রাইম সে ভালোই জানে। ইংরেজি অনেক ছড়া শোনালো।
বাচ্চাটি পড়ে বেশ নামি-দামি একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে। ভর্তি হওয়াই যেখানে সহজ নয়। ভর্তি হলেও বেতন, ফি ইত্যাদির বড় রকমের চাপ আছে। অভিভাবক এমন স্কুলে সন্তানদের পাঠিয়ে শুধু নিশ্চিন্তই নন, বেশ আনন্দিতও। তার সন্তান ‘অমুক’ স্কুলে পড়ে, এটা নাকি আজকাল স্ট্যাটাস সিম্বল, আত্মতৃপ্তি ও শ্লাঘার বিষয়।
কিন্তু সে স্কুলে পড়াশোনা বলতে কি হচ্ছে, সে খোঁজ অনেকেই রাখেন না। বড় জোর কয়েকজন প্রাইভেট টিউটর রেখে দেন। সন্তান যে ভালো করে বাংলা বলতে বা পড়তে পারছে না, সে ব্যাপারে তারা নির্বিকার। বরং ছেলেমেয়ে পটপট করে ইংরেজি বলতে পারছে শুনেই তারা খুশিতে আটখানা!
আসলে শিক্ষার মূল ভিত্তিটাই যে প্রাথমিক স্তরে গড়ে ওঠে, সে ধারণা অনেকেরই নেই। শিক্ষা নিয়ে যারা কাজ করেন, তারা জানেন, বাংলা মাধ্যমের ছাত্ররা ইংরেজিতে ভয়ানক দুর্বল। আর ইংলিশ মিডিয়ামের শিক্ষার্থীরা বাংলায় কাঁচা। এই ধরনের অসম্পূর্ণ শিক্ষায় যেসব ছেলেমেয়ে বছরের পর বছর পাস করছে, দেখা যাচ্ছে তারা ভাষাগত দুর্বলতা নিয়েই বেড়ে উঠছে।
কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের গড় ছাত্র-ছাত্রীদের ভাষাগত সমস্যা প্রকট হচ্ছে। যে কারণে কোনও কোনও পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষেই ভাষার কোর্স দিতে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের তৈরি করার জন্য। কারণ, অধিকাংশ শিক্ষার্থীরই ভাষাজ্ঞান ত্রুটিযুক্ত। বানান, বাক্যগঠন ইত্যাদি মৌলিক বিষয়েই তাদের সীমাবদ্ধতা প্রকট আকারে দেখা যায়। অথচ প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে একটু যত্ন নেওয়া হলে উচ্চশিক্ষার স্তরে ছাত্রছাত্রীদের জন্য আলাদা করে ভাষার কোর্স করানোর দরকার হতো না।
অতএব ভাষাটা বাচ্চাদের শেখাতে হবে প্রাথমিক স্তর থেকেই। অন্যান্য ভাষা বা বিষয়ের মতো বাংলাতেও যেন ছেলেমেয়েরা ভালো করে, সেদিকে নজর দিতে হবে। এই তদারকির কাজটি ইংলিশ মিডিয়ামে বেশি করে করা দরকার। সবকিছু ইংরেজিতে শেখাতে গিয়ে মাতৃভাষা বাংলার ক্ষেত্রে অবহেলা করাটা মোটেও সমীচিন নয়। বাংলা মুখের ভাষা বলে এমনি এমনি শিখে যাবে মনে করাটাও ভ্রান্ত চিন্তা। কেননা, মানসম্মত ও প্রমিত ভাষা শিক্ষা ছাড়া আপনিতেই রপ্ত করা যায় না।
যেসব শিক্ষার্থী ইংরেজি মাধ্যমে পড়ে, তাদেরকে মাতৃভাষার পাশাপাশি অন্তত নিজ সংস্কৃতির শিকড়টুকু চিনিয়ে দেওয়ার জন্য স্কুলে বাংলার প্রতি গুরুত্ব দেওয়া খুবই দরকার। স্কুলে নানা পরিবেশ, নানা সংস্কৃতি, নানা অঞ্চল থেকে ছাত্র-ছাত্রীরা আসে। সেইসব ক্ষেত্রে আঞ্চলিকতা বা সংস্কৃতিগত প্রভাব তাদের মধ্যে থাকাটাই স্বাভাবিক। স্কুলের কাজ হলো সর্বজনীন ও আর্দশস্থানীয় একটি ভাষা কাঠামোর মধ্যে শিক্ষার্থীদের নিয়ে আসা, যাতে বাংলা বা ইংরেজি, যে ভাষাতেই হোক, সে যেন মনের ভাব বা বিষয়গত জ্ঞান প্রকাশ করতে পারে। একপেশে বা একভাষিক শিক্ষার্থী তৈরি করা কখনও স্কুলের কাজ হতে পারে না।
স্কুলটি বাংলা মাধ্যমের না ইংলিশ মিডিয়ামের, সেটি বড় কথা নয়। বড় কথা হলো অন্যান্য কৃতিত্বের সঙ্গে সঙ্গে স্কুলটি তার শিক্ষার্থীদের মাতৃভাষায় যথেষ্ট পারদর্শী ও পারঙ্গম করতে পারছে কিনা, সেটাই। শিশুকালেই যদি মাতৃভাষা শিক্ষার কাজটি পরিবার এবং স্কুল না করতে পারে, তাহলে সারা জীবনের জন্য শিক্ষার্থীটিকে বিপদের মধ্যে ফেলে দেওয়ার নামান্তর হবে।
বাংলাদেশ সময়: ১১২৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০১, ২০১৮
এমপি/জেএম