতেন ও সেই মতো সম্মান করিতে কুণ্ঠাবোধ করিতেন না।
ওদিকে কৃষ্ণচন্দ্রের সভার রাজবৈদ্য, রাজপণ্ডিত, সেনাপতি গোপালকে দেখতেই পারে না। কারণ, মহারাজ গোপালগুণে মুগ্ধ হয়ে তাদের সবাইকে তুচ্ছজ্ঞান করছেন।
শুধু এই বঙ্গভূমিতেই নয়, মহাভারতেও সুশীলদের একই রকম সুদিন ছিল। মহারাজ বিক্রমাদিত্যের রাজসভায়ও নবরত্নের সমাহার ছিল। তাহাদের মধ্যে বিখ্যাত সংস্কৃত কবি অমরসিংহ ও কালিদাস অন্যতম।
সম্রাট আকবরের রাজদরবারের নবরত্নের কথাতো আমরা সবাই জানি। তাহারা শুধু সুশীল-পণ্ডিতই ছিলেন না, তাহারা মন্ত্রিসভাও অলংকৃত করতেন। তার দরবারে ছিলেন আবুল ফজলের মতো প্রধানমন্ত্রী, বীরবলের মতো পররাষ্ট্রমন্ত্রী, টোডরমলের মতো অর্থমন্ত্রী আর তানসেনের মতো সংস্কৃতিমন্ত্রী।
কিন্তু সুলতান সুলেমান, সম্রাট আকবর, রাজা বিক্রমাদিত্য, মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র এমনকি নবাব আলীবর্দীও সুশীলদের নিম্নজ্ঞান করেন নাই। গোপাল পেশায় নাপিত ছিল কিন্তু তাই বলিয়া মহারাজ তাহাকে কখনো নাপিত বলিয়া তুচ্ছ মানেননি। সুবল মহারাজারা হয়তো সুশীলদের রাজদরবার হইতে বহিষ্কার করিয়াছেন, চাকরিচ্যুত করিয়াছেন, বেতন কমাইয়া দিয়াছেন বা দেশান্তরি করিয়াছেন, কিন্তু গাধা বলিয়া প্রজাদের কাছে পরিচয় করাইয়া দেন নাই।
ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস! সে কালের সুশীল-পণ্ডিতরা হালে সার্কাসের গাধা হইয়াছে। হইবে না-ই বা কেন? ‘কিছু লোক আছে নিজেদের অর্থের বিনিময়ে বিক্রি করতে প্রস্তুত থাকে। তারা গায়ে সাইনবোর্ড লাগিয়ে বসে থাকে, ‘ইউজ মি’ অর্থাৎ আমাকে ব্যবহার কর’। এই সুশীলরা সুবলদের ক্ষমতার কাছাকাছি থাকিতে চায়, আর ‘ক্ষমতাধররাও (সুবলরা) ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করার জন্য কিছু লোককে খুঁজে নেয়’। ইহারাই আজকের গাধা সমাজ।
গাধাদের আজ আর সুদিন নাই। তাহাদের সুবলদের কাছাকাছি থাকিতে হয়। তাহাদের ভাষায় কথা বলিতে হয়। সুবলরা যাহা ভাবে, যাহা করিতে চায়, তাহাকেই যুক্তি-তক্ক দিয়া প্রজাকুলের কাছে জাহির করিতে হয়। তাই সুশীলদের মুখেই আজ একই কথা, ‘মহারাজের জয় হউক’, ‘মহারাজের জয় হউক’। সবাই নয়, ইহারাই আজকের গাধা সমাজ।
কিন্তু সমস্যা ওইখানেই। সে আমলে একেকজন রাজা-মহারাজা বহু বছরের জন্য বিশাল রাজ্যে রাজত্ব করিতেন। সুলতানি আমল, মুঘল আমল সবই কয়েকশ বছরের কারবার। রাজা-মহারাজাও বেশি ছিলেন না। কিন্তু আজ সুবলের সংখ্যা দিনে দিনে বাড়িয়াছে আর তাহাদের পোষ্য সুশীলের সংখ্যা বাড়িয়াছে আরো বেশি।
গোপাল-গিন্নির মতো গিন্নিতো আর ঘরে ঘরে নাই যে কোনো মতো কষ্টে-সৃষ্টে দিন কাটাবেন। তাহাদেরও ইচ্ছা হয় হালের ‘মীনা বাজারে’ শপিং করতে। তাই ভাগ্যান্বেষণে আজ একেক সুশীল একেক সার্কাস দলের গাধা বটে।
সার্কাস দলের একটি মেয়ে কিছুতেই দড়িতে লাফালাফি করিতে পারিতেছে না। তাই গুরু মশাই রেগে বললে, দেখ, যদি এরপর আর না পারিস তবে আমার সার্কাস দলের ওই গাধাটির সাথেই তোর বিবাহ দেব’। পাশে বসা গাধাটি তাহা শুনিয়া যারপরনাই খুশিতে গদগদ। আশায় আছে কবে মেয়েটি রশি থেকে পড়িবে আর মেয়েটিকে সে বিবাহ করিবে। মেয়েটির সঙ্গে গাধাটির বিবাহ হইয়াছিল কি-না আমাদের জানা নাই। তবে রবিঠাকুরের সুবল আর সুশীলের ইচ্ছা যে পূরণ হয় নাই তাহা আমরা জানি। বিভাজিত সুশীলরা আজ রবীন্দ্রনাথের সুবলের চেয়েও শক্তিহীন হইয়াছে। ভাগ্যান্বেষণে তাহারা একেকজন একেক সার্কাস দলের গাধারূপে চাকুরি করিতেছে বটে। ওদিকে সুবলরা আরও বলপ্রাপ্ত। অতঃপর সুবলদের আইনসভায় সুশীলদের সার্কাস দলের গাধা বলিয়াই সাব্যস্ত করাই সমীচীন। এ লক্ষ্যে বিল উত্থাপন করা হইলেও হ্যাঁ জয়যুক্ত হবে, হা জয়যুক্ত হবে, হা জয়যুক্ত হবে।
বাংলাদেশ সময়: ১৬৩০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৬, ২০১৮
এএ