কিন্তু কৌশলগত কারণে নির্বাচনের মাঠ থেকেও একেবারে সরে যাওয়া বুদ্ধিমানের কাজ নয় বলে মনে করছে দলটি। তাই বিএনপি নেত্রী নির্বাচনী প্রচারাভিযানের অংশ হিসেবেই হযরত শাহজালাল (র.) এর মাজার জিয়ারত করলেন।
আওয়ামী লীগ নির্বাচনের মাঠে নামলেও উঠে-পড়ে লাগেনি। প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনের সম্ভাবনা হ্রাস করতে পারলে মাঠ ততোটা গরম না করলেও চলে। তবে কৌশলগত কারণে নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ও অংশগ্রহণমূলক হিসেবে উপস্থাপন করা, নির্বাচন সিরিয়াসলি নিয়েছে- এটা জাহির করার জন্য মাঠে যতোটুকু প্রয়োজন ততটুকুই উষ্ণতা ছড়াবে আওয়ামী লীগ। অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ ও প্রদর্শন দু’টিই নিরর্থক। ক্ষমতাসীন দলটির গতিবিধি তাই বলছে।
স্বাভাবিকভাবেই রায়ের সম্ভাব্য ফলাফলের উপর বিএনপি তাদের নির্বাচনী ও দলীয় কৌশল নির্ধারণ করবে। আর আওয়ামী লীগের কৌশল তখন নির্ভর করবে ‘মাইনাস ওয়ান বিএনপি’র উপর। প্লাস ওয়ান বিএনপি বা খালেদা জিয়ার জায়গায় বিএনপির নতুন নেতৃত্বের ওপর নির্ভর করবে আওয়ামী লীগের নতুন কর্মপরিকল্পনা। তাতেও আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কৌশলের ব্যাপক পরিবর্তন হয়তো আসবে না। কারণ, আদালত আদালতের মতোই চলবে, আর রাজনীতিও তাই।
আদালত এ কারণেই প্রাসঙ্গিক যে, তারেক রহমানের মাথার উপর একাধিক মামলার রায় ও জেল-জরিমানার খড়্গ ঝুলছে। বিদ্যমান মামলাগুলো চললেই কেল্লা ফতে! আর রাজনীতিতো চলবে রাজনীতির মতোই। ফলে চলমান রাজনৈতিক অবস্থায় খালেদা জিয়ার জায়গায় তারেক হাল ধরলে ধানের শিষে হাওয়া লাগবে- এটা ভাবার যথেষ্ট কারণ নেই। আর নৌকারও নতুন পাল তোলার বা দিক পরিবর্তনের দরকার নেই। হালটি শক্ত করে ধরলেই চলবে।
চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে তারেকের বিএনপিতে শক্তি যোগ হবে না। তাতে বরং শক্তি ক্ষয়ই হবে। খালেদা জিয়ার মামলার রায় কি হবে তা সময় বলবে। তবে খালেদার অবর্তমানে দলের হাল ধরার জন্য তারা এতোদিন তারেককে ভেবেছিল। এখন অনেকে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ আসছে মনে করলেও তারেক দেশে এসে বিএনপির হাল ধরবে না বলেই বোধগম্য হয়। কারণ তারেকেরও সেই একই পরিণতির পথ আগেই রচিত। তাই এখন বিএনপি তারেকের শক্তি ক্ষয় করবে না। কিন্তু ভবিষ্যতে ‘দেখিয়ে দেবো’র অপেক্ষায় থেকে বর্তমানে আধমরা হয়ে বেঁচে থাকার মাঝে কাল্পনিক সুখ থাকতে পারে, তা বাস্তবিক অসুখে পূর্ণ। বিএনপি এখন সেই কাল্পনিক সুখ আর বাস্তবিক অসুখের মাঝামাঝি সময় পার করছে।
এদিকে ‘ক্লিন ইমেজধারী’ হিসেবে তারেকের সুনাম নেই। তারেক এসে বিএনপির ঘরে ঘরে আলো জ্বালিয়ে দেবে, এটা ভাবারও তাই কারণ নেই। ভাঙা সুটকেসের মালিকের ছেলের বিরুদ্ধে দুর্নীতির গুঞ্জন ক্ষমতায় থাকতেই শোনা যায়। ‘হাওয়া ভবন’, ‘গ্রেনেড হামলা’তো আছেই। কাজেই পুত্রের মাঝে সবসময় পিতাকে খুঁজতে চাওয়ার মতো বোকামি আর নেই। তাতে মাঝে মধ্যে রাহুলের মাঝে রাজীব প্রাপ্তি হলেও তারেকে জিয়া নয়। তারেক যদিও তরুণদের উদ্বুদ্ধ করতে পেরেছিলেন, কিন্তু সেটি ক্ষমতায় থাকতে। এছাড়া গত একযুগে বিএনপির কোনো তরুণ নেতৃত্ব গড়ে ওঠেনি। রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে নেতৃত্বের আমূল পরিবর্তনও করা যায়নি। আমান-নাজিমুদ্দিন বা এ্যানীর পরে ছাত্রদলে জাতীয় রাজনীতির পালে হাওয়া দেওয়ার মতো কোনো নেতৃত্ব গড়ে ওঠেনি। ফলে, বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের মতো তরুণ নেতৃত্বও পাশাপাশি আইসিইউতে।
আওয়ামী লীগ মা-ছেলের জন্য পথটি কঠিন করে দিলেও মা হিসেবে খালেদা তারেকের পথটি সহজ করার সর্বাত্মক চেষ্টাই করেছেন। তিনি দলের গঠনতন্ত্রের ৭ ধারায় পরিবর্তন এনেছেন যাতে ছেলে ‘দণ্ডিত’ ‘দেউলিয়া’ ‘উন্মাদ’ ও 'সমাজে দুর্নীতিপরায়ণ বা কুখ্যাত বলে পরিচিত' হলেও দলের যেকোনো নির্বাহী কমিটির সদস্য বা দলের পক্ষে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারেন (শব্দগুলো দলের গঠনতন্ত্র থেকে উদ্ধৃত)। দলে বংশের বাতি জ্বালিয়ে রাখতে তাকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে হলেও এ কাজটি করতেই হয়েছে। তবে, আসন্ন রায়ে শুধু ছেলের নয়, দল থেকে তার পদও খারিজ হয়ে যেতো। তাই গঠনতন্ত্র সংশোধনের এই আশু ব্যবস্থা। তবে এটি বিদ্যমান প্রতিহিংসাপরায়ণ রাজনীতিরই একটি প্রতিক্রিয়ামাত্র। অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা, এর বেশি কিছু নয়। Doctrine of Necessity শুধু রাজনীতিতে নয়, দলেও কাজে লাগে।
এদিকে পুত্রবধূ জোবায়দা বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ‘খুন্তির লড়াই’ বাদ দিয়ে এখনই রাজনৈতিক লড়াইয়ে শামিল হবেন কিনা সেটি প্রশ্নবোধক। তিনি কি সীতার মতো বনবাসে থেকে স্বামীর হাত ধরে 'একদিন' এই লঙ্কারাজ্য জয় করবেন, নাকি আজই শাশুড়ির পদে এসে অগ্নিপরীক্ষায় শামিল হবেন তা বোঝা মুশকিল। তবে তিনি ভাবতেই পারেন, ‘সীতা ভুল করতে পারেন, আমি না’। আগুনের চেয়ে বনবাস ঢের ভালো। ফলে আপাতত কুরুক্ষেত্রে যারা আছেন অস্থায়ীভাবে তারাই হয়তো লড়াইটা চালিয়ে যাবেন বলে মনে হয়। মাঠে মহাসচিব, অফিসে রুহুল কবীর আর রিমোট কন্ট্রোলে যুবরাজই এ অঙ্কে ভূমিকা পালন করে যাবেন। আর শেষ অঙ্কের জন্য আমাদের আরো অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু রাজনীতিতে শেষ অঙ্ক বলে কি কিছু আছে?
২০০৮ সালের ৪ জুলাই সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দুদক এ মামলাটি করে। অভিযোগ 'প্রধানমন্ত্রীর তহবিলের অর্থ আত্মসাৎ'। প্রধানমন্ত্রীর তহবিলের অর্থ গেছে এতিমদের ট্রাস্টে। এ মামলায় খালেদা জিয়ার সঙ্গে তার পুত্রও আসামি। এক হিসেবে ঠিকই আছে, কথায় আছে পিতা না থাকলে পুত্র এতিম হয়ে যায়। সে হিসেবে তারেক জিয়াও এতিম। তাই প্রধানমন্ত্রী মা হিসেবে সে টাকা একজন খাটি এতিম সন্তানকে দান করেছেন। এতে দোষের কী? কিন্তু গোলমালটি বাঁধে যখন 'প্রধানমন্ত্রী', 'মা', 'সন্তান', 'রাষ্ট্রীয় তহবিল', 'এতিম', 'ট্রাস্ট' শব্দগুলো এক হয়ে যায়। প্রধানমন্ত্রী যখন মা হয়ে যান, সন্তান যখন এতিম হয়ে যান তখন রাষ্ট্রীয় তহবিলের এতিমখানায় যাওয়া ছাড়া আর কি-ই বা করার থাকে?
মামলার রায় কী হবে তা আমরা কেউই জানি না। বেকসুর খালাস অথবা শাস্তি। খালাস হলে তো খালাস। কিন্তু শাস্তি হলে আপিল করার সুযোগ রয়েছে। কাজেই রায়ে দণ্ড দিলেই খালেদাকে সঙ্গে সঙ্গে কারাগারে পাঠানো হবে- এমনটি নাও হতে পারে। আবার হতেও পারে। কারণ এটি শুধু আইনি প্রক্রিয়া নয়, এর সাথে রাজনীতির রয়েছে গভীর সম্পর্ক। আইনের রাজনীতি আর রাজনীতির আইন এক না। আমরা আপাতত রাজনীতির আইনের ওপরই চোখ রাখি, কারণ, আইনের রাজনীতি আরো কঠিন!
বাংলাদেশ সময়: ১৬২১ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৬, ২০১৮
এএ