কাতালোনিয়ার স্বাধীনতা, রেফারেন্ডাম এবং সেসব ঠেকাতে স্পেনের কেন্দ্রীয় সরকারের বলপ্রয়োগ নিয়ে কিছুদিন আগেও বিশ্ব সরব ছিল। মিডিয়ার ফোকাস থেকে সরে গেলেও কাতালানদের মুক্তি ও স্বাধীনতার স্বপ্নটি মোটেও হারিয়ে যায়নি।
একটি জাতির মানবাধিকার ও গণতান্ত্রিক অধিকারের ন্যায়সঙ্গত পদক্ষেপে শাসকের আক্রমণ নতুন কিছু নয়। অতীতের ধারাবাহিকতায় এমন নিপীড়নের অনেক চিত্রই দেখতে পাওয়া গেলেও ইতিহাসের ভাষ্য হলো, সময় নিলেও গণআন্দোলন ও স্বাধীকারের দাবি শেষ পযন্ত বিজয়ী হয়। সময় লাগলেও কাতালোনিয়ার ক্ষেত্রেও এই ঐতিহাসিক সত্যটি প্রতিষ্ঠিত হবে বলেই বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
কাতালোনিয়ার আন্দোলন বিশ্বের অন্যান্য গণসংগ্রামের মতোই এগিয়ে এসেছে। ধারাবাহিকভাবে প্রতিবাদ ও অসম্মতি জানিয়েছে তারা কেন্দ্রের প্রতি। এমন কি ফুটবল-ক্লাব বার্সেলোনার ফাঁকা মাঠে খেলার মতো ঘটনা ঘটেছে। রাজনৈতিক প্রতিবাদের এমন খণ্ডচিত্র ছিল অভূতপূর্ব। এমনটিই হয়েছে স্পেনের বিরুদ্ধে কাতালোনিয়ার ঐতিহাসিক আন্দোলনের ধারাবাহিকতায়।
জাতিগত ও মতাদর্শগত দিক থেকে কাতালানরা যে হিস্পানিক স্পেনের চেয়ে স্বতন্ত্র ও আলাদা, সেটা ঐতিহাসিক ও নৃতাত্ত্বিকভাবে সত্য। সাম্প্রতিক সময়েই যে তারা প্রথমবারের মতো স্বাধীনতার দাবি করেছে এমন নয়। স্পেন রাষ্ট্রের সৃষ্টির সময় থেকেই আলাদা ভৌগোলিক ও ভাষিক সত্তার কাতালানরা প্রতিবাদ জ্ঞাপন করে এসেছে। বিভিন্ন সময়ে হ্রাস-বৃদ্ধি হলেও কাতালানদের স্বাধীনতার দাবি লুপ্ত হয়নি। সুযোগ পেলেই তারা মুক্তির আওয়াজ তুলেছে।
ইউরোপের প্রেক্ষাপটে জাতিগত বিরোধ নতুন কিছু নয়। ইংরেজ ও ফরাসিদের শতবর্ষী যুদ্ধ ছাড়াও অন্যান্য জাতিসমূহের বৈরিতার তিক্ত ও রক্তাক্ত অতীত রয়েছে। স্কটিশ, আইরিশ, ইংরেজদের দ্বন্দ্ব অস্পষ্ট নয়। ইংল্যান্ড, গ্রেট ব্রিটেন, ইউনাইটেড কিংডম বলে যে বিভিন্ন রাজনৈতিক সত্তাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ইংরেজরা, তা নিয়ে তো প্রশ্ন বহুদিনের।
খোদ ইউরোপেই সংক্ষুব্ধ রাজনৈতিক সত্তার একাধিক উদাহরণ রয়েছে। ভেনিস (ইতালি), ফ্যারো আইল্যান্ড (ডেনমার্ক), কর্সিকা (ফ্রান্স), সাউথ টাইরল (ইতালি), বাস্ক (স্পেন), বাভারিয়া (জার্মানি) বহুদিন ধরেই আলাদা সত্তার প্রমাণ দিচ্ছে এবং অনুচ্চ স্বরে হলেও আপাত সায়ত্ত্বশাসনের চেয়েও অধিকতর স্বাধীনতার দাবির জানান দিয়ে আসছে।
ইউরোপ ও বিশ্বের প্রেক্ষাপটে কাতালানদের আন্দোলনটি সাম্প্রতিক সময়ে যথেষ্ট বেগবান হয়ে ওঠায় অন্যসব কিছুর চেয়ে তা বেশি নজর কেড়েছে। স্পেনের কেন্দ্রীয় সরকার যেভাবে সে আন্দোলনকে দমনের চেষ্টা করেছে, তা নিয়েও প্রতিবাদ হয়েছে। উন্নত বিশ্বের পীঠস্থান ইউরোপে মানবাধিকার লঙ্ঘনসহ নানাবিধ বলপ্রয়োগের ঘটনায় বিশ্ব নিন্দামুখর হয়েছে।
বিশ্বের বিভিন্ন স্থানেই কেন্দ্রীয় শাসনের অধীনে ক্ষুদ্র ভাষা বা জাতিসত্তার প্রতি নিপীড়নের ঘটনা অহরহই ঘটছে। তা সবচেয়ে চরম ও নৃশংস রূপটি লাভ করেছে মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের জাতিগত নিধনের ক্ষেত্রে। ঠিক এমন না হলেও স্পেনে দীর্ঘদিন ধরেই মূলস্রোতের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী কর্তৃক ক্ষুদ্র জাতিসত্তার প্রতি অবহেলা ও অবদমন চলে আসছে। কাতালান সত্তাকে ‘স্পেনীয়’ বলে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে বারবার। ‘ডাইভারসিটি’কে অস্বীকার করে ‘হেজিমনি’কে প্রবল করা হয়েছে। ফলে স্পেনীয় প্রাধান্য ও প্রাবল্যের সামনে সঙ্কুচিত কাতালান সত্তা নিজের আইডেনটিটি বা পরিচিতি নিশ্চিত করার জন্য সংগ্রামমুখর হতে বাধ্য হয়েছে।
স্পেনীয় আধিপত্য ছাড়াও দেশটির যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থার প্রতি কাতালানরা আস্থাশীল নয়। বৃহত্তরের কাছে তাদের ক্ষুদ্র উপস্থিতির জন্য নিজেদেরকে বঞ্চিত ও শোষিত মনে করেন তারা। কাতালান প্রদেশ অর্থনৈতিকভাবে অনেক অগ্রসর। ফলে তারা বৃহত্তর স্পেনকে নিজেদের কামাই-রোজগার দিয়ে লালন-পালনের দায়িত্বও নিতে চাইছে না। ফলে জাতিগত ও নৃতাত্ত্বিক পার্থক্য, রাজনৈতিক প্রান্তিকীকরণ ও অর্থনৈতিক বিকাশের অন্তরায় থেকে নিজস্ব পরিচিতি ও বিকাশকে নিশ্চিত করার জন্য কাতালোনিয়ার সামনে স্বাধীনতার দাবি উত্থাপন ছাড়া বিকল্প ছিল না।
স্পেন ও কাতালোনিয়ার মধ্যে যে সমস্যা ও বিরোধ, তা বলপ্রয়োগে মীমাংসার নয়। অতীতের নানা পর্যায়ে যেমন, এখনও জাতিগত, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণে কাতালোনিয়া অঞ্চলটি স্পেনের সঙ্গে থাকার বিরোধী। আপাতভাবে শক্তিপ্রয়োগের মাধ্যমে আন্দোলনটিকে দমন করা গেলেও এটি মোটেও নিঃশেষ হয়ে যায় নি। অচিরেই যে কাতালানরা আবার ফুঁসে উঠবে, নতুন কৌশল ও পন্থায় অগ্রসর হবে, তা বলাই বাহুল্য। অন্তত কাতালানদের রাজনৈতিক অতীত এমন আভাসই দেয়।
বাংলাদেশ সময়: ১৬৫৯ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৭, ২০১৮
এমপি/জেএম