ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

খালেদার দণ্ডে অগ্নিপরীক্ষায় বিএনপি

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০১৫৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ৯, ২০১৮
খালেদার দণ্ডে অগ্নিপরীক্ষায় বিএনপি নিজের গাড়িতে রায় শুনতে আদালতে যাচ্ছেন খালেদা জিয়া/ছবি: জিএম মুজিবুর

জন্মের পর সম্ভবত সবচেয়ে কঠিন অগ্নিপরীক্ষার মুখোমুখি বিএনপি। বর্তমান সময়ে রাজনৈতিক দল হিসাবে ভেতর ও বাইরে থেকে ধেয়ে আসা প্রবল সঙ্কুল পরিস্থিতি অতিক্রমকারী বিএনপি তার শীর্ষ নেত্রী খালেদা জিয়ার দণ্ডাজ্ঞার কারণে আরও নাজুক অবস্থার সম্মুখীন হয়েছে। কুশলী নেতৃত্বের দূরদৃষ্টি ও বুদ্ধিমত্তায় বিদ্যমান বিরূপ পরিস্থিতি অতিক্রম করাই এখন বিএনপির সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

৮ ফেব্রুয়ারি দলীয় প্রধান খালেদা জিয়া সাজাপ্রাপ্ত হয়ে কারাগারে যাওয়ার পরপরই তিনটি চ্যালেঞ্জিং গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দলটির সামনে চলে এসেছে। ১. নেত্রীকে আইনি লড়াইয়ের মাধ্যমে মুক্ত করা, ২. প্রবাসে অবস্থানকারী নতুন শীর্ষ নেতা তারেক রহমানের সঙ্গে দলীয় কাজের অর্থপূর্ণ সাংগঠনিক সংযোগ বিধান করা, এবং ৩. কুশলী ও প্রজ্ঞাপূর্ণ কর্মসূচির মাধ্যমে দলের ঐক্য ও সংহতি বজায় রেখে সম্ভাব্য ভাঙন, বিপর্যয় ও হঠকারিতার কবল থেকে মুক্ত রাখা।

 

সাম্প্রতিক সময়ে নানা দিক থেকে ঘনীভূত সঙ্কটসমূহের আশু উত্তরণ ঘটানো বিএনপির জন্য আরও জরুরি এইজন্য যে, সামনেই একটি জাতীয় নির্বাচন অপেক্ষমাণ এবং দীর্ঘ বছর ক্ষমতার বাইরে থেকে দলটির নেতা ও কর্মীরা যথেষ্টই ম্রিয়মাণ। একটি পুরনো ও শক্তিশালী দলের জন্য দীর্ঘকাল এমন দশা হতাশাজনক।

রাজনীতির ইতিহাসে দলের সঙ্কট হতেই পারে। এসব নতুন কিছু নয়। আবার বিশ্বের নানা দেশে নেতৃবৃন্দের কারাবরণও নতুন কোনও ঘটনা নয়। রাজনীতির সঙ্গে রাজপথ ও কারাগার, আশা ও হতাশা অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। খালেদা জিয়ার ক্ষেত্রে জেলে গমনের ইতিহাসও নতুন নয়। অতীতে বিভিন্ন সময়ে আন্দোলন করতে গিয়ে তিনি একাধিকবার কারাবরণ করেছেন।  

কিন্তু এবারের জেলে যাওয়ার সঙ্গে তার নিজের এবং দলের রাজনৈতিক ভবিষ্যতের অনেক কিছুই জড়িত। নিজের নির্বাচনী সুযোগ অক্ষুণ্ন রাখা ও দলকে সুসংহত ও ভাঙনমুক্ত রাখার জন্য তার উপস্থিতি অপরিহার্য। তাই আসন্ন নির্বাচনকে সামনে রেখে দণ্ড নিয়ে বেগম জিয়ার কারাগমন বিএনপির দলীয় রাজনীতির জন্য নানা দিক থেকেও বিপজ্জনক।

ফলে আইন-আদালতের আওতা থেকে তাকে নির্দোষ প্রমাণ করে রাজনীতির মাঠে ফিরিয়ে আনা বিএনপির সামনে সবচেয়ে অগ্রাধিকারের বিষয়। বিএনপির ঐক্য ও ভবিষ্যৎ নিয়ে যারা চিন্তা-ভাবনা করেন, তারা আবেগ বা উত্তেজনার বদলে আইনগত দিকগুলোকেই বেশি প্রাধান্য দিচ্ছেন।

এমন কি, বিএনপির নেতৃত্ব ও আইনজীবীগণ সব সময়ই বলে এসেছেন যে, উচ্চ আদালত থেকে খালেদা জিয়াকে নির্দোষ প্রমাণ করে বেকসুর খালাস করাবেন। আইনি তৎপরতার মাধ্যমে এ কাজটি করতে হলে কেবল উত্তেজনা ছড়ানো কিংবা মুখের কথা বলাই যথেষ্ট হবে না, প্রয়োজন হবে দক্ষতার সঙ্গে আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণ করা। শীর্ষ নেত্রীকে মুক্ত করতে বিএনপি নেতারা আইনি লড়াইয়ে কি রকম কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে সক্ষম হন, এখন সেটাই দেখার বিষয়।

কারণ বিএনপি ও খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ বলতে গেলে মূলত আইনি প্রক্রিয়ার সঙ্গেই জড়িত। দলের আইনজীবী ও নেতৃবৃন্দের কৃতিত্ব দেখানোর জায়গাটিও এখন উচ্চ আদালতের আঙিনায় চলে গেছে। দলের বিপুল সংখ্যক কর্মী-সমর্থক সেদিকেই তাকিয়ে আছেন। শীর্ষ নেত্রীর দণ্ড বাতিলের আইনি লড়াইয়ে তারা কেন্দ্রীয় নেতাদের দক্ষতা, সততা ও কুশলী ভূমিকা দেখতে চান।  

এমনই একটি সঙ্কুল পরিস্থিতিতে খালেদা জিয়াবিহীন বিএনপির হাল ধরতে হচ্ছে তারেক রহমানকে, যিনি দৃশ্যত রয়েছেন দলের নেতা-কর্মীদের থেকে দূরে। খালেদা জিয়ার পর তারেক রহমানই যে বিএনপির একমাত্র কাণ্ডারী, একথা দিবালোকের মতো স্পষ্ট। কিন্তু এমন একটি বিরূপ বাস্তবতায় তার ওপর শীর্ষ নেতৃত্বের দায়িত্বটি চলে এসেছে, যা বাস্তবিকই কঠিন ও নির্মম। তার নেতৃত্বের সঙ্গে সঙ্গে একগুচ্ছ চ্যালেঞ্জও সঙ্গী হয়ে এসেছে। যেসব চ্যালেঞ্জ কেবল রাজনৈতিক দিক দিয়েই নয়, ব্যক্তিগত দিক থেকেও ভীষণ স্পর্শকাতর। কারণ তার একদিকে রয়েছে তার মায়ের ও নিজের সাজা, অন্যদিকে দলকে রক্ষা করার দায়িত্ব।

শুধু খালেদা জিয়ার সাজার বিষয়টি বিএনপির সামনে একমাত্র বিপদ হলে হয়ত দল সেটা আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে কাটিয়ে উঠতে পারত বা তারেকের বিকল্প নেতৃত্বের মাধ্যমে এগিয়ে যেতে পারত। কিন্তু ভেতর থেকে বিএনপিকে আরও বিপদ চেপে ধরেছে। দলের মধ্যে উপদলীয় বিভাজন ও ভাঙনের স্পষ্ট পদধ্বনি শুনতে পাওয়া যাচ্ছে। ক্ষমতামুখী দল বিএনপির উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নেতা সরকারের সঙ্গে আঁতাত করে দল ভেঙে নির্বাচন করতে চান বলে যেসব খবর পাওয়া যাচ্ছে, সেটাও বিএনপির জন্য কম বড় বিপদ নয়। জেলে থেকে খালেদা ও বিদেশে থেকে তারেক এদেরকে কিভাবে সামাল দেবেন? 

খালেদা কারাগারে থাকায় বিদেশবাসী তারেকের নেতৃত্বও মসৃণ হবে না। কারণ তারেককে দূর থেকে নানা জনের মাধ্যমে দল পরিচালনা করতে হবে। কিন্তু সবাই, বিশেষ করে সিনিয়র নেতারা এবং দল ভাঙনে আগ্রহীরা তারেকের নির্দেশনা ও নেতৃত্ব কতটুকু মান্য করবে, সেটাও বিবেচনায় নিতে হবে। বরং এমন আশংকাও দেখা যাচ্ছে যে, শীর্ষ নেতৃত্বের প্রত্যক্ষ উপস্থিতি না থাকায় বিএনপিতে কোন্দল, দ্বন্দ্ব ছড়িয়ে পড়বে। খোদ খালেদা জিয়ার উপস্থিতিতে স্থায়ী কমিটির সভাতেই যারা প্রকাশ্যে কলহে লিপ্ত হন, তারা  খালেদা ও তারেকের অনুপস্থিতির সুযোগ কাজে লাগাবেন। এর ফলে দলে বিভেদের ঊর্বর ক্ষেত্রে তৈরি হওয়ার বিপদকেও ছোট করে দেখা যায় না।

এমনই বহুমুখী আবেগ ও স্পর্শকাতরতা ডিঙিয়ে দলকে হঠকারিতা ও বিপথগামিতার হাত থেকে বাঁচিয়ে সঠিক পথে পরিচালনা করার মাধ্যমে বিদ্যমান সঙ্কট থেকে সম্ভাবনার জায়গা নিয়ে আসা নতুন শীর্ষ নেতা তারেক রহমানের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। বিশেষত, খালেদা জিয়াকে আইনি লড়াইয়ে মুক্ত করা, দলের ভাঙন ঠেকানো ও আন্দোলন, এই তিনের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার ঝুঁকিপূর্ণ কাজটি বিএনপির শীর্ষ দায়িত্বে থাকা তারেক রহমানকেই করতে হবে।   

খালেদা জিয়ার অবর্তমানে বিএনপিকে অটুট, ঐক্যবদ্ধ, ভাঙনমুক্ত ও সঠিক পথে রেখে কৌশলপূর্ণ পদক্ষেপে দলীয় সঙ্কটসমূহ উত্তরণে এগিয়ে যাওয়ার কঠিন অগ্নিপরীক্ষায় তারেক রহমানের নেতৃত্বের সাফল্যের উপর অনেকাংশেই নির্ভর করছে বিএনপির রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ। সরকারের সর্বগ্রাসী পরিকল্পনার নানামুখী পদক্ষেপের প্রেক্ষাপটে বিএনপিকে অনেক হিসাব করে পা ফেলতে হবে, একথা বলাই বাহুল্য। সামনের দিনগুলোতে অগ্র-পশ্চাৎ ভেবে চলতে পারলেই বিএনপির পক্ষে কঠিন অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া সম্ভব হতে পারে।

লেখক: ড. মাহফুজ পারভেজ, প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

বাংলাদেশ সময়: ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৮, ২০১৮
এমপি/জেএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।