ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

 শিক্ষকের কাঠগড়া ও কাঠগড়ার শিক্ষক!

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৩০০ ঘণ্টা, অক্টোবর ৬, ২০১৮
 শিক্ষকের কাঠগড়া ও কাঠগড়ার শিক্ষক! প্রতীকী

ফারুক স্যার মারতেন টেবিলের নিচে মাথা দিয়ে। হাত দুইটা থাকতো উপরে। স্যার দাঁড়িয়ে মেরুদণ্ড বরাবর চাপিয়ে একটা...। মাগো! বলে যখনই উঠতে যেতাম, টেবিলে ব্যথা পেতাম আবার। পরি! মরি! করে উঠে দুই হাত পেছনে দিয়ে তিন বাঁকা হয়ে দৌড় লাগাতাম।

রবিউল স্যারের বেত থেকে বেশি ভয় লাগতো চোখের আগুন। চোখ জোড়া যখন বড় করে তাকাতেন, তখন মনে হতো থ্রি নট থ্রি রাইফেলের গুলি ছুটে আসছে আমাদের দিকে।

 

জিংলা বেতের এক ঘা’য়ে পরিমল স্যারের পোষাতো না। তিনি বিশেষ কায়দায় বানানো বেত দিয়ে ঢোল বাজাতেই বেশি পছন্দ করতেন। মানে এক নাগাড়ে গোটা বিশেক আঘাত!

কামাক্ষ্যা স্যারের বিষয়তো এখনো সবার মুখে মুখে। শিক্ষার্থীদের এখনো বলা হয় তোদের সময় ভাল যে কামাক্ষ্যা স্যারের হাতে পড়িসনি। চেহারা দেখেই মানুষ হয়ে যেতি। স্যার বছরে একবার ধরতেন। যাকে ধরতেন তাকে ছাড়তেন না। স্যারের থেরাপির পর ওষুধ খেতে হতো। নবম শ্রেণিতে উঠার আগেই ছাত্ররা তটস্থ থাকতো স্যার আবার কখন রেগে যান এই শঙ্কায়।

একবার ঘটলো আরো ভয়ানক ঘটনা। কোন এক কারণে ফারুক স্যার লেইজার পিরিয়ডে মাথায় বই দিয়ে আমাদের স্কুল মাঠ চক্কর দেয়াচ্ছেন। দুপুরের তপ্ত রোদে বিশাল মাঠ চক্কর দিতে গিয়ে আমাদের তখন ত্রাহি মধুসূদন অবস্থা। এরই মধ্যে মরার উপর খড়ার ঘাঁ হয়ে স্কুলে হাজির বড়দা। কী কাজে যেন তিনি স্কুলে গিয়েছিলেন। ঘটনা দেখে ফেললেন তিনি। যা হবার তা-ই হলো। বাড়িতে আসার পর বাবা ভাইয়ের সম্মিলিত আক্রমনে আমি দিশেহারা! তাদের প্রশ্ন কেন আমি পড়া পাড়লাম না। বাবা-ভাইয়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পরের দিন স্যারের কাছে গিয়ে নিজ দায়িত্বে ক্ষমা চাইলাম, একই সঙ্গে এমন আর হবে না বলে কথা দিলাম।

নবম শ্রেণিতে পড়ার সময়ও আমার ইংরেজি জ্ঞান চাহিদার সমান ছিলনা। ফলে, বাবা আমাকে নিয়ে গেলেন কামাক্ষ্যা স্যারের কাছে। বললেন, ‘স্যার আমার ছেলেকে আপনার হাতে তুলে দিলাম। মারেন, কাটেন যা-ই করেন শুধু ছেলেটাকে মানুষ করে দেন। ’ গল্পের মাঝে কখন যে স্যার পড়িয়ে ফেলতেন টেরই পেতাম না। সঙ্গে বছরে একবার মারের ভয়তো ছিলই। নিজ ধর্মের বাইরেও তার দখল ছিল বেশ। পুরো গ্রামের মানুষের আস্থার ঠিকানা ছিলেন স্যার।

একবার প্রচণ্ড রাগে স্যার এক ছাত্রীকে প্রাইভেট থেকে সোজা বের করে দিলেন। তার সাফ কথা, তোর মতো ছাত্রী আমার লাগবে না। পরের তিনদিন মেয়েটা স্যারের ফটকের আশপাশে ঘুর ঘুর করেছে। ভেতরে যাবার সাহস পায়নি। চতুর্থ দিন মেয়ের মা নিজে তাকে নিয়ে গেলেন স্যারের কাছে। মা-মেয়ে দু’জনই স্যারের পায়ে প্রণাম করে বললেন, স্যার এবারের মতো ক্ষমা করে দিন। মায়ের সহজ উক্তি, ‘আপনি যদি ছেড়ে দেন, আমার মেয়েকে মানুষ করবে কে’ ?

লেখার প্রথম দিকে বলেছিলাম, পরিমল স্যারের (দেবব্রত বণিক) কথা। কালি কাগজ বাঁচাতে যিনি পেন্সিল দিয়ে অংক করাতেন। একবার লিখার পর ইরেজার দিয়ে মুছে আবার পেন্সিল দিয়ে করা, তারপর কলমের ব্যবহার। কড়া নির্দেশে আমি আর সহপাঠী মুন্না ভোর সাড়ে চারটায় স্যারে দরজায় কড়া নাড়তাম। আমাদের পড়ার টেবিলে কাজ দিয়ে তবেই তিনি প্রাত:কাজ সারতে যেতেন। সকালে দুধ-মুড়ি খাইয়ে নিজের সঙ্গে স্কুলে নিয়ে যেতেন। রাগের চোটে কখনো ঢোল বাজাতেন আবার কখনো খাটের স্ট্যান্ড খুলে তেড়ে আসতেন। তার কমন ডায়লগ ছিল,‘জান দিয়া প্রাণ দিয়া পড়’।  

একবার সাহস করে প্রশ্ন করলাম, স্যার, প্রাণ দিয়া পড়লে বাঁচবো কেমনে। স্যারের সহজ কথা- ‘বিদ্যা ছাড়া যে বেঁচে থাকা, তাতে প্রাণ থাকেনা রে পাগলা’।

দশম শ্রেণি পর্যন্ত আমাদের চুল কাটা, হাতের নখ ছোট রাখা থেকে শুরু করে জীবন চর্চার পুরোটা নিয়ন্ত্রণ করতেন তিনি। ভয়ে কোন দিন রাস্তায় স্যারের সামনে পর্যন্ত পড়তে চাইতাম না। তার ভয়ে সেই যে চুল ছোট করে স্কয়ার কাটার অভ্যাস চালু হয়েছিল তা এখনো আছে আমার। ঠিক যেন বিজ্ঞাপনের মতো, ‘ত্রিশ বৎসব মাখছি, মাথা ঠাণ্ডা রেখে আজও কাজ করছি।  

একবার স্কুলে সাময়িক পরীক্ষা চলছে। পরিমল স্যার চেয়ারে বসে হুঙ্কার ছাড়ছেন, মনে রাখবা কারো পাতে যেন মাছি না ধরে। নিজ দায়িত্বে পরীক্ষার খাতা ঢেকে রাখ। এক ছাত্র তাতে কান না দিয়ে পাশের জনের খাতায় যেই না উঁকি দিলেন স্যার তার সামনে চলে আসলেন। কাঁপা গলায় ছাত্রের উক্তি, স্যার আমি দেখে কিছু লিখি নাই। এমনিই চেয়ে ছিলাম। চোখ জোড়া বড় করে স্যার বললেন, কানারে তুমি তাজমহল দেখাতে চাও। তারপর যা হবার তাই হলো। পরের কয়দিন স্যারের কথা মনে হলেই পিঠে হাত চলে যেত ওই বন্ধুর। বড় বেলায় কথা প্রসঙ্গে আমাকে একবার জানিয়েছিল সেদিনের পর আর কোনদিন নকল করার চেষ্টা করেনি সে। আজ আমার সেই বন্ধু চিকিৎসক! 

তখনকার স্যারদের মারে ছিল ভালোবাসা, আবেগ, স্বপ্ন জয়ের শত ফুল। নিজের সন্তান আর শিক্ষার্থীদের মধ্যে কখনো ফারাক দেখেননি তারা। ফলে আজও তাদের দেখতে ভয় এবং শ্রদ্ধা একই সঙ্গে কাজ করে। বেশিক্ষণ তাদের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে পারি না। মনে হয় এইযেন স্যার আবার পড়া ধরলেন! সেসব শিক্ষকদের ক্লান্তি পরিশ্রম আর ভালোবাসায় আজ আমরা পরিপূর্ণ। তারপরও জীবনের যতো খনা খদ্দর রয়ে গেছে সেগুলো তাদের কথা না শোনারই ফল।

এসব ঘটনার পনের-ষোল বছর পরের ঘটনা। পেশাগত কাজ শেষে দাঁড়িয়ে আছি একটি পরীক্ষা কেন্দ্রের সামনে। কানে আসলো দুই ছাত্রের কথোপকথন। একজন, শিক্ষকের নাম ধরে গালি দিয়ে বলছিলো- ‘শালা আমারে কপিটা দিতে ১০ মিনিট লেইট করছে। শালার বেটার কাছে হুদাহুদি প্রাইভেট পড়ছি। ’ পাশের ছাত্রের উত্তর-হু, শালা আস্ত বজ্জাত একটা। সিনিয়র শিক্ষককে কাছে পেয়ে নালিশ জানাল কয়েকজন। সাথে যোগ হলো আরো গোটা দশেক অভিভাবক। তাদের সাফ কথা, এই শিক্ষক আমাদের উপজেলার মান নষ্ট করবে। গতবারের মতো জিপিএ প্রাপ্তিতে পাশের উপজেলাই এগিয়ে যাবে। দু-একজন নেতাগোছের মানুষও সাঁয় দিলেন তাতে।

প্রথমবার ছাত্রের মুখে শিক্ষককে নিয়ে গালি-গালাজ শুনে মনে হচ্ছিলো আমরা জ্যাক রুশোর সোশ্যাল কন্ট্রাক এর কতোতম অধ্যায়ে বাস করছি! যেখানে ছাত্র তার জীবনের পূত পবিত্রতম মানুষকে জ্যান্তো সাদৃশ্য গালাগাল করছে।

তখনই চোখের সামনে জ্বলজ্বল করে উঠলো ঘণ্টা খানেক আগের ঘটনা। কেন্দ্র্রে পরীক্ষা চলছে। স্যারদের প্রাণান্তকর চেষ্টা শিক্ষার্থীদের পাস করাতেই হবে। একজন ছাত্রকে প্রথম বেঞ্চ থেকে তুলে শেষ বেঞ্চে নিয়ে গেলেন মাঝ বয়সি এক শিক্ষক। পকেট থেকে কিছু একটা বের করে দিলেন তার হাতে। তারপর চাপা গলায় রাগত স্বরে বললেন, ‘গাঁধা একটা, উঁকি দিয়েও লিখতে পারেনা। নে এবার দু’জনে মিলে লেখ। ’ 

আরেক শিক্ষক বললেন, ‘ওই পুলাপান, তোরা কথা বলিস না, একে অপরকে সহযোগীতা কর। ম্যাজিস্ট্রেট এলো কিনা আমি দেখি।

জানলার সামনে দাঁড়িয়ে সেই দৃশ্য দেখে নিজের চোখকে বিশ্বাস করাতে পারছিলাম না। শিক্ষকদের প্রতি আমার সব আনুগত্য তখন দুমড়ে-মুচড়ে একাকার।

পরে মনে হলো না, তাদের (ওই সমস্ত ছাত্র-শিক্ষক) মধ্যে যে সম্পর্ক তাতে গালাগাল কমেডিকে আরো রসালো করেছে! আচ্ছা ছাত্র-সম্পর্ক কি আজ তাহলে শালাদুলাভাই সম্পর্কে দাঁড়িয়েছে?

ক’দিন আগে একটি চুটকি পড়েছিলাম এমন, এক ছাত্র তার শিক্ষককে বলছে, স্যার আগামীকাল আমার বান্ধবীর জন্মদিন, কী উপহার দেয়া যায় বলেন তো। স্যার বললো, তোর বান্ধবী দেখতে কেমন। ছাত্র বললো-অসাধারণ, ঠিক যেনো মাধুরী দিক্ষীত! শিক্ষক তখন বললো, তাহলে আমার নম্বরটাই দিয়ে দে। মনে প্রশ্ন জাগে এমন যদি হয় টিচার, তাহলে কে করবে ভালো মন্দের বিচার?

আহা! কবে আসবে সেই দিন যেদিন আমরা আবারো শিক্ষকদের পা ধুয়ে দেবো। শিক্ষার্থীরা ঝাঁক বেঁধে অপেক্ষা করবে কখন তার প্রিয় শিক্ষক আসবে। তবে নকল নিয়ে নয়, জ্ঞানের অমৃত প্রসাদ নিয়ে।  

অভিভাবকরা আব্রাহাম লিংকনের মতো চিঠি লিখবে। আমার সন্তানকে শেখাবেন, ‘নকল করে পাস করার চাইতে অকৃতকার্য হওয়াও ভালো। ’ 

বিশ্ব শিক্ষক দিবসে সব মানুষ গড়ার কারিগরদের পায়ে প্রণতি। ভালো থাকুন প্রিয় শিক্ষকেরা।  

সাবেক জেলা প্রতিনিধি, বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

বাংলাদেশ সময়: ২২৫০ ঘণ্টা, অক্টোবর ০৫, ২০১৮
এসএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।