ইসলাম ধর্মানুযায়ী, আল্লাহতায়ালা আদম (আ) কে জ্ঞান শিক্ষাদানের আগে ভাষা শিখিয়েছেন৷ ভাষা ছাড়া জ্ঞান শিক্ষাদান বা অর্জন অত্যন্ত কঠিন। ভাষার গুরুত্ব অপরিসীম বলেই জ্ঞান ও শিক্ষার সূচনায় দেখা গেছে ভাষাকে।
পবিত্র কুরআনে এ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন: (অনুবাদ) তিনি সৃষ্টি করেছেন মানুষ, তিনিই তাকে শিখিয়েছেন ভাবপ্রকাশের উপযোগী ভাষা৷ (সূরা আর রহমান, আয়াতঃ৩-৪)
ভাষার মাধ্যমে আল্লাহ আদমকে (আ.) একে একে সবকিছুর শিক্ষা দেন এবং এ শিক্ষার মাধ্যমেই তিনি নানা বিষয়ে জ্ঞান লাভ করেন। ফলে ধর্ম ও জাগতিক, উভয় ক্ষেত্রেই ভাষা হলো শিক্ষার প্রথম মাধ্যম।
ইসলামের ধর্মতাত্ত্বিক বিবরণে দেখা যায়, তারপর আল্লাহর ইচ্ছায় জ্ঞানের পরীক্ষায় তিনি ফেরেশতাদেরকেও হার মানাতে সক্ষম হন। এভাবেই মানুষ সকল সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ বা আশরাফুল মাখ্লুকাত হিসেবে সর্বোচ্চ মর্যাদার অধিকারী হয়। এ মর্যাদার মূল ভিত্তি হল জ্ঞান। আর জ্ঞান অর্জনের মাধ্যম হলো ভাষা, যার গুরুত্ব অপরিসীম।
আল্লাহ হযরত আদম (আ.) কে সৃষ্টি করে তাঁকে ভাষা শিক্ষা দেন এবং সেই ভাষার মাধ্যমে তাঁকে প্রয়োজনীয় জ্ঞান দান করেন। এরপর জ্ঞানের দ্বারা আদম (আ.)-এর শ্রেষ্ঠত্ব তিনি প্রমাণ করেন। এটা মহান স্রষ্টার এক সীমাহীন মহিমা ও অপরিসীম কুদরত বৈ আর কিছুই নয়। এ কুদরত প্রদর্শনের জন্যই তিনি আকাশমণ্ডলী বা সৌরজগৎ ও বৈচিত্র্যময় সুন্দর পৃথিবী, বিভিন্ন বর্ণে-গোত্রে বিভক্ত মানুষ ও ভাষার সৃষ্টি করেছেন। ভাষার পার্থক্য ও জাতিগত পার্থক্য সম্পর্কেও বলা হয়েছে যে, এটা করা হয়েছে, যাতে একে অপরকের চিনতে পারে।
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ আরও ঘোষণা করেন যে, (অনুবাদ) এবং তাঁর (আল্লাহর) নিদর্শনাবলীর মধ্যে রয়েছে আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র্য। এতে জ্ঞানীদের জন্য অবশ্যই নিদর্শন রয়েছে। (সূরা রূম,আয়াতঃ২২)
এই বক্তব্যের মাধ্যমে স্পষ্ট হয়েছে যে, আকাশমণ্ডলী, পৃথিবী, বিভিন্ন বর্ণ-গোত্র ও ভাষার বৈচিত্র্য সবই আল্লাহতায়ালার অসীম কুদরত ও নিদর্শনাবলির অন্তর্ভুক্ত। বিশ্বজগতে অসংখ্য সৃষ্টির মধ্যে যেমন নানা বৈচিত্র্য লক্ষ্য করা যায়, মানবজাতির মধ্যেও তেমনি বিদ্যমান রয়েছে নানা বর্ণ-গোত্র ও ভাষার মাধ্যমে সৃষ্ট চমৎকার বৈচিত্র্য। এসব বৈচিত্র্যের মাধ্যমে মহান স্রষ্টার অসীম কুদরত ও ক্ষমতারই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। এটাকে যথারূপে উপলব্ধি করার মাধ্যমেই স্রষ্টার মহানত্ব উপলব্ধি করা সম্ভব। এক্ষেত্রে জ্ঞান অর্জনের প্রতি উৎসাহিত দেওয়া হয়েছে ভাষার মাধ্যমে।
পবিত্র কুরআনের অন্যত্র আল্লাহ বলেছেন যে, (অনুবাদ) “আমি প্রত্যেক রাসূলকেই তাঁর স্বজাতির ভাষাভাষী করে পাঠিয়েছি তাদের নিকট পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করার জন্য। ” (সূরা ইব্রাহীম, আয়াতঃ৪)
অর্থাৎ প্রত্যেক রাসূল ও নবীকেই তাঁর স্বজাতির ভাষাভাষী করে পাঠানো হয়েছে এবং তাঁর মাতৃভাষাতেই আল্লাহতায়ালা ওহি বা ঐশী আদেশ প্রেরণ করেছেন। অতএব, এর দ্বারা প্রত্যেক মানুষের মাতৃভাষার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের কথা ফুটে উঠেছে৷ অতএব মাতৃভাষার ধর্মীয় গুরুত্ব সম্পর্কে উপলব্ধি না করার কোনও কারণ থাকতে পারে না।
ঐতিহাসিকভাবেই বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। নিজের ভাষার মযাদা দেওয়া ও চর্চা করার গুরুত্বও এ প্রসঙ্গে স্পষ্ট হয়। ফলে নিজের মুখের ভাষাকে উপেক্ষা বা অবহেলা করা কিছুতেই কাম্য হতে পারে না। ধর্ম কখনোই তা বলে না। বরং ধর্ম জ্ঞানী হওয়ার জন্য ভাষার পথ ধরে এগিয়ে আসার প্রেরণা দেয়।
একথা সহজেই বোধগম্য যে, মাতৃভাষাকে বাদ দিয়ে বা উপেক্ষা করে কোনো মানুষ বা জাতি কখনও উন্নতি লাভ করতে পারে না৷ মাতৃভাষার গুরুত্ব জীবনের সর্বক্ষেত্রেই প্রসারিত। ব্যক্তিগত,পারিবারিক বা সামাজিক বিভিন্ন কাজ সম্পাদনে এর প্রয়োজন অসীম৷ জীবনপথের প্রতিটি শাখাতেই মাতৃভাষার মুখাপেক্ষী প্রতিটি মানুষ৷ পরিবারে বা সমাজে সুন্দর ও সফল জীবন যাপন করার জন্য মাতৃভাষার বিকল্প নেই৷ জীবনকে জ্ঞান ও আলোয় পরিপূর্ণ করতে হলে প্রথমেই মাতৃভাষায় দক্ষতা প্রয়োজন। পরবর্তী সময়ে অপরাপর ভাষার প্রয়োজনীয়তা থাকলেও সেটা মাতৃভাষাকে বাদ দিয়ে নয়। মাতৃভাষার প্রতি ইসলামের সমর্থন বাংলা ভাষা চর্চায় আত্মনিয়োগের তাগিদ দেয়।
বাংলাদেশ সময়: ০৯১০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৯, ২০১৮
এমপি/ জেএম