মনে করা হয়, বর্তমানে পুরো দুনিয়ায় তিরিশ কোটি মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলেন।
ভাষাগত-জনগোষ্ঠীর এই সংখ্যাগত বিশালত্ব এশিয়া মহাদেশে বাংলাকে দ্বিতীয় বৃহত্তম ভাষিক-জনগোষ্ঠী হিসেবে চিহ্নিত করেছে এবং এশিয়া মহাদেশের কয়েক হাজার ভাষার মধ্যে মাতৃভাষার অবস্থানে বাংলাকে স্থান করে দিয়েছে দ্বিতীয় আসনে।
আমাদের বাংলাভাষা বাংলাদেশের জাতীয় ভাষা। ভারতের আঠারোটি অফিসিয়াল ভাষার মধ্যে অন্যতম। বাংলাভাষায় বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত, ভারতের জাতীয় সঙ্গীত আর জাতীয় স্তোত্র রচিত। ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো ১৯৫২-এর দুর্বার ভাষা আন্দোলনের দুঃসহ ঘটনাকে সশ্রদ্ধ মর্যদায় অভিষিক্ত করেছে। ২১ ফেব্রুয়ারি ঘোষিত হয়েছে আন্তর্জাতিক ‘মাতৃভাষা দিবস’ রূপে। বিশ্বের ১৮৮টি দেশের মানুষ এই দিনটিকে ‘মাতৃভাষা দিবস’ রূপে উদযাপন করে চলেছেন শ্রদ্ধার ডালি এবং ভালোবাসার অর্ঘ্য নিবেদন করে।
এথনোলগ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের জরিপের কথা প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায়। এথনোলগ হলো একটি ওয়েব-বেসড ক্যাটালগ। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে এখানে জরিপের মাধ্যমে পরিসংখ্যান অনুযায়ী বিশ্বের ভিন্ন ভিন্ন জনগোষ্ঠীর ভাষাসমূহ সংগ্রহ করে লিপিবদ্ধ করা হয়ে থাকে। তাদের জরিপ অনুযায়ী, বাংলা ভাষিক জনসংখ্যার গরিষ্ঠতা বিচারে বিশ্বের দশটি প্রধান ভাষার মধ্যে বাংলা ভাষার স্থান পঞ্চমে। পর্যায়ক্রমে এর আগের চারটি ভাষা হলো, ম্যান্ডারিন চাইনিজ, স্প্যানিশ, ইংলিশ ও হিন্দি। পরের পাঁচটি ভাষা হলো: আরবি, রাশিয়ান, পর্তুগিজ, জার্মান ও ফ্রেঞ্চ।
বর্তমানে অস্তিত্বমান ৭০০০ ভাষার মধ্যে বাংলা ভাষার এই আসনটি নির্ণীত হয়েছে বাংলাদেশ এবং বিশ্বব্যাপী বাংলাভাষী জনসংখ্যার সংখ্যাতত্ত্বগত আধিক্যের ভিত্তিতে। কিন্তু দেশের বাইরে প্রবাসের বিরূপ সামাজিক আবহাওয়ার বাস্তব পরিপ্রেক্ষিতে প্রবাসীদের বাংলাভাষার চর্চা নানাবিধ সঙ্কুলতায় পূর্ণ। তথাপি অনেকেই স্ব-উদ্যোগে সন্তান ও পরিবারের মধ্যে বাংলাকে ধরে রেখেছেন। কিন্তু একটি বৈশ্বিক পরিমণ্ডলের নানা ভাষা ও সংস্কৃতির স্রোতকে ঠেলে ঠেলে সেটা কতটুকু সম্ভব হবে?
যদি প্রবাসের বাংলা ভাষিক জনগোষ্ঠীক বাংলাভাষার সঙ্গে সম্পর্কিত রাখা সম্ভব না হয়, তাহলে যে বিশাল সংখ্যার জোরে আমরা বাংলাভাষাকে নিয়ে বুক ফুলিয়ে চলি, সেটা সম্ভব হবে না। কারণ, বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের বাইরে মোট বাংলা ভাষিক জনগোষ্ঠীর এক-তৃতীয়াংশই প্রবাসী। বিশ্বব্যাপী প্রসারিত বাংলাভাষার দিগন্তকে নির্বিঘ্ন রাখতে হলে প্রবাসীদের মাতৃভাষা চর্চায় মনোযোগ ও গুরুত্ব দিতেই হবে।
পাশ্চাত্যের ভাষাবিজ্ঞানীরা জানিয়েছিলেন এশিয়া মহাদেশের ৫৫টি, আফ্রিকার ৩৭টি, ইউরোপের ৭টি, প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের বিশেষত অস্ট্রেলিয়া মহাদেশের ১৫৭টি এবং দুই আমেরিকার ১৬১টি ভাষা ইতোমধ্যেই বিলুপ্তির পথে। কারণ এই ভাষাগুলোয় যারা এখনো কমিউনিকেট করছেন তারা সকলেই হয় বৃদ্ধ, নয়তো প্রায়-বৃদ্ধ। পৃথিবীতে এই লুপ্তপ্রায় ভাষাভাষী মানুষের সংখ্যা ১০০ থেকে সর্বোচ্চ ১০০০০ সংখ্যার নিচে।
আরেকটি তথ্যও বেশ উদ্বেগের। বর্তমানে অস্তিত্বময় ভাষাপ্রবাহের গতিপ্রকৃতির বিভিন্ন তথ্যউপাত্ত সংগ্রহ করে ভাষাবিজ্ঞানের পদ্ধতিগত বিশ্লেষণ শেষে এমন ভবিষ্যৎ সতর্কতা বাণী উচ্চারিত হচ্ছে যে, একবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে বর্তমান বিশ্বের ৭০০০ অস্তিত্বমান ভাষার প্রায় নব্বই শতাংশই বিলুপ্ত হয়ে যাবে অথবা অবলুপ্তির সম্মুখীন হয়ে পড়বে। যেভাবে নতুন জন্ম নেয়া জনপ্রিয় ভাষাগুলোর শক্তিশালী অভিঘাতে ক্রমে ক্রমে অব্যবহৃত হয়ে গেছে, ‘ওল্ড চার্চ স্লাভেনিক, ক্লাসিক্যাল আর্মেনিয়ান, আভেস্তান, বিবলিক্যাল হিব্রু, কপটিক, নিউ টেস্টামেন্ট গ্রিক, গীজ, অর্ধমাগধী (মাগধী প্রাকৃত ও মাগধী অপভ্রংশ, যা বাংলা এবং উপমহাদেশীয় বহু ভাষার জননী), পালি, সংস্কৃত ও ল্যাটিন’ প্রভৃতি।
ফলে শক্তিশালী ও মহৎ একটি ভাষা থাকলেই হচ্ছে না, তাকে সঞ্জীবিত রাখারও দরকার পড়ছে। বিশেষত বিশ্বায়নের এই যুগে পৃথিবীর বিভিন্ন রাষ্ট্রে মাইগ্রেটেড জেনারেশনের একটা অংশ তাদের পরের প্রজন্মের জন্য মাতৃভাষা চর্চার বিষয়ে উদ্যোগ গ্রহণ করলেও উত্তর পুরুষদের বেশিরভাগেরই পূর্ব পুরুষদের ভাষার সঙ্গে আন্তরিক কোনো সম্পর্ক গড়ে উঠছে না।
কারণ শৈশব থেকে যে সুনির্দিষ্ট দেশের অফিসিয়াল ও স্থানীয় ভাষার মাধ্যমে তাদের প্রাত্যহিক শিক্ষা অর্জন ও জীবন-যাপন করতে হয় (স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটি প্রভৃতিতে শিক্ষালাভের ফলে), তার সমাজসংস্কৃতির পারিপার্শ্বিকতা আর বন্ধু সংসর্গের বাস্তবতাকে তাদের পক্ষে অগ্রাহ্য করা বাস্তবেই সম্ভব নয়। এই বাস্তবতার সঙ্গে লড়াই করেই বিদেশে বসবাসরত বাংলাভাষী মানুষের মুখে ও চর্চায় বাংলা ভাষাকে টিকে থাকতে হচ্ছে বা হবে।
বাংলাদেশ সময়: ১০০৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৮, ২০১৮
এমপি/জেএম