ঢাকা, শনিবার, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

দিনগুলো জীবনের উপহার

এরশাদুল আলম প্রিন্স, ল’ এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১১৬ ঘণ্টা, মার্চ ৩১, ২০১৮
দিনগুলো জীবনের উপহার প্রতীকী ছবি

রাজা যায় রাজা আসে। এই পৃথিবীতে কতো রাজা, বাদশা, নবাব, বাহাদুর, উজির, নাজির, কাজি, পেয়াদা এসেছেন আবার চলেও গেছেন তার খবর কে রাখে? আর প্রজা? তার তো কোনো হিসাবই নেই। কিন্তু ইতিহাসের খাতায়-পাতায় সব হিসাবই জমা আছে। সেখানে বিচরণ করলে দেখা মেলে সে সব মহামানবের যারা জীবনকে জয় করেছেন, যারা ‘মরিয়া প্রমাণ করিয়াছেন যে আসলে তারা মরেন নাই’। 

মানুষ হয়তো কখনোই সময়কে জয় করতে পারবে না। কিন্তু গবেষণা ও আবিষ্কার দিয়ে মানুষ বর্তমানকে নিয়ে যেতে পারে ভষিষ্যতে অথবা ভবিষ্যতকে নিয়ে আসতে পারে বর্তমানে।

আর অতীতের পত্রপাঠ অথবা ইতিহাসচর্চায় আমরা চলে যেতে পারি অতীতেও। আমরা যারা অ-বিজ্ঞানী অথবা টাইম মেশিন বুঝি না, তাদের কাছে এটাই সময়কে জয় করার সমান।  

সময়কে জয় করার আরো একটি ‘জ্ঞাত উপায়’ জানা আছে আমাদের। তা হলো কর্ম। আমাদের বাপ-দাদা, অথবা তার দাদার দাদার জন্মেরও আগের যেসব মানুষদের আমরা বর্তমানে স্মরণ করছি, তারা সবাই তাদের বর্তমানকে করেছেন কর্মময়। তাই বহুযুগ পরেও আমরা তাদের স্মরণ করছি। এটা কি সময়কে জয় করা নয়? পাশাপাশি এটা জীবন জয়েরও উপায়। মৃত্যুকেও জয় করার যায় এভাবে।  

আসলে বর্তমান বলতে কিছু নেই, সবই ভবিষ্যৎ অথবা অতীত। বলা হয়, Everyday is a gift, that's why it's present. প্রতিটি দিনই আমাদের কাছে আসে এক অমিত সম্ভাবনা নিয়ে। কর্মযোগে আমরা আমাদের দিনগুলোকে করতে পারি সমৃদ্ধ। বর্তমান সমৃদ্ধ হলেই ভবিষ্যতে ঠাঁই পাওয়া যায়। যার বর্তমানের পাল্লা ভারী তার ভবিষ্যৎ সবচেয়ে সুদূরপ্রসারী। এজন্যই আমরা কাউকে দুই বছর, কাউকে পাঁচ বছর আবার কাউকে পাঁচশ বছর মনে রাখি। তবে স্মরণ করাই বড় কথা নয়। কীভাবে স্মরণ করছি সেটাও বিবেচ্য। বাঙালি বঙ্গবন্ধুকেও মনে রাখবে আর ইয়াহিয়াকেও ভুলবে না। স্মরণের মাঝে ভালোবাসা না ঘৃণা সেটাই বড় কথা। বর্তমানকে হীনকর্মযোগে সমৃদ্ধ করে ভবিষ্যতে ঠাঁই নেয়ার চেয়ে কর্মহীন হয়ে অতীতের বুকে হারিয়ে যাওয়া ঢের ভালো। কারণ, ঘৃণা অর্জনের চেয়ে ভালোবাসা না পাওয়া উত্তম। ভালোবাসা না পেয়ে বেঁচে থাকা যায়, কিন্তু ঘৃণা নিয়ে বেঁচে থাকা কঠিন- এমনকি মৃত্যুর চেয়েও তা কঠিন।  

কিন্তু মৃত্যু আসলে কী? এ নিয়ে চিকিৎসক, বিজ্ঞানী ও দার্শনিকদের মধ্যে মতভেদ আছে। থাকাটাই স্বাভাবিক। সঠিক ব্যাখ্যা হয়তো কোনো একজন মৃত মানুষের কাছেই আছে। কিন্তু সেখানে গেলেতো আর ফিরে আসা যায় না। আর সেখানে গিয়ে সত্যটা যেনে এই পৃথিবীর মানুষকে জানানোও সম্ভব না। তাই মৃত্যুর মানে খোঁজার চেয়ে জীবনের মানে খোঁজাই অর্থবহ। কিন্তু এখানেও তো ঘাপলা। যে চুরি করে তার কাছে ওটাই জীবন। রাজনীতিক অথবা মুচি একেক জনের কাছে জীবনের মানে একেক রকম।  

এই জীবিকা দিয়ে জীবন বিচার আসলে জীবনের প্রতি অবিচার করার শামিল। জীবিকার জন্যতো আর জীবন নয়, জীবনের জন্যই জীবিকা। মৃত্যু পর্যন্ত শরীরকে বয়ে নিয়ে যাওয়ার মানে জীবন নয়। তাতে বেঁচে থাকা যায় কিন্তু সে বেঁচে থাকায় জীবন খুঁজে পাওয়া যায় না। মৃত্যুর ভয়ে জীবনকে বয়ে বেড়ানো, অতঃপর মৃত্যুর কাছেই পরাজয় স্বীকারই এ বেঁচে থাকার অর্জন। ভূপেন হাজারিকার একটি গানে শুনতে পাই, ‘জীবন খুঁজে পাবি, ছুটে  ছুটে আয়, মরণ ভুলে গিয়ে ছুটে ছুটে আয়। ’ মৃত্যুর ওপারেও নিজের অস্তিত্ব জানান দেয়াই আসল জীবন।  

মৃত্যুর ওপারে বেঁচে থাকাই যদি আসল জীবন হয়, তবে তো এপারে আমাদের ব্যস্ততার অন্ত থাকার কথা নয়। কিন্তু আমাদের হাতেতো অঢেল সময়, শুধু আসে আর যায়। কোনো সময়ের বুকেই আমরা নিজের নামটি খোদাই করে রাখতে পারি না। তাই বায়ুই আমাদের আয়ু। দম ফুরালেই সব শেষ। কিশোর কুমারের গানে শুনি, ‘হিংসা বিবাদ লোভ ক্ষোভ বিদ্বেষ/চিতাতেই সব শেষ। ’

কিন্তু চিতার পরেও চেতনাকে ধরে রাখা যায় বহুবছর, এমনকি যুগ যুগ ধরে। সেই চেতনাকে ধারণ করে বেঁচে থাকে ভবিষ্যতের বহু মানুষ, বহু প্রজন্ম। চিতায় গান্ধীর চেতনা ভষ্ম হয়ে যায়নি, প্লেনে ক্ষত-বিক্ষত হয়নি সুভাষ চেতনা। মহান চেতনা ও আদর্শকে ধারণ করে মৃত্যুর হিম শীতল পরশে আবাহন করাই মনীষীদের কাছে জীবন। এমন মৃত্যু যতোটা কেড়ে নেয়, দেয় তার চেয়ে বেশি।  

অর্থই জীবনের অর্থ নয়। বরং অর্থই অনর্থের মূল। পৃথিবী বড়ই স্বার্থপর। এ পৃথিবী কোনো অর্থ বিত্তশালীকে মনে রাখে না। তবে ব্যতিক্রমও আছে, পৃথিবী রকফেলারকে মনে রেখেছে, কিন্তু তা তার অর্থের জন্য নয়, তার মনুষ্যবাদী চেতনার জন্য।  

বাইবেল বলছে, ‘অসার, অসার! কোনো কিছুই স্থায়ী নয়। সব কিছুই অসার। ’ একসময় রাজা সলোমন বিশাল ধন-সম্পদের মালিক ছিলেন। জ্ঞান ও প্রজ্ঞায়ও তিনি সেরা। কোনো কিছুরই অভাব নেই তার। মন যা চাইত তা-ই করতে পারতেন। তারপরেও তিনি জীবনের শেষ লগ্নে বলে গেছেন, ‘সূর্যের নীচে’ যদিও বেঁচে থেকে সব কিছু করছি; আমরা যা চোখে দেখি-এ সবই অসার। কিন্তু কেন এই গভীর শূন্যতা? অসারতা? এর উত্তর খুঁজে পাওয়া যায় মহান মানুষদের জীবনে যারা মৃত্যুকে জয় করেছেন। জীবনের সব শূন্যতা তারা সৎকর্ম দিয়ে পূরণ করেছেন। আমরা শুধু তার সুফলভোগী। কিন্তু ভবিষ্যতে যারা আসবে তারা আমাদের কর্মফল ভোগ করবে? আমরা কি কিছু রেখে যাচ্ছি? আমাদের বর্তমান কেমন?

আমরা ইতিহাসের মহাপুরুষদের মনে রেখেছি কারণ তারা শুধু তাদের জন্যই পৃথিবীতে আসেননি, জন্মগ্রহণ করেননি। তারা তাদের সময় ও সমাজকে আলোকিত করেছিলেন। তাদের কাছে জীবনের মানে অনেক কিছু। আমরা অধম, আমাদের কাছে জীবনের মানে ষড়রিপু। কিন্তু তারপরও আমরা জীবনকে জয় করতে চাই, মৃত্যুকে জয় করতে চাই, চাই সময়কে জয় করতে। হে সময়, একটু ধীরে চল, আমরা যে গতিহীন সেই সঙ্গে বেগতিকও। তবু পথ চলতে চাই-বিশ্বাস করি এটাই জীবন।  

বাংলাদেশ সময়: ১৭০৫ ঘণ্টা, মার্চ ৩১, ২০১৮
এএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।